Ajker Patrika

অবহেলিত ঐতিহ্যে হাতুড়ি

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
পুরান ঢাকার শতবর্ষী শঙ্খনিধি হাউসটি সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ছবি: হাসান রাজা
পুরান ঢাকার শতবর্ষী শঙ্খনিধি হাউসটি সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ছবি: হাসান রাজা

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর ধ্বংস ঠেকানো যাচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে বেশ কয়েকটি ভবন ভাঙা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে কিছু স্থাপনা ভাঙার কাজ স্থগিত হয়েছে। সাধারণত ছুটির সময়গুলোতে ভবন ভাঙার কাজ করা হয়ে থাকে। কারণ এ সময় অফিস বন্ধ থাকে, তদারকিও কম থাকে।

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার শরৎগুপ্ত রোডে অবস্থিত মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্মৃতিভবন। ভবনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে থাকতেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তিনি বিখ্যাত ‘সওগাত’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। তাঁর মেয়ে নূরজাহান বেগমেরও স্মৃতি রয়েছে এই ভবনে। বেগম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। নূরজাহান বেগমের স্বামী শিশুসংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়েরও স্মৃতি আছে এখানে।

এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি কয়েকদিন আগে ভাঙার কাজ শুরু হয়। ভবনটি এত দিন শুটিং হাউস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি) জানিয়েছে, ভাঙার ঘটনা শুনে তাঁরা সেখানে ছুটে যান। স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করে আপাতত ভাঙার কাজ স্থগিত করা হয়।

ইউএসজির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, ‘এ বাড়িটি কেবল ইট-পাথরের একটি ভবন নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু। এটি ছিল বিভিন্ন প্রজন্মের অগ্রগতির এক আলোকবর্তিকা। লেখক, সাংবাদিক এবং স্বপ্নবানদের একত্র হওয়ার জায়গা। আজ যখন এটি হাতুড়ির কবলে পড়ে, তখন আমরা কেবল একটি ভবনই হারাচ্ছি না; বরং সাহস, সৃজনশীলতা এবং পরিবর্তনের একটি জীবন্ত স্মৃতিও হারাচ্ছি।’

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িটির ফটক তালাবদ্ধ। ভেতরে দরজা-জানালা ভাঙা। বাইরে পড়ে রয়েছে ইট-সুরকির ভাঙা স্তূপ। বাড়ির দেয়ালের সামনে ময়লা-আবর্জনা রাখা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাড়িটি ভাঙার একটি ভিডিও ছড়িয়েছে। তাতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি বাড়িটির ছাদ ভাঙছেন।

এর আগেও বাড়িটি ভাঙার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় এটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। পরে এর কোনো জবাব না আসায় হাইকোর্টে রোকনুজ্জামান দাদাভাইয়ের মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান রিট করেন। রিটে বলা হয়েছিল, ১৮৯০ দশকের দিকে কিশোরগঞ্জের কোনো এক হিন্দু জমিদার এটি তৈরি করেছিলেন। তাই ১২৭ বছরের এ বাড়িটিকে হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নূরজাহান বেগমের পরিবারের এক সদস্য বাড়ি ভেঙে বহুতল ভবন তৈরির চেষ্টা করেন। তখন বাড়িটি সংরক্ষণে ফ্লোরা নাসরিন খান ২০১৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে আবেদন করেছিলেন। যদিও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সর্বশেষ তালিকায় বাড়িটিকে দেখা যায়নি। বাড়িটি নূরজাহান বেগম তাঁর ছোট মেয়েকে দিয়ে গেছেন। তিনি এটি ডেভেলপারকে দিয়ে নতুন বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে রিট আবেদনও তুলে নেওয়া হয়।

শুধু নাসিরউদ্দীন স্মৃতিভবনই নয়, ঢাকার আরও কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ভবন ভাঙার অভিযোগ জানিয়েছে ইউএসজি। তারা জানিয়েছে, ওয়াসার নারিন্দা স্যুয়েজ পাম্পিং স্টেশনের ঐতিহ্যবাহী ভবন ভাঙা হয়েছে, সেখানে ওয়াসা নতুন ভবন তৈরি করবে।

ইউএসজির ভাষ্য, নারিন্দার স্যুয়েজ পাম্পিং স্টেশন সম্ভবত ১৯২৩ সালে নির্মিত। নগর প্রকৌশলের একসময়কার উদাহরণ, যেখানে ব্যবহারিকতার সঙ্গে স্থাপত্যের সৌন্দর্য মিলেমিশে ছিল। এই ভবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর গারগয়েল। গারগয়েল ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কাজ করত। আর ভেতরে ছিল প্রাচীন স্যুয়েজ ও ড্রেনেজ সিস্টেম, যা ঢাকার একসময়ের পরিকল্পিত নগরব্যবস্থার প্রমাণ দিত।

এ প্রসঙ্গে ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, তিনি পুরো বিষয়টি জানেন না। পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখার পক্ষে তাঁরা। এই ভবনটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। নতুন ভবনে যেন পুরোনো ঐতিহ্যের ছাপ থাকে, সে নির্দেশনা তাঁদের রয়েছে।

ঢাকার ফরাশগঞ্জের মঙ্গলালয় ভবনটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঈদুল আজহার ছুটিতে দেখা যায়, এর কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে আলংকারিক অংশগুলো ভাঙা হয় কৌশল হিসেবে, যাতে ঐতিহ্য হিসেবে এর আবেদন না থেকে। এটিও ঈদের ছুটিতে ইউএসজি সাধারণ ডায়রি করে স্থগিত করে।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শঙ্খনিধি হাউসের রাধাকৃষ্ণ মন্দির অংশটি অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে জবরদখল, অবৈধ পরিবর্তন, পরিবর্তন ও ধ্বংসের শিকার ভবনটি। সম্প্রতি ভবনটির একটি ঝুলবারান্দা ধসে পড়েছে। এটি দেখভাল করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা) আফরোজা খান মিতা বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি। কিন্তু এটি আমাদের দখলে নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত