Ajker Patrika

ধর্ষণের পর চুপ হয়ে গিয়েছিল লামিয়া, ট্রমা তার জীবনই কেড়ে নিল

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০০: ৫০
থালা বদ্ধ এই ঘর থেকে লামিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা
থালা বদ্ধ এই ঘর থেকে লামিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা

পটুয়াখালীতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়ে চুপচাপ হয়ে যায় মোসা. লামিয়া। মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন মা রুমা বেগম, নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু ট্রমায় ভুগতে থাকা লামিয়া অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সে একেবারে একা একা থাকতে শুরু করে, প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা বলে না সে। কিন্তু মায়ের চেষ্টা থামে না। মেয়েকে খুশি করতে তাঁর নানা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করেন তিনি। তাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেন। কিন্তু বেঁচে থাকতে আর লামিয়ার নানাবাড়ি আর যাওয়া হলো না!

গতকাল শনিবার রাতে মোহাম্মদপুরের আদাবরের বাসার দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয় লামিয়ার লাশ। আজ রোববার সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর মরদেহ নিয়ে পটুয়াখালীতে চলে যান মা ও নানী আকলিমা বেগম।

আদাবরের শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কের মাথায় শ্যামলী হাউজিং এলাকায় রামচন্দ্রপুর খালের পাড়ে তিন তলা জরাজীর্ণ একটি ভবন। সেই ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ৯ বছর ধরে সপরিবারে ভাড়ায় থাকতে লামিয়ার বাবা জসিম হাওলাদার। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক ছিলেন। জসিম ও রুমা দম্পতির তিন সন্তান— লামিয়া, রিয়া মনি ও নয় মাসের জুবায়ের। ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় লামিয়া পটুয়াখালী পাঙ্গাশিয়া নানার বাড়িতে থেকে দুমকি সরকারি জনতা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ত।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হন জসিম; ৩০ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তাকে পটুয়াখালীর দুমকি দক্ষিণ পাঙ্গাশিয়া হাওলাদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সহপাঠীর মাধ্যমেই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় লামিয়া

বাবাকে হারানোর বেদনার মধ্যে দুর্বিষহ ট্রমার শিকার হয় লামিয়া। চলতি বছর ১৮ মার্চ দুপুরে বাবার কবর জিয়ারত করতে সে পাঙ্গাশিয়ার নানা বাড়ি থেকে দক্ষিণ পাঙ্গাশিয়া দাদার বাড়িতে যায়। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে দাদা বাড়ির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিকেল হয়ে যায়। বিকেলে বাবার কবর জিয়ারত করে সন্ধ্যার দিকে ফের নানা বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে পায়ে হেটে পাঙ্গাশিয়া নানা বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পাঙ্গাশিয়ার আলগি নাম স্থানে পৌঁছালে তার পথরোধ করে তারই সহপাঠী সাকিব মুন্সী ও সিফাত মুন্সী। তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় সাকিব। হাত ধরে ও মুখ চেপে সড়কের পাশে জলিল মুন্সীর বাগানের ঝোপে নিয়ে যায়। সেখানে এই দুই বখাটে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে; মোবাইলে ছবি ও ভিডিওধারণ করে। বিষয়টি কাউকে জানালে এসব ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। এরপর লামিয়াকে ফেলে সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়। লামিয়া কোনোভাবে নিজেকে সামলে নানা বাড়িতে গিয়ে ঘটনা স্বজনদের জানায়। লামিয়ার মা ঢাকা থেকে ছুটে যান বাড়িতে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় লামিয়া। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেই বাদি হয়ে দুমকি থানায় ওই দুই কিশোরকে আসামি করে মামলা করে লামিয়া। মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সাকিব ও সিফাতকে। তারা বর্তমানে যশোর কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে।

দুমকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকির হোসেন বলেন, মামলার পরই দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কারাগারে রয়েছে। তারা দুজনেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে, দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

কটূক্তি ও সামাজিক চাপে চুপচাপ হয়ে যায় লামিয়া, অবশেষ আত্মহত্যা

পটুয়াখালীতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ঘটনাটি দুমকি এলাকায় জানাজানি হয়; আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সহপাঠীরা নানা কটূক্তি করেন, কানাঘুষা হতে থাকে। এসব থেকে বাঁচতে নিজেই ঘরবন্দী হয় লামিয়া। তাকে চলতি মাসেই ঢাকায় নিয়ে আসেন তাঁর মা রুমা বেগম। ঢাকায় সারাদিন নিজেকে বাসার মধ্যেই লুকিয়া রাখতো বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা।

আজ রোববার সকালে শ্যামলী হাউজিংয়ের ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, এক কক্ষের বাসার লোহার দরজাটির সিটকানির পাশ দিয়ে টিন কাটা, দরজাটিও বাঁকা হয়ে যায়। প্রতিবেশী জাকির হোসেন আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ভেতর থেকে সিটকিনি আটকানো ছিল। দরজা কেটে লামিয়াকে বাসা থেকে বের করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। দরজাটি সেই অবস্থায় আছে। তবে ভাঙা দরজায় বাইরে থেকে একটি তালা দেওয়া রয়েছে।

আরেক প্রতিবেশী শারমিন আক্তার বলেন, লামিয়া ধর্ষণের ঘটনার পর বাসা থেকে বের হতো না। সারাদিন বাসার ভেতরেই থাকতো। দুইবার চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়েছিল। গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) লামিয়াকে জামা কাপড় কিনে দেয় মা, ২৭ এপ্রিল তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। শনিবার সন্ধ্যায় লামিয়াকে বাসায় রেখে মেয়ে রিয়া মনিকে পাশের মাদ্রাসা থেকে আনতে যায় রুমা বেগম। এই ফাঁকে দরজা বন্ধ করে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়। বাসার পেছনের জানালা দিয়ে রাত ৮টার দিকে নবোদয় হাউজিংয়ের বস্তির লোকজন ঝুলতে দেখে তারা ওই বাসার বাসিন্দাদের জানায়। এরপর সবাই গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে লামিয়াকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন, দরজা ভেঙে তাকে বের করা হয়। অচেতন অবস্থায় তাকে অটোতে করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শনিবার রাত ১০টায় মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন আদাবর থানার এসআই কমল চন্দ্র ধর। মৃত্যুর কারণ হিসেব তিনি ‘গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার’ কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তার গলায় অর্ধচন্দ্রাকার কালো দাগ’ রয়েছে বলে সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন।

রোববার সকালে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ড. সুব্রত হালদার তার ময়নাতদন্ত করেন। এসময় মর্গের সামনে লামিয়ার মা ও স্বজনদের বিলাপ করতে দেখা যায়।

লামিয়া মা রুমা বেগম বলেন, ‘আমার পাখিকে আমি বাঁচাতে পারলাম না। তাকে নিজের কাছে রাখছি, যাতে কেউ কিছু না বলতে পারে, তারপরও আমার পাখি চলে গেল।’

সকাল ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে লামিয়ার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আসর নামাজের পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে ছুটে যায় বিএনপি ও এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা লামিয়ার মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

এদিকে লামিয়ার বাবা জসিম আন্দোলনে নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন সংগঠন ও মানুষের দান-অনুদানে রুমা বেগম সংসার চালাতেন। ঢাকার খরচ না চালাতে পেরে চলতি মাসে বাসাও ছেড়ে দেন তিনি।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত