সাজ্জাদ বকুল
বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে শক্তিশালী লেখক হিসেবে সুবিদিত হাসান আজিজুল হক করতেন শিক্ষকতা—প্রথমে বিভিন্ন কলেজে, পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, দর্শন বিভাগে। শিক্ষকতার পেশায় থেকে অনেকেই লেখালেখি করে থাকেন। তবে হাসান আজিজুল হকের লেখালেখি যে নিতান্ত শখের বশে নয়, তা যাঁরা তাঁর লেখা পাঠ করেছেন বা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন। প্রায় এক যুগ তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখে, ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আমারও তা কিছুটা হৃদয়ঙ্গম হয়েছে।
হাসান আজিজুল হক একজন সমাজ-সচেতন লেখক, বিবেকবান, প্রতিবাদী মানুষ। মানুষের দুঃখ, বেদনা, সংগ্রাম, বঞ্চনা, বৈষম্য, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের ওপর শাসকদের শোষণ-পীড়ন তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছে। এসবের শৈল্পিক প্রতিবাদ করতেই তিনি কলম হাতে তুলে নিয়েছেন। তাঁর এমন ক্ষোভের আগুন থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘শকুন’-এর মতো বাংলা ছোটগল্প-জগতের বাঁক বদলকারী গল্পের। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সামরিক অপশাসনের প্রতিবাদ হিসেবে তিনি এই গল্প রচনা করেন।
দেশভাগের মতো রাজনীতিবিদদের স্বার্থতাড়িত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তপ্রসূত ঘটনার বিয়োগান্ত পরিণতিতে ক্ষুব্ধ হাসান আজিজুল হক লেখক-জীবনের প্রায় শুরুতে লিখেছেন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মতো কালজয়ী গল্প, শেষ দিকে এসে লিখেছেন ‘আগুনপাখি’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস।
হাসান আজিজুল হককে পাঠ করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, তাঁর লেখালেখি আসলে বিবেকের দায় থেকে। সেই দায় বিপন্ন, দুস্থ মানুষের দুর্দশার কথা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়। সেই দায় তিনি শুধু তাঁর লেখালেখি দিয়ে মেটাতে চেষ্টা করেননি। একই সঙ্গে তিনি সক্রিয় থেকেছেন মাঠে।
যখনই মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সমাজ কলুষিত হয়েছে, হাসান আজিজুল হক মাঠে নেমেছেন—সাহিত্যের মাঠে যেমন, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামের মাঠেও। নানা সংগঠন, সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অন্যদের ডাকে সাড়া দিয়ে যেমন, তেমন নিজে থেকেও এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন। তিনি এমন একজন লেখক, যিনি একদিকে বিবেকের দায়বোধ থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন, অন্যদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে তাঁর বক্তব্য আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, অনেকের কাছে হয়তো তাঁর লেখাসেভাবে পৌঁছায়নি।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটা দেশভাগের নির্মম বাস্তবতার শিকার হয়ে পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। এরপর কিছুকাল খুলনায় কাটিয়ে চলে আসেন উত্তরের জেলা রাজশাহীতে। জীবনের প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি বাস করেছেন শিক্ষানগরীখ্যাত এই জেলা শহরে।
হাসান আজিজুল হক এই দীর্ঘ সময়ে রাজশাহীর নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকেছেন। কখনো সংগীত, কখনো আবৃত্তি, কখনো চলচ্চিত্র, কখনো নাটক। শিল্প-সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এখানে তিনি শুধুই অংশগ্রহণকারী থাকেননি বা নিছক মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে এসব করেননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়েছেন সংগঠক। এখানেই অন্য অনেক লেখকের চেয়ে তিনি আলাদা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সহযোদ্ধা অনেকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। এমন কয়েকজন হলেন হাসান আজিজুল হকের প্রায় সমবয়সী রাবির অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক-চিন্তক সনৎ কুমার সাহা, বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কবি চৌধুরী জুলফিকার মতিন, বিভাগে হাসান আজিজুল হকের শিক্ষার্থী ও পরে সহকর্মী অধ্যাপক এস এম আবু বকর, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় ভৌমিক প্রমুখ।
তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, হাসান আজিজুল হক স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন গুণী শিক্ষক, যেমন আলী আনোয়ার, বজলুল মোবিন চৌধুরী, শহীদুর রহমান, গুণী কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে মিলে ক্যাম্পাসে নাট্যচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। সে সময় থিয়েটার ওয়ার্কশপ আয়োজন, নাট্য রচনা, বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও সেসবের মঞ্চায়নসহ নাটক নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডের ফলে রাবিতে নাটক বিষয়ে অনেক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে, যার মধ্যে অনুশীলনসহ কয়েকটি এখনো সক্রিয়।
নাজিম মাহমুদ প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বনন’-এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, বলা যায় তিনিই ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ‘স্বনন’ নামটিও তাঁর দেওয়া। ক্যাম্পাসে সংগীতবিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডেও হাসান আজিজুল হকের অনুপ্রেরণা, অংশগ্রহণ ছিল। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় ও রাজশাহী শাখার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। এই সংগঠনের রাজশাহী শাখার সাবেক সভাপতি তাপস মজুমদারের তথ্যমতে, রাজশাহীতে তাঁরা ‘রবীন্দ্রমেলা’সহ নানা আয়োজন করলে হাসান আজিজুল হক নানাভাবে যুক্ত থাকতেন, অনুষ্ঠানের খরচের জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড়ে তিনিই ছিলেন মূল ভরসা।
রাজশাহী শহরে কবিকুঞ্জ বলে কবিদের একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। তিনি এই সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন বলে জানান এর সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক কুমার। প্রতিবছর তাঁরা ‘জীবনানন্দ কবিতামেলা’ বলে যে আন্তর্জাতিক কবিতা-উৎসবের আয়োজন করে আসছেন, তাতে আমৃত্যু যুক্ত থেকেছেন হাসান আজিজুল হক, একাধিক মেলা উদ্বোধন করেছেন। এ ছাড়া
রাজশাহী শহরে ‘ইলা মিত্র শিল্পী সংঘ’, ‘খেলাঘর আসর’সহ নানা সংগঠনে তিনি নানাভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন।
২০০১ সালের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অনুপ্রেরণায় ‘বাংলাদেশ চর্চা পাঠচক্র’ নামে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন জন্ম নেয়, মৃত্যুর আগপর্যন্ত যার প্রতিটি আসরে সভাপতিত্ব করেছেন হাসান আজিজুল হক। ২০১০-১১ সাল থেকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। মাঝেমধ্যে কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়লে আমাকে তাড়া দিয়েছেন এটিকে আবার বাঁচিয়ে তোলার জন্য।
আমি ২০১১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করি, আমৃত্যু যার উপদেষ্টা ছিলেন হাসান আজিজুল হক। আমাদের চলচ্চিত্রবিষয়ক সব বড় অনুষ্ঠানে তাঁকে পেয়েছি। রাজশাহী শহরে ‘ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ’, ‘রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি’সহ অন্য চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ।
রাজশাহীতে ২০১৮ সালে ‘উপহার’ সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়ার সময় এটি চালু রাখার দাবিতে আমরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, তাতে হলের সামনে আমাদের অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে উৎসাহ দিয়েছেন। মিঞাপাড়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পারিবারিক যে ভিটেটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের আড়ালে দখল করা হয়েছে, সেটি উদ্ধারের আন্দোলনেও হাসান স্যার আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথিক কলেজে ঋত্বিক ঘটকের নামে করা মিলনায়তনের উদ্বোধকও হাসান আজিজুল হক।
১৯৯২ সালে রাজশাহীতে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র যে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয় তাতে আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্বে থেকে অন্যদের সাহস জুগিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। এই
কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক এস এম আবু বকর এই সংগঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হাসান আজিজুল হকের সাহসী পদক্ষেপের যে বিবরণ আমাকে সম্প্রতি শোনালেন, তা ছোটগল্পের রাজপুত্র হিসেবে পরিচিত এই কথাশিল্পীর সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বোধের আরেকটি দিক উন্মোচিত করে।
এভাবে কত সংগঠনের সঙ্গে যে তাঁর নানারকম যোগ ছিল তা খতিয়ে দেখতে গেলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। এই স্বল্প পরিসরের লেখায় সব তুলে আনা গেল না। সবশেষে বলা যায়, হাসান আজিজুল হক কিংবদন্তি কথাশিল্পীর পরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে শক্তিশালী লেখক হিসেবে সুবিদিত হাসান আজিজুল হক করতেন শিক্ষকতা—প্রথমে বিভিন্ন কলেজে, পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, দর্শন বিভাগে। শিক্ষকতার পেশায় থেকে অনেকেই লেখালেখি করে থাকেন। তবে হাসান আজিজুল হকের লেখালেখি যে নিতান্ত শখের বশে নয়, তা যাঁরা তাঁর লেখা পাঠ করেছেন বা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন। প্রায় এক যুগ তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখে, ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আমারও তা কিছুটা হৃদয়ঙ্গম হয়েছে।
হাসান আজিজুল হক একজন সমাজ-সচেতন লেখক, বিবেকবান, প্রতিবাদী মানুষ। মানুষের দুঃখ, বেদনা, সংগ্রাম, বঞ্চনা, বৈষম্য, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের ওপর শাসকদের শোষণ-পীড়ন তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছে। এসবের শৈল্পিক প্রতিবাদ করতেই তিনি কলম হাতে তুলে নিয়েছেন। তাঁর এমন ক্ষোভের আগুন থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘শকুন’-এর মতো বাংলা ছোটগল্প-জগতের বাঁক বদলকারী গল্পের। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সামরিক অপশাসনের প্রতিবাদ হিসেবে তিনি এই গল্প রচনা করেন।
দেশভাগের মতো রাজনীতিবিদদের স্বার্থতাড়িত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তপ্রসূত ঘটনার বিয়োগান্ত পরিণতিতে ক্ষুব্ধ হাসান আজিজুল হক লেখক-জীবনের প্রায় শুরুতে লিখেছেন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মতো কালজয়ী গল্প, শেষ দিকে এসে লিখেছেন ‘আগুনপাখি’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস।
হাসান আজিজুল হককে পাঠ করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, তাঁর লেখালেখি আসলে বিবেকের দায় থেকে। সেই দায় বিপন্ন, দুস্থ মানুষের দুর্দশার কথা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়। সেই দায় তিনি শুধু তাঁর লেখালেখি দিয়ে মেটাতে চেষ্টা করেননি। একই সঙ্গে তিনি সক্রিয় থেকেছেন মাঠে।
যখনই মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সমাজ কলুষিত হয়েছে, হাসান আজিজুল হক মাঠে নেমেছেন—সাহিত্যের মাঠে যেমন, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামের মাঠেও। নানা সংগঠন, সভা-সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অন্যদের ডাকে সাড়া দিয়ে যেমন, তেমন নিজে থেকেও এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন। তিনি এমন একজন লেখক, যিনি একদিকে বিবেকের দায়বোধ থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন, অন্যদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকে তাঁর বক্তব্য আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, অনেকের কাছে হয়তো তাঁর লেখাসেভাবে পৌঁছায়নি।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটা দেশভাগের নির্মম বাস্তবতার শিকার হয়ে পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। এরপর কিছুকাল খুলনায় কাটিয়ে চলে আসেন উত্তরের জেলা রাজশাহীতে। জীবনের প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি বাস করেছেন শিক্ষানগরীখ্যাত এই জেলা শহরে।
হাসান আজিজুল হক এই দীর্ঘ সময়ে রাজশাহীর নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থেকেছেন। কখনো সংগীত, কখনো আবৃত্তি, কখনো চলচ্চিত্র, কখনো নাটক। শিল্প-সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এখানে তিনি শুধুই অংশগ্রহণকারী থাকেননি বা নিছক মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে এসব করেননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়েছেন সংগঠক। এখানেই অন্য অনেক লেখকের চেয়ে তিনি আলাদা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সহযোদ্ধা অনেকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। এমন কয়েকজন হলেন হাসান আজিজুল হকের প্রায় সমবয়সী রাবির অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক-চিন্তক সনৎ কুমার সাহা, বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কবি চৌধুরী জুলফিকার মতিন, বিভাগে হাসান আজিজুল হকের শিক্ষার্থী ও পরে সহকর্মী অধ্যাপক এস এম আবু বকর, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় ভৌমিক প্রমুখ।
তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, হাসান আজিজুল হক স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন গুণী শিক্ষক, যেমন আলী আনোয়ার, বজলুল মোবিন চৌধুরী, শহীদুর রহমান, গুণী কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে মিলে ক্যাম্পাসে নাট্যচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। সে সময় থিয়েটার ওয়ার্কশপ আয়োজন, নাট্য রচনা, বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও সেসবের মঞ্চায়নসহ নাটক নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডের ফলে রাবিতে নাটক বিষয়ে অনেক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে, যার মধ্যে অনুশীলনসহ কয়েকটি এখনো সক্রিয়।
নাজিম মাহমুদ প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বনন’-এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, বলা যায় তিনিই ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ‘স্বনন’ নামটিও তাঁর দেওয়া। ক্যাম্পাসে সংগীতবিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডেও হাসান আজিজুল হকের অনুপ্রেরণা, অংশগ্রহণ ছিল। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় ও রাজশাহী শাখার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। এই সংগঠনের রাজশাহী শাখার সাবেক সভাপতি তাপস মজুমদারের তথ্যমতে, রাজশাহীতে তাঁরা ‘রবীন্দ্রমেলা’সহ নানা আয়োজন করলে হাসান আজিজুল হক নানাভাবে যুক্ত থাকতেন, অনুষ্ঠানের খরচের জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড়ে তিনিই ছিলেন মূল ভরসা।
রাজশাহী শহরে কবিকুঞ্জ বলে কবিদের একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। তিনি এই সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন বলে জানান এর সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক কুমার। প্রতিবছর তাঁরা ‘জীবনানন্দ কবিতামেলা’ বলে যে আন্তর্জাতিক কবিতা-উৎসবের আয়োজন করে আসছেন, তাতে আমৃত্যু যুক্ত থেকেছেন হাসান আজিজুল হক, একাধিক মেলা উদ্বোধন করেছেন। এ ছাড়া
রাজশাহী শহরে ‘ইলা মিত্র শিল্পী সংঘ’, ‘খেলাঘর আসর’সহ নানা সংগঠনে তিনি নানাভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন।
২০০১ সালের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অনুপ্রেরণায় ‘বাংলাদেশ চর্চা পাঠচক্র’ নামে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন জন্ম নেয়, মৃত্যুর আগপর্যন্ত যার প্রতিটি আসরে সভাপতিত্ব করেছেন হাসান আজিজুল হক। ২০১০-১১ সাল থেকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। মাঝেমধ্যে কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়লে আমাকে তাড়া দিয়েছেন এটিকে আবার বাঁচিয়ে তোলার জন্য।
আমি ২০১১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করি, আমৃত্যু যার উপদেষ্টা ছিলেন হাসান আজিজুল হক। আমাদের চলচ্চিত্রবিষয়ক সব বড় অনুষ্ঠানে তাঁকে পেয়েছি। রাজশাহী শহরে ‘ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ’, ‘রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি’সহ অন্য চলচ্চিত্র সংসদগুলোর কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ।
রাজশাহীতে ২০১৮ সালে ‘উপহার’ সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়ার সময় এটি চালু রাখার দাবিতে আমরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, তাতে হলের সামনে আমাদের অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে উৎসাহ দিয়েছেন। মিঞাপাড়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পারিবারিক যে ভিটেটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের আড়ালে দখল করা হয়েছে, সেটি উদ্ধারের আন্দোলনেও হাসান স্যার আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথিক কলেজে ঋত্বিক ঘটকের নামে করা মিলনায়তনের উদ্বোধকও হাসান আজিজুল হক।
১৯৯২ সালে রাজশাহীতে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র যে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয় তাতে আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্বে থেকে অন্যদের সাহস জুগিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। এই
কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক এস এম আবু বকর এই সংগঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হাসান আজিজুল হকের সাহসী পদক্ষেপের যে বিবরণ আমাকে সম্প্রতি শোনালেন, তা ছোটগল্পের রাজপুত্র হিসেবে পরিচিত এই কথাশিল্পীর সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বোধের আরেকটি দিক উন্মোচিত করে।
এভাবে কত সংগঠনের সঙ্গে যে তাঁর নানারকম যোগ ছিল তা খতিয়ে দেখতে গেলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। এই স্বল্প পরিসরের লেখায় সব তুলে আনা গেল না। সবশেষে বলা যায়, হাসান আজিজুল হক কিংবদন্তি কথাশিল্পীর পরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
‘ও তোর মনের মানুষ এলে দ্বারে, মন যখন জাগলি না রে’ অথবা, ‘এবার তোর মারা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’ গানগুলো শুনলে মনে হয় এ যেন কোনো বাউল প্রাণেরই আর্তনাদ। অথচ এ গান কোনো আখড়াই বা গৃহবাউলের গান নয়। এ গান এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পুত্রের, এ গান রবি ঠাকুরের, রবি বাউলের।
৪ দিন আগেরবীন্দ্রনাথই তো শিশুতীর্থ কবিতায় একদা লিখেছিলেন, ‘ভয় নেই ভাই, মানবকে মহান বলে জেনো!’ পরক্ষণেই বলেছেন, ‘পশুশক্তিই আদ্যাশক্তি পশুশক্তিই শাশ্বত!’ বলেছেন, ‘সাধুতা তলে তলে আত্মপ্রবঞ্চক!’
৪ দিন আগেজার্মানিতে নির্বাসিত বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি দাউদ হায়দার বার্লিনের শ্যোনেবের্গ ক্লিনিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টায় (বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ১টায়) তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। কবি বার্লিনের...
১৫ দিন আগেধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে আগামীকাল শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে আলোকচিত্রী সাংবাদিক, গবেষক সাহাদাত পারভেজ সম্পাদিত ‘আলোকচিত্রপুরাণ’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ।
১৮ দিন আগে