Ajker Patrika

কড়াইল বস্তিতে আল আমিন হত্যার নেপথ্যে কমিটি ও চাঁদাবাজি, গ্রেপ্তার ৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১৬: ২৪
কড়াইল বস্তিতে আল আমিন হত্যার নেপথ্যে কমিটি ও চাঁদাবাজি, গ্রেপ্তার ৫

রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে ৪০ হাজার অবৈধ ঘর রয়েছে। এসব ঘর থেকে ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির আলাদা আলাদা টাকা তোলা হয়। পাশাপাশি এসি, ফ্রিজ চালাতেও টাকা দেওয়া লাগে। আর এই টাকা সরকারি কোষাগারে না গিয়ে চলে যায় নিয়ন্ত্রণ করা মধ্যস্বত্বভোগী একটি গ্রুপের কাছে।

মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাদের খান ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল মফিজুর রহমান গ্রুপের মধ্যে এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেই যুবলীগের কর্মী আল আমিন খুন হন। খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ এসব তথ্য জানতে পেরেছে।

আজ বৃহস্পতিবার যুবলীগের কর্মী হত্যায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার এবং ঘটনার তদন্ত নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির প্রধান মোহাম্মাদ হারুন অর রশীদ।

হারুন অর রশীদ বলেন, কড়াইল বস্তিতে কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন বিষয়ে চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। আলামিন হত্যায় পাঁচজনকে ২২ ও ২৩ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

আলামিন হত্যায় জড়িত গ্রেপ্তার পাঁচজন হলেন মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল ও মাসুদ আলম। মারামারির কাজে ব্যবহৃত বড় ছোরা, চাপাতি ও ডিস্ক কুড়াল, লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রধান জানান, কড়াইল বস্তির বিভিন্ন ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের মাধ্যমে বস্তির ঘরভাড়াসহ অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ, গ্যাস ও পানির বিলের টাকা আদায় নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট রাতে বস্তির এরশাদ মাঠ ও নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু-কবির-আলী গংয়ের সঙ্গে রিপন-জুয়েল-শুভ গংয়ের মারামারির ঘটনায় আলামিন মারা যায়। এ ছাড়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং আরও অনেকে আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।

কড়াইল বস্তি এলাকার রিকশা শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পোশাকশ্রমিকসহ নিম্নজীবী মানুষ বসবাস করে। মূলত টিঅ্যান্ডটি, গণপূর্ত, ওয়াসা ইত্যাদি সরকারি সেবা সংস্থার জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার ঘর। এসব ঘর অবৈধভাবে নির্মাণ, বরাদ্দ ও হস্তান্তরে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। ঘরগুলোতে অবৈধভাবে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া ডিশ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ময়লা বাণিজ্য প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও টাকা তোলা হয়। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় এই চাঁদার টাকা তোলে এবং ভাগ-বাঁটোয়ারা করে।

ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, দুটি গ্রুপ এই চাঁদাবাজি করে থাকে। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় প্রতিবছর খুনোখুনি হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

যেভাবে দ্বন্দ্বের শুরু
কড়াইল বস্তি মূলত ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত, যার ৯০ শতাংশ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মধ্যে। মফিজুর রহমান এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কড়াইল বস্তির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুটি গ্রুপের বিবাদ চলে আসছে। গত ২২ জুলাই সাতটি ইউনিটের কমিটি হয়। সেগুলো হলো কড়াইল উত্তর-১, কড়াইল উত্তর-২, কড়াইল বউবাজার-পূর্ব, কড়াইল বউবাজার-পশ্চিম, কড়াইল-মশার বাজার, কড়াইল-গোডাউন বস্তি এবং কড়াইল-স্যাটেলাইট ইউনিট। আওয়ামী লীগ এই সাত কমিটির বেশির ভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাদের খানের গ্রুপের প্রাধান্য পাওয়ায় স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধু একটি ইউনিটের সভাপতি এবং আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে। বাকিরা অন্য গ্রুপের।

ডিবি জানায়, নুর আলম নুরু কড়াইল উত্তর-২/ দক্ষিণ ইউনিটের সহসভাপতি হওয়ায় এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে এবং মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

দীর্ঘদিন যাবৎ স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে নিয়মিত মহড়া দিতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু-আলী-কবির গ্রুপের মহড়ার একপর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে। অল্প সময়ের মধ্যে উভয় গ্রুপের লোকজন দল ভারী করে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এশার নামাজ চলাকালে নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাইস্তা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়াকালীন রিপন-জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদের প্রথমে জিআই পাইপ এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে হাত ভাঙাসহ মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম করে। 

নুরুর নেতৃত্বে ভাইগনা আলী, মোহাম্মদ আলী, কবির, আজিজুল, খাজা, আমজাদ গং আরও হিংস্র হয়ে একাধিক ঘর ও দোকানও ভাঙচুর করে। নুরু ও কবির ছোরা ও চাপাতি নিয়ে আলামিন ও নাসিরকে হত্যার উদ্দেশ্যেই কুপিয়ে জখম করে। নাসির ও আলামিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদের আক্রমণ করে।

গুরুতর আহত আলামিন প্রথমে ভাঙারির দোকান এবং পরে এরশাদ মাঠের একটি ফার্মেসির দোকানে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাওয়ালাকে মারধর করে। এ সময় খাজা ও আমজাদ এসে আলামিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরে রিকশাওয়ালা সামনে একটি রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল পেয়ে তড়িঘড়ি করে আলামিনকে তুলে দিয়ে প্রথমে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে আলামিন মারা যায়। উভয় পক্ষের নাসির, নুরুসহ প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হন। 

চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ
লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজির এই নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফিরে ফিরে একের পর এক সহিংসতা ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে কড়াইল বস্তিতে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা/সংযোগের অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে নিহত হয় রাশেদ কাজী নামে একজন পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালে আলামিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরও একাধিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনা ঘটেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত