Ajker Patrika

পুরান ঢাকার ক্রীড়া ও সংস্কৃতির আঁতুরঘরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

  • জরাজীর্ণ ভবন, কার্যক্রম বন্ধ
  • নেই তরুণ সদস্য বা দরকারি অর্থায়ন
  • একাংশ বন্ধ রাজনৈতিক পরিবর্তনে
শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
Thumbnail image
রাজধানীর মতিঝিলের আরামবাগ এলাকায় অবস্থিত একসময়ের নামকরা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব নানা কারণে জৌলুশ হারিয়েছে। ক্লাবের বন্ধ মূল ফটকের সামনে রাখা হয়েছে বস্তাবন্দী পরিত্যক্ত মালামাল। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ধারঘেঁষা জনপদ ফরাসি বণিকদের স্মৃতিবাহী ফরাশগঞ্জ। এখানকার মোহিনী মোহন দাস লেনে পুরোনো জীর্ণ একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে, নাম ‘মঙ্গলাবাস’। শতবর্ষী এই বাড়ির প্রধান ফটকে বড় করে লেখা ‘মুক্তি খেলাঘর আসর’। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আরেকটি পুরোনো ভবনের অংশ। সেখানে ‘মুক্তি খেলাঘর আসর’ নামে আরেকটি সাইনবোর্ড। দৃশ্যত ক্লাবটি সেখানেই। তবে দরজা তালাবদ্ধ। দেখে মনে হয় অনেক দিন খোলা হয়নি। ভবনের সামনে ফুটবল খেলছে কয়েক কিশোর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্বাধীনতার কিছুদিন পরে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুক্তি খেলাঘর আসর’ নামের ক্লাবটি। এর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা। ভবনের পাশেই এখনো আছে ক্লাবের মাঠ। কেবল নেই কোনো কার্যক্রম! মো. রাকিব হোসেন নামের একজনের সঙ্গে কথা হলো। রাকিব হোসেন জানালেন, তিনি ক্লাবের সদস্যসচিব। ৬৫ বছর ধরে তাঁদের কয়েক প্রজন্ম এ এলাকাটিতে থাকেন। নিজে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ক্লাবটি দেখে আসছেন। রাকিব হোসেন বললেন, এমনিতেই নানা কারণে ক্লাবের কার্যক্রম বলতে তেমন কিছু ছিল না। আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এর কমিটি মোটেই সক্রিয় নেই। সবকিছু মিলে কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ আছে।

‘মুক্তি খেলাঘর আসর’ বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম নয়। পুরান ঢাকাসহ গোটা রাজধানীতেই অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াবিষয়ক ক্লাব ছিল, যা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। কিছু ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে।

‘মুক্তি খেলাঘর আসর’ ক্লাবের সুদিনের কথা জানিয়ে রাকিব হোসেন বলেন, ‘একসময় এখানে গান, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছিল। সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত মানুষের সমাগম হতো ক্লাবে। এখন সব বন্ধ।’

সমস্যার কারণ প্রসঙ্গে রাকিব হোসেন বলেন, তরুণ কর্মীর অভাব রয়েছে। ক্লাব পরিচালনার জন্য আর্থিক অনুদানও পাওয়া কঠিন। তবে তাঁর প্রত্যাশা, মুক্তি খেলাঘর আসর আবার প্রাণ ফিরে পাবে। তাঁরা যে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, পরবর্তী প্রজন্মও সেরকম পরিবেশে মানুষ হবে।

সূত্রাপুরের সুকলাল দাস লেনে রয়েছে কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাব। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করা সংগঠনটির অবস্থা এখন শোচনীয়। ক্লাবের কলাপসিবল গেট (কেঁচি গেট) বন্ধ। ভেতরে অন্ধকার। বাইরে থেকে দেখা গেল এলোমেলোভাবে রাখা আসবাব। একপাশে একটা ধুলো পড়া ক্যারম বোর্ড। এদিক-ওদিক তাকাতে এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন। সাংবাদিক পরিচয় জেনে ব্যস্ত হয়ে গেটের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার বন্ধ করে দিলেন। বৃদ্ধ বললেন, ক্লাবের কেউ এখন নেই। সরকার পরিবর্তনের পরে কাজকর্ম সব বন্ধ।

কয়েকজন স্থানীয় প্রবীণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কাগজীটোলা সোশ্যাল ক্লাবের কার্যক্রম বলতে তেমন কিছু নেই। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীকালে সেখানে নিছক আড্ডা বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতো। সরকার পরিবর্তনের পরে এখন একেবারেই বন্ধ।

সূত্রাপুরেরই রূপচান লেনের একটা পুরোনো বাড়িতে রয়েছে ‘মাহফুজ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার’। বেশ পুরোনো সাইনবোর্ডের রং চটে গেছে। সাইনবোর্ড না থাকলে ভবনের বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে একটি ক্লাব ও পাঠাগার আছে। বাড়িটির দুটো তলায় মানুষের বসবাসের চিহ্ন দেখা গেল। বাড়ির একটিমাত্র কক্ষে এখন ঠাঁই পাঠাগারটির। এলাকার একজন জানালেন, ক্লাবের লোকজনেরা সন্ধ্যায় আসেন। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আর কিছু জানেন না তাঁরা।

সমাজসেবা কিংবা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলাকে এগিয়ে নিতে পুরান ঢাকার বিভিন্ন পঞ্চায়েতপ্রধানরা নানা ক্লাবের গোড়াপত্তন করেছিলেন। বিভিন্ন উৎসবের আয়োজনও করা হতো এমন এলাকাভিত্তিক ক্লাবগুলো থেকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পঞ্চায়েতপ্রধান সরদার পিয়ার বখশ নিজে নাটকের সংগঠন ‘সবজী মহল ড্রামাটিক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরান ঢাকাবিষয়ক গবেষক নুরুদ্দীন ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘পিয়ার বখশ ছিলেন একজন আলোচিত মঞ্চশিল্পী। তিনি তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে খোলাচত্বরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে নাটক করতেন।’

একসময় পঞ্চায়েত সরদাররা ছিলেন পুরান ঢাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রে। পঞ্চায়েতব্যবস্থা হারিয়ে যাওয়াও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর ক্ষয়িষ্ণুতার অন্যতম কারণ।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা সুব্রত কুমার দাসের দুই মেয়ে নাচ শেখে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক শিক্ষায়তন বুলবুল ললিত কলা একাডেমিতে (বাফা)। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, ‘পুরান ঢাকার ঐতিহ্যগুলো আর থাকছে না। আমাদের তারুণ্যে ক্লাবভিত্তিক যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পাড়ায় পাড়ায় দেখেছি, তা আর নেই। এখনকার কিশোর-তরুণেরা অতটা আগ্রহী নয় এসবে। তাদের আগ্রহ মূলত মোবাইল ফোন ও অন্যান্য গ্যাজেটের দিকে। পরিচর্যার অভাবে, নাকি সময়ের অনিবার্য পরিবর্তনে ক্লাব-সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত