Ajker Patrika

আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়

আকিফ গালিব
আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়

বছর কুড়ি আগেও প্রতিটি শৈশবে উঁকি দিলে একটি নাম খুব পরিচিত তিনি সুকুমার রায়। শৈশবের পাঠে সুকুমার নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। শিশুদের সুখপাঠ্য ছড়া লিখে অতি সহজেই সুকুমার রায় প্রতিটি শিশুমনে স্থান দখল করে আছেন। শিশুদের ছাড়িয়ে তাঁর লেখা বড়দের মনেও বিশেষ ভালো লাগার সৃষ্টি করে। তাঁর লেখা পড়লে পাঠের দোলা থেকে যায় অনেকক্ষণ। সুকুমার রায়ের পারিবারিক পরিবেশ তাঁর সাহিত্য সাধনার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অল্প বয়স থেকেই পিতার সাহচর্যে মুখে মুখে ছড়া রচনা করতেন তিনি। তা ছাড়া ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, নাটক রচনা বিবিধ গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, রম্যরচনাকার, নাট্যকার। কিন্তু তার আঁকা নিয়ে খুব কম আলোচনা চোখে পড়ে কিংবা তাঁর লেখার কাছে আঁকা হেরে গেছে। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় প্রশিক্ষিত শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর রায়ের আঁকা দক্ষ চোখেও ত্রুটি শনাক্ত করা প্রায় কঠিন। সুকুমার রায়ও পিতার মতো প্রশিক্ষিত শিল্পী নন, তাঁর আঁকায় জায়গায় জায়গায় ত্রুটি, ভুল রেখা অদক্ষ চোখেই ধরা দেয়। তবুও, তার আঁকার নিজস্ব শৈলী রয়েছে যা তার সাহিত্য থেকে তার কল্পনাপ্রসূত চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছে। কার্টুন না হলেও সুকুমার রায়ের ছবি যেন কার্টুনের দোসর। আবোল তাবোলের রামগরুদের ছানা, কুমড়োপটাশ, কাঠবুড়ো কিংবা হিজিবিজবিজের ছবি দেখে ছেলে-বুড়ো সবাই হাসবে। সুকুমার কার্টুন এঁকেছেন দু-একটা, তলায় মজাদার ছড়া।

সুকুমার রায়ের সেরা কাজ বললেই সবাই আবোল তাবোলের নাম করবেন জানি। ছড়ায় উদ্ভট (অ্যাবসারড) ও আপাত অর্থহীনতার (ননসেন্স) মধ্য দিয়ে রসসৃষ্টির কৃতিত্বে সুকুমার রায়ের জুড়ি নেই। আবোল তাবোলে সেই কৃতিত্ব সমধিক উজ্জ্বল। আবোল তাবোলে থাকা ৪৫টি ছড়ার মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা এত বেশি যেকোনো এক প্রকার শ্রেণিতে এদের বাঁধা যায় না। তেমনি এই ছড়াগুলোয় ব্যবহৃত ইলাস্ট্রেশনও বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার দেখা মেলে শুধু হাস্যরসের আধার নয়। ছড়া ও ছবিগুলোর মধ্যে যে রসদ লুকিয়ে আছে, তা সন্ধান না করতে পারলে সুকুমার পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আপাত অর্থের আড়ালে সুকুমার যত্নে বপন করেছেন একাধিক গভীর বিষয়ে নিয়ে নানান কথা। ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়া ও ছবিগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থগুলো সন্ধান করতে গিয়ে কতগুলো বিভাগে ভাগ করতে পারা যায়—  (১) সামাজিক, (২) রাজনৈতিক, (৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, (৪) গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি ও (৫) অন্যান্য।

নোটবই কবিতার জিজ্ঞাসু ভদ্রলোকটির যে চিত্র আঁকা হয়েছে সন্ধানী গবেষক চরিত্রেরই রকমফের। খুড়োর কল-এর চিত্র দেখলে যে কেউ হেসে উঠবে কিন্তু ছবিটা যতটা হাসির তার চেয়ে মানুষের লুব্ধতার প্রতি কশাঘাত! ব্রিটিশ শাসনের কালে ‘একুশে আইন’ আর ‘বাবুরাম সাপুড়ে-র ছবি কি বিশেষ তাৎপর্যময় চিত্রকর্ম নয়? ‘সৎপাত্র, হাতুড়ে কবিতার ডাক্তার, কাতুকুতু বুড়ো-র আঁকা চিত্রকর্ম হাত-গণনা কবিতার জ্যোতিষীর যে ছবি কবি এঁকেছেন আমরা সব সময়ই চারপাশে দেখছি? বুড়ীর বাড়ী কবিতায় হতদরিদ্র বৃদ্ধার জীর্ণ যে ছবিটি অবহেলিত মানুষের প্রতি সুখী-সমাজ এবং তথাকথিত কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য সূচিত করে।

অনেকে মনে করেন হৃষীকেশ মুখার্জি পরিচালিত, অমল পালেকর-উৎপল দত্ত অভিনীত সেই ‘গোলমাল’ ছবিটিতে উৎপল দত্ত মনে করতেন, ‘গোঁফ’ হচ্ছে পৌরুষের প্রতীক আর যে পুরুষ মানুষ গোঁফ কাটতে পারে, সে এত নিষ্ঠুর যে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা বোধ করবে না! কী অদ্ভুত ধারণা, তাই না! নিজের পৌরুষ যে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিশাল গোঁফ-জোড়া নয়, এ কথা বোঝাতে তাঁর পরিবার-পরিজনের খুব কষ্ট হয়েছিল। সম্ভবত, হৃষীকেশ-এর অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন সুকুমারের ‘গোঁফ-চুরি’ কবিতার নায়ক—হেড অফিসের বড়বাবু! সুকুমার রায়ের আঁকার মতোই গোঁফ ছিল উৎপল দত্তের। সুকুমার রায়ের ইলাস্ট্রেশনে নতুন কিছু প্রাণী বাঙালি জনজীবনে জুড়ে গেছে যেমন হারুদের অফিসের ট্যাঁশ গরু যে আদতে গরু নয় পাখি, বেচারাথেরিয়াম, চিল্লানসোরাস, গোমড়ামুখো: গোমড়াথেরিয়াম, ল্যাগব্যাগর্নিস অদ্ভুত নামের এসব পশুপাখির ইলাস্ট্রেশন দেখে দেখে বাঙালির মননে এসব প্রাণী বাস্তবতা পেয়েছে। সুকুমার রায়ে অনন্য হ য ব র ল নিয়ে কথা না বললে এই লেখা পূর্ণতা পাবে না। হযবরল লেখার মতোই চিত্রকর্মেও অন্যতম।

হ য ব র ল গল্পের অসংখ্য চরিত্রের একজন গণিতবিদ কাক-শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। সুকুমার রায়ের আঁকায় দেখা যায় কাকের হাতে ধরা আছে স্লেট, মুখে চকখড়ি, সিরিয়াস মুখে সেটা ধরে আছে এক হাত নাকি পায়ে? নিচে ঝুলছে দলিল-দস্তাবেজ। ৪১ নম্বর গেছোবাজার, কাগেয়াপটির এই কাকেরা সব ধরনের হিসাবি ও বেহিসাবি, খুচরা ও পাইকারি—সব গণনার কাজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে থাকে। এই বর্ণনার সঙ্গে যেন এই আঁকাটা না হলে সেটা অসম্পূর্ণই থেকে যেত। এক ঘরোয়া আলোচনায় একজন নামকরা চিত্রশিল্পী বলেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও জিনগতভাবে সুকুমার রায় আঁকা পেয়েছিলেন ফলে তাঁর আঁকায় জীবন ছিল। রিয়েলিস্টিক আঁকতেই তিনি ভালোবাসতেন কারণ আঁকায় বিশ্বাসযোগ্যতা আনা। আদতেই সুকুমার রায়ের ইলাস্ট্রেশনগুলো দেখতে বোঝা যায়, সেই কথার সত্যতা। হ য ব র ল-এর সেই ফিচেল বিড়াল, যা কিনা সুকুমার সমগ্র বইয়ের প্রচ্ছদে এসে সব বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে ঢুকে গেছে। সেটার এক চোখ টেপা বাঁকা হাসি যেন সুকুমারের গোটা সাহিত্যের মূল মেজাজটাই ধরে বসে আছে।

‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃশ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু—কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।’ হ য ব র ল-তে লিখেছিলেন সুকুমার। ‘পাগলা দাশু-র যে চিত্র সুকুমারের আঁকায় পাই, তা যেমন চরিত্রকে প্রদর্শিত করে তেমনি মিথে পরিণত হওয়া ‘দ্রিঘাংচু’; চন্দ্রবিন্দু, শ্রীকাকেশ্বর কুচকুচে, উদো আর বুদো, হিজিবিজবিজ, ব্যাকরণ শিং, বি. এ. খাদ্যবিশারদ, ন্যাড়া হ য ব র ল-এর চরিত্রগুলো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে যাচাই করলে দেখবেন কোনটিই কাল্পনিক নয়, এমনকি ১০০ বছর আগের নয়, সমসাময়িক। অতএব, বোধ প্রয়োগ করলেই বোঝা যাবে সুকুমার রায় ব্যক্তিটি; আঁকায় ও লেখায় ‘ননসেন্স’ শব্দটির বিকল্প মানে তৈরি করেছিলেন। আর তাই হয়তো এত বছর পরেও গুঞ্জন শুনি কবীর সুমনের সুরে-‘আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়/আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত