ইমু হাসান

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জাহাজে ওঠার জন্য। তাঁর মতে, এই দীর্ঘ সময় জাহাজে বসে থেকে ক্লান্ত না হয়ে ঝটিকা সফরে আর কিছু না হোক, অন্তত পিরামিডটা দেখে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় আর ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরে একটা নতুন সভ্যতা তো দেখা হবে! ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউরোপে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। খুঁজতে থাকলাম চলতি পথে আর কোথায় ঢু মারা যায়, কোন বিমানে গেলে কোথায় ট্রানজিট; কেননা এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝঞ্ঝাট। বিশেষত, বাড়তি সময় ও বিমানভাড়ার কোনো ঝক্কি নেই। পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকল ইস্তাম্বুল। সেই একই ভাবনা, আর কিছু না হোক শেষ বিকেলের আলোয় বসফরাসের পাড়ে বসে এক বেলা হাওয়া তো খাওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, শুরু করলাম খোঁজখবর নেওয়া। বিদেশে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে থাকে তা হলো, ভিসা পাব তো? খোঁজ নিয়ে জানলাম সেনজেন ভিসা থাকলে তুরস্কের অন অ্যারাইভাল ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না, তবুও বাড়তি সাবধানতা হিসেবে আর সময় বাঁচাতে অন অ্যারাইভাল ভিসার আশায় না থেকে আগেই ই-ভিসা করে নিলাম। ভিসা ফি পড়ল বাংলা টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা মাত্র। হিসাব করে দেখলাম, এর বাইরে এক রাত থাকতে ২-৩ হাজার টাকা আর পেটেভাতে ঘুরতে ৩-৪ হাজার টাকা, সর্বমোট ১০-১৫ হাজার টাকায় একটা নতুন দেশ দেখা যাবে। আর যায় কই? এ তো ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার চেয়েও সস্তা! শেষ ধাপ হিসেবে ইউরোপ যাওয়ার সময় টার্কিশ এয়ারের টিকিট কাটলাম ফেরার পথে ইস্তাম্বুলে এক রাত দেড় দিনের ট্রানজিটসহ।
ইউরোপে আমার শেষ স্টপেজ ছিল রোম। একদম সকালের ফ্লাইট, ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। এদিকে রোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যায় রাত ১১টার দিকে (একটু কমবেশি হতে পারে, স্পষ্ট মনে নেই)। বিকল্প আছে ট্যাক্সি, যাতে খরচ পড়বে প্রায় ৫০ ইউরো! আমার পুরো ইস্তাম্বুল ট্রিপের বাজেটের সমান!! রোমের বন্ধুদের যাবতীয় অনুরোধ ও মায়া উপেক্ষা করে শেষ মেট্রো ধরে এয়ারপোর্টে চলে এসে একটা ট্রলিতে আমার যাবতীয় মালামাল চাপিয়ে দুই-তিনটা সিট জুড়ে ঝিমাতে ঝিমাতে হেডফোনে গান শুনছিলাম আর ব্রাউজ করে ইস্তাম্বুল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জড়ো করছিলাম। কিন্তু কোথায় হোটেল নেব বুঝতে পারছিলাম না। ইস্তাম্বুল চেনা দূরে থাক, আগে ইস্তাম্বুল গেছে এমন কাউকে চিনিও না। হঠাৎ চোখে পড়ল ইসিলের মেসেজ। তুর্কি ড্যান্স কোরিওগ্রাফার ইসিলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ব্রাসেলস যাওয়ার পথে, প্লেনে। দিন দুয়েক আগে তাকে মেসেঞ্জারে নক করে লিখেছিলাম, ‘আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে যাব বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া আর দু চুমুক কফির আশায়। কোন এলাকায় হোটেলে উঠলে আমার মনের বাসনা সহজে পূরণ হবে জানালে কৃতার্থ হই।’ এত স্বল্প পরিচয়ে মেসেজ পাঠাতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল। তারপরও সাত-পাঁচ ভেবে পাঠানো মেসেজের জবাব যে একদম সময়মতো পেয়ে যাব, তা কল্পনাতেও ছিল না। তার মেসেজ দেখে হালে পানি পেলাম বলে মনে হলো। চট করে মাথায় আরেকটা বুদ্ধি চলে এলো, দেড় দিনের জন্য ইস্তাম্বুল গিয়ে হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট করার কী দরকার? অনলাইনে বুক করে নিলেই তো হয়! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, বোর্ডিং আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। প্রাণসখা সেবা চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমি প্লেনে উঠে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি কারাকৈ বা এর আশপাশের কোনো হোটেল বুক করে আমাকে ঠিকানাটা যেন পাঠায় (আমার যে সিম তা তুরস্কে কাজ করবে না, তাই ঠিকানাটা ফ্লাই করার আগেই জরুরি ভিত্তিতে দরকার)। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেবা জানাল, একটা হোটেল মোটামুটি পছন্দ হয়েছে কিন্তু পেমেন্টে জটিলতা হচ্ছে, তাই কনফার্ম করা যাচ্ছে না। আপাতত আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছে আর সে ভাইয়ার (আমার বড় ভাই) সঙ্গে সমন্বয় করে তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে রুম কনফার্ম করার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, তবে তা-ই হোক, আগে তো যাই।
ই-ভিসা দেখিয়ে পাসপোর্টে এন্ট্রান্স সিল লাগিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বুক ভরে একটা জোরে নিশ্বাস নিলাম, আহ ইস্তাম্বুল, আহ তুরস্ক! অটোমান, বাইজেন্টাইনের কেন্দ্রভূমি! নানান জাতি-ধর্মের মিলনমেলা! মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগল, কখন হোটেলে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা রেখে ছুটে যাব বসফরাসের পাড়ে, সময় তো মাত্র দেড় দিন! কারাকৈর কোনো সরাসরি বাস না থাকায় আলি আহমেদ হামিদগামী একটা বাসে চেপে বসলাম। পথে একটা জায়গায় নেমে বাস চেঞ্জ করতে হবে, ১৮ লিরা ভাড়া। বগল বাজাতে বাজাতে বাসে চেপে বসলাম (হোটেলের পিক সার্ভিস চেয়েছিল ৫০ ইউরো!! এর কম মনে হয় তারা গুনতে পারে না)।
তুমুল স্পিডে বাস চলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক। মাত্র দেড় দিনের সফর। আমার হাঁ করে শহর দেখার কথা কিন্তু সেদিকে আমার নজর নেই। আমার টেনশন জায়গামতো বাস থেকে নামতে পারব তো? বাসে কোনো হেলপার নেই, পথের পাশের সাইনবোর্ড বেশির ভাগই টার্কিশ ভাষায় লেখা, যা দু-একটা ইংরেজি শব্দ চোখে পড়ে, তা-ও পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় বাসের গতির কারণে। একটু পর পর উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি, আমার স্টপেজ কখন আসবে? ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে, সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধো। আমি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর করুণ ইশারায় ড্রাইভারকে বোঝাতে চাইলাম, ভাই, আমার দেশে বাসে সিটবেল্টের বালাই নেই, উপরন্তু হ্যান্ডেলের সঙ্গে ঝোলানো বেল্টে ঝুলে ঝুলে আমরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিই, আমার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, আছে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তুমি আমাকে তোমার পাশের হেলপারের সিটে বসতে দাও আর জায়গামতো নামিয়ে দাও। কে শোনে কার কথা! তার গরম চক্ষু সইতে না পেরে সিটে গিয়ে বেল্ট বেঁধে টুকটাক আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা সবাই আলি আহমেদ নামবে। উসখুস করতে করতে অবশেষে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামলাম (নামটা ভুলে গেছি)। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম। কোথায় পাই বদলি বাস, কোনদিকেই বা যাই? একটু ধাতস্থ হয়ে দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কারাকৈ এখান থেকে কমবেশি এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, মেট্রোর একটা স্টপেজ সামনে। হেঁটে গেলে সামনে যে দুটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয়টা পেরোলেই পৌঁছে যাব। যখন শুনলাম ব্রিজগুলো বসফরাসের বুকে, আমার আর মেট্রোতে উঠতে ইচ্ছে করল না। আমার ধারণা ছিল, শহর থেকে বাসে করে বসফরাসে যেতে হবে (আমার দৌড় তো সাগর/সমুদ্র মানে বঙ্গোপসাগর), কিন্তু এভাবে যে সাগরের বুকজুড়ে শহর গড়ে উঠেছে বা শহরের অলিগলির মতো যে সাগর থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অনেক বাইরে ছিল। ভাবলাম, ঘুরতেই যখন এসেছি, বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে হেঁটে হেঁটে চলে যাই। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ট্রলি টেনে শুরু করলাম হাঁটা। কিছু পথচারীর পিছু পিছু একটা জেব্রা ক্রসিং খুঁজে নিয়ে পথ রাস্তা পেরিয়ে ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই নাকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। মনে হলো আরেকটু এগিয়ে গেলেই কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তটা পেয়ে যাব। ভাবতে ভাবতে ব্রিজে উঠে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার দশা। সারি সারি লোক ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাগরের বাতাস খেতে খেতে সাগরে ছিপ ফেলে টপাটপ মাছ তুলছে। পানির দেশের লোক আমি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমার অতিপরিচিত দৃশ্য। কিন্তু সাগরের ওপরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক-দেড় শ ফুট নিচে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আমার কল্পনাকেও হার মানায়। কেউ যদি প্রশ্ন করে উচ্চতা মেপেছি কি না, তাহলেই আমি ধরা। তবে ব্রিজের নিচ দিয়ে যে বহুতল জাহাজগুলো যাচ্ছিল, সেগুলো এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তা দেখে মনে মনে ভেবে নিলাম উচ্চতা এক-দেড় শ ফুট তো হবেই হবে। মনে পড়ে গেল সেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথা, যাদের হাতে এখানে মানব বসতির সূত্রপাত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে (ইন্টারনেট থেকে পাওয়া জ্ঞান)।
বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে ব্রিজ পার হয়ে মনে হলো এইবার কোন দিকে? চারদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, তা ছাড়া কে যে ভালো আর কে যে বাটপার, তা-ও তো বোঝার উপায় নেই। সাধারণত মধ্যবয়স্ক মানুষ, যারা ফ্যামিলি নিয়ে বের হয়েছে, তারা নিরাপদ হয় কিন্তু এমন কাউকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে দুই তরুণকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞাসা করা যায়। আমার বাড়ানো ঠিকানা দেখে তারা নিজেদের মাঝে কিছুক্ষণ আলাপ করে অবশেষে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তারপর হাসিমুখে বলল, আমি হোটেলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে। খুশিমনে তাদের দেখানো পথে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু হোটেল আর পাই না। আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাড়া নেই। আরও একজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোচ্ছি, হোটেল তো পাই না! বাঁ পাশের রাস্তাগুলো ঢাল বেয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে! মনে মনে প্রমাদ গুনছি, এই বাক্স-প্যাটরা টেনে না আবার ওই পাহাড়ে উঠতে হয়। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন বলল, এই বাঁ পাশের রাস্তা ধরে সেজা ওপরে উঠে যাও, পেলেও পেতে পারো। খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে রাস্তা। অগত্যা মধুসূদন! বাক্স-প্যাটরা টেনে ওপরে উঠে শুনি, এই পথে না, আমার হোটেল সামনের ঢালে। পরের ঢালে উঠে শুনি, এই ঢালেও না, সামনের ঢালে হতে পারে! নেমে এলাম। টার্কিশ সিম নেওয়া হয়নি, তাই গুগল ম্যাপও কাজ করছে না! পথের আশপাশে অনেক হোটেল আছে কিন্তু নেহাত অনলাইনে হোটেল বুক করে পেমেন্ট করা আছে তাই টাকার মায়ায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজতে লাগলাম, পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে করে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি কী বলি তারা বোঝে না, আমিও তাদের উচ্চারণ ধরতে পারি না। ঘুরপাক খেতে খেতে মনে হলো পথচারীদের জিজ্ঞাসা না করে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করা ভালো। প্রথম যে দোকানটা পেলাম তাতে জিজ্ঞাসা করতেই দোকানি বেশ গম্ভীরভাবে বলল—সামনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত সামনে? এক রাস্তা, নাকি ডান-বাম আছে? আরও গম্ভীর হয়ে সে হাত তুলে আমার প্রশ্নবাণ থামিয়ে বলল, প্রথম উত্তরটা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। এখন থেকে প্রতি প্রশ্নের জন্য চার্জ ৫ লিরা। একটু হোঁচট খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক কষ্টে গম্ভীর করে রাখা মুখের ওপরে হাসি হাসি চোখ! সাথে সাথেই আমার অবচেতন মন আমাকে সিগন্যাল দিল, এই লোকের ওপর ভরসা করা যায়। তার হাত ধরে যা বললাম, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়, ‘ভাই মারলেও তুমি, রাখলেও তুমি, আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে এসে দেড় ঘণ্টা ধরে হোটেল খুঁজছি।’ ওই ভদ্রলোক তারপর আমাকে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন, আর আমি তিন মিনিটের মধ্যে হোটেল পেয়ে গেলাম। ছিমছাম ছোট এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল, ঢুকতেই রিসিপশনে বসা তরুণী হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। নাম বলে আমার রুমের কথা বলতেই তারা জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট সম্পন্ন না হওয়ায় আমার বুকিং বাতিল হয়ে গেছে, তবে আমার কপাল ভালো যে তাদের একটা রুম এখনো খালি আছে, আমি চাইলে সেটা নিতে পারি। হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইন্টারনেটে কানেক্ট হতেই দেখি সেবার বেশ কিছু মেসেজ, কার্ডে ঝামেলার কারণে পেমেন্ট করা যায়নি। রিসিপশনিস্টের কোনো কথাই আর কানে ঢুকছিল না। স্ক্রিনের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, চোখে ভাসতে লাগল টাকার মায়ায় দেড়/দুই ঘণ্টা ধরে বাক্স-প্যাটরা টেনে টেনে পেরোনো পথ—পাহাড়ের ঢাল আর পথের দুই পাশের হোটেলের সারি।
জিনিসপত্র রুমবন্দী করে একটা জম্পেশ শাওয়ার দিয়েই ছুট লাগালাম নিচে। হোটেলের রিসিপশনিস্টের দেওয়া ম্যাপ আর বর্ণনা ভরসা করে ৫ মিনিটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বসফরাসের জেটিতে। ২০ লিরা দিয়ে ট্যুরিস্ট লঞ্চের টিকেট কেটে জেটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে, চাইলে এদিক-সেদিক ঘুরে আসা যেত কিন্তু পথ হারানোর ভয়ে কোথাও না গিয়ে জেটিতে বসেই মানুষ দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরা লোকের ভিড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রিটফুড বিক্রেতাদের আনাগোনা। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে আমাদের কত রকম ফর্মালিটি পোহাতে হয়, আর এখানে দিনের কাজ শেষে ভিসা- পাসপোর্ট ছাড়াই দলে দলে লোকে ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ এশিয়া থেকে ইউরোপে ফিরছে! একটা শহর দুটি মহাদেশ! ইস্তাম্বুল সম্ভবত গ্লোবাল ম্যাপের একমাত্র শহর, যার একটা পাশ পড়েছে এশিয়ায়, আরেকটা ইউরোপে।
দিনের আলো কমে আসার সাথে সাথে বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপ। যেখানে দিনের বেলায় আমি ক্রমাগত ঘামছিলাম, সেখানে সন্ধ্যা হওয়ার পর আমি পর্যাপ্ত শীতের কাপড়, টুপি, দস্তানা এগুলো পরেও কাঁপতে লাগলাম। কনকনে শীতের মধ্যেও আমি বাইরে বেরিয়ে ডকে দাঁড়ালাম। সাধের বসফরাস বলে কথা! এক কাপ ধূমায়িত কফি হাতে বন্ধু-স্বজনদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতে না পারার আফসোস বুকে চেপে শিপের রেলিং ধরে দুচোখ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম বসফরাস। পাশে বেশ কয়েকটা গ্রুপ হুল্লোড় করছে আর আমার বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তার ওপর নুনের ছিটার মতো দু-একটি গ্রুপ আবার আমাকে দিয়ে তাদের গ্রুপ ছবিও তুলিয়ে নিল। ছবি তোলার ফাঁকে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার বসফরাসেই মগ্ন হলাম। লঞ্চ চলছে, দুই ধারে নানা রঙের আলোয় ঝলমল করছে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আর বর্তমান স্থাপত্যগুলো। একেকটা করে বিশেষ স্থাপনা পার হচ্ছে আর মাইকে কয়েকটি ভাষায় তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ সেদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখি, এটা ফলো করতে গেলে দেখা হয় না, আবার দেখতে গেলে ধারাবিবরণী খেয়াল করা হয় না।
আমি নামধাম বোঝার চেয়ে চারদিকের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম আর কল্পনার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিলাম সময়ের উলটোরথে। এই তো বসফরাস, বাইজেন্টাইন-অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম রক্ষক ও ভৌগোলিক গুরুত্বের চিহ্ন-চাবিকাঠি। আমি ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম ইস্তাম্বুল থেকে কনস্টান্টিনোপল, অটোমান থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে। সেখানে দেখা হলো কত কত সম্রাট আর সুলতান, জেনোইস (বাইজেন্টাইনদের বিশেষ বাহিনী), জানিসারিসের (অটোমানদের বিশেষ বাহিনী) সাথে; ওই তো গোল্ডেন হর্ন, এখানেই তো আলাদা হয়েছে কৃষ্ণসাগর থেকে মারমারা সাগর। এই গোল্ডেন হর্নেই ছিল বাইজেন্টাইনদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যার কারণে শত্রুরা স্থলপথে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান শহর কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) অবরোধ করে থাকলেও সহজেই তারা বসফরাস দিয়ে রসদ সংগ্রহ করতে পারত। ফলে কোনো অবরোধই সহজে তাদের কাবু করতে পারত না। অটোমান সুলতান মাহমুদ বিষয়টা বিশ্লেষণ করে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থল ও জল উভয় পথে একসঙ্গে অবরোধ করার জন্য। কিন্তু তার মাঝারি পাল্লার কামানসমেত নৌবাহিনী গোল্ডেন হর্নের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ভারী কামানগুলোর সামনে টিকতেই পারছিল না। অবরোধের ব্যপ্তি বাড়ছিল কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। তখন তারা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করল। পোতাশ্রয়ের পেছনের পাহাড়গুলোর বুকে রাতের আঁধারে রাস্তা তৈরি করে তাতে গাছ-তেল চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে সন্তর্পণে সাগর থেকে জাহাজগুলো সে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে টেনে পাহাড় ডিঙিয়ে পোতাশ্রয়ে নিয়ে আসে। সকালে দেখা যায় এখন আমি যেখানে লঞ্চে ঘুরছি, গোল্ডেন হর্ন আর কনস্টান্টিনোপলের মধ্যবর্তী সেই বসফরাস পোতাশ্রয়ে বীরদর্পে ভাসছে ৭০টা অটোমান যুদ্ধজাহাজ। তারপর অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল দখল করে তাকে ইস্তাম্বুল বানানো ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এভাবেই এখানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতি টেনে সূত্রপাত হয়েছিল অটোমানদের আমল। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে আচমকা একটা ঝাঁকি লেগে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমাদের জাহাজ গোল্ডেন হর্ন চক্কর দিয়ে জেটিতে এসে ভিড়েছে, এ তারই ঝাঁকুনি।
জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই হঠাৎ রণবাদ্য শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে হঠাৎ এক কিশোর এসে ছোট এক ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র তুমুল তালে বাজাতে শুরু করেছে। আধুনিককালে আমরা যে ব্যান্ড মিউজিক শুনি, তার সূচনার অন্যতম সূতিকাগার কিন্তু অটোমানদের রণসংগীত। সব ট্যুরিস্টের সাথে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে মনে জাবর কাটতে কাটতে অজানা সে কিশোরের অপূর্ব বাজনা উপভোগ করতে লাগলাম। মনে মনে একটা ভাবও চলে এল, আগের দিনে সুলতানরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে যেমন ঢাকঢোল-বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে আওয়াজ দিত, অনেকটা ওই রকম ভাব নিয়েই সেই তালে তালে সম্পন্ন করে ফেললাম আমার বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে হাওয়া খাওয়ার খায়েশ।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জাহাজে ওঠার জন্য। তাঁর মতে, এই দীর্ঘ সময় জাহাজে বসে থেকে ক্লান্ত না হয়ে ঝটিকা সফরে আর কিছু না হোক, অন্তত পিরামিডটা দেখে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় আর ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরে একটা নতুন সভ্যতা তো দেখা হবে! ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউরোপে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। খুঁজতে থাকলাম চলতি পথে আর কোথায় ঢু মারা যায়, কোন বিমানে গেলে কোথায় ট্রানজিট; কেননা এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝঞ্ঝাট। বিশেষত, বাড়তি সময় ও বিমানভাড়ার কোনো ঝক্কি নেই। পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকল ইস্তাম্বুল। সেই একই ভাবনা, আর কিছু না হোক শেষ বিকেলের আলোয় বসফরাসের পাড়ে বসে এক বেলা হাওয়া তো খাওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, শুরু করলাম খোঁজখবর নেওয়া। বিদেশে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে থাকে তা হলো, ভিসা পাব তো? খোঁজ নিয়ে জানলাম সেনজেন ভিসা থাকলে তুরস্কের অন অ্যারাইভাল ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না, তবুও বাড়তি সাবধানতা হিসেবে আর সময় বাঁচাতে অন অ্যারাইভাল ভিসার আশায় না থেকে আগেই ই-ভিসা করে নিলাম। ভিসা ফি পড়ল বাংলা টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা মাত্র। হিসাব করে দেখলাম, এর বাইরে এক রাত থাকতে ২-৩ হাজার টাকা আর পেটেভাতে ঘুরতে ৩-৪ হাজার টাকা, সর্বমোট ১০-১৫ হাজার টাকায় একটা নতুন দেশ দেখা যাবে। আর যায় কই? এ তো ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার চেয়েও সস্তা! শেষ ধাপ হিসেবে ইউরোপ যাওয়ার সময় টার্কিশ এয়ারের টিকিট কাটলাম ফেরার পথে ইস্তাম্বুলে এক রাত দেড় দিনের ট্রানজিটসহ।
ইউরোপে আমার শেষ স্টপেজ ছিল রোম। একদম সকালের ফ্লাইট, ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। এদিকে রোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যায় রাত ১১টার দিকে (একটু কমবেশি হতে পারে, স্পষ্ট মনে নেই)। বিকল্প আছে ট্যাক্সি, যাতে খরচ পড়বে প্রায় ৫০ ইউরো! আমার পুরো ইস্তাম্বুল ট্রিপের বাজেটের সমান!! রোমের বন্ধুদের যাবতীয় অনুরোধ ও মায়া উপেক্ষা করে শেষ মেট্রো ধরে এয়ারপোর্টে চলে এসে একটা ট্রলিতে আমার যাবতীয় মালামাল চাপিয়ে দুই-তিনটা সিট জুড়ে ঝিমাতে ঝিমাতে হেডফোনে গান শুনছিলাম আর ব্রাউজ করে ইস্তাম্বুল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জড়ো করছিলাম। কিন্তু কোথায় হোটেল নেব বুঝতে পারছিলাম না। ইস্তাম্বুল চেনা দূরে থাক, আগে ইস্তাম্বুল গেছে এমন কাউকে চিনিও না। হঠাৎ চোখে পড়ল ইসিলের মেসেজ। তুর্কি ড্যান্স কোরিওগ্রাফার ইসিলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ব্রাসেলস যাওয়ার পথে, প্লেনে। দিন দুয়েক আগে তাকে মেসেঞ্জারে নক করে লিখেছিলাম, ‘আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে যাব বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া আর দু চুমুক কফির আশায়। কোন এলাকায় হোটেলে উঠলে আমার মনের বাসনা সহজে পূরণ হবে জানালে কৃতার্থ হই।’ এত স্বল্প পরিচয়ে মেসেজ পাঠাতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল। তারপরও সাত-পাঁচ ভেবে পাঠানো মেসেজের জবাব যে একদম সময়মতো পেয়ে যাব, তা কল্পনাতেও ছিল না। তার মেসেজ দেখে হালে পানি পেলাম বলে মনে হলো। চট করে মাথায় আরেকটা বুদ্ধি চলে এলো, দেড় দিনের জন্য ইস্তাম্বুল গিয়ে হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট করার কী দরকার? অনলাইনে বুক করে নিলেই তো হয়! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, বোর্ডিং আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। প্রাণসখা সেবা চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমি প্লেনে উঠে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি কারাকৈ বা এর আশপাশের কোনো হোটেল বুক করে আমাকে ঠিকানাটা যেন পাঠায় (আমার যে সিম তা তুরস্কে কাজ করবে না, তাই ঠিকানাটা ফ্লাই করার আগেই জরুরি ভিত্তিতে দরকার)। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেবা জানাল, একটা হোটেল মোটামুটি পছন্দ হয়েছে কিন্তু পেমেন্টে জটিলতা হচ্ছে, তাই কনফার্ম করা যাচ্ছে না। আপাতত আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছে আর সে ভাইয়ার (আমার বড় ভাই) সঙ্গে সমন্বয় করে তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে রুম কনফার্ম করার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, তবে তা-ই হোক, আগে তো যাই।
ই-ভিসা দেখিয়ে পাসপোর্টে এন্ট্রান্স সিল লাগিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বুক ভরে একটা জোরে নিশ্বাস নিলাম, আহ ইস্তাম্বুল, আহ তুরস্ক! অটোমান, বাইজেন্টাইনের কেন্দ্রভূমি! নানান জাতি-ধর্মের মিলনমেলা! মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগল, কখন হোটেলে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা রেখে ছুটে যাব বসফরাসের পাড়ে, সময় তো মাত্র দেড় দিন! কারাকৈর কোনো সরাসরি বাস না থাকায় আলি আহমেদ হামিদগামী একটা বাসে চেপে বসলাম। পথে একটা জায়গায় নেমে বাস চেঞ্জ করতে হবে, ১৮ লিরা ভাড়া। বগল বাজাতে বাজাতে বাসে চেপে বসলাম (হোটেলের পিক সার্ভিস চেয়েছিল ৫০ ইউরো!! এর কম মনে হয় তারা গুনতে পারে না)।
তুমুল স্পিডে বাস চলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক। মাত্র দেড় দিনের সফর। আমার হাঁ করে শহর দেখার কথা কিন্তু সেদিকে আমার নজর নেই। আমার টেনশন জায়গামতো বাস থেকে নামতে পারব তো? বাসে কোনো হেলপার নেই, পথের পাশের সাইনবোর্ড বেশির ভাগই টার্কিশ ভাষায় লেখা, যা দু-একটা ইংরেজি শব্দ চোখে পড়ে, তা-ও পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় বাসের গতির কারণে। একটু পর পর উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি, আমার স্টপেজ কখন আসবে? ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে, সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধো। আমি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর করুণ ইশারায় ড্রাইভারকে বোঝাতে চাইলাম, ভাই, আমার দেশে বাসে সিটবেল্টের বালাই নেই, উপরন্তু হ্যান্ডেলের সঙ্গে ঝোলানো বেল্টে ঝুলে ঝুলে আমরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিই, আমার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, আছে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তুমি আমাকে তোমার পাশের হেলপারের সিটে বসতে দাও আর জায়গামতো নামিয়ে দাও। কে শোনে কার কথা! তার গরম চক্ষু সইতে না পেরে সিটে গিয়ে বেল্ট বেঁধে টুকটাক আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা সবাই আলি আহমেদ নামবে। উসখুস করতে করতে অবশেষে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামলাম (নামটা ভুলে গেছি)। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম। কোথায় পাই বদলি বাস, কোনদিকেই বা যাই? একটু ধাতস্থ হয়ে দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কারাকৈ এখান থেকে কমবেশি এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, মেট্রোর একটা স্টপেজ সামনে। হেঁটে গেলে সামনে যে দুটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয়টা পেরোলেই পৌঁছে যাব। যখন শুনলাম ব্রিজগুলো বসফরাসের বুকে, আমার আর মেট্রোতে উঠতে ইচ্ছে করল না। আমার ধারণা ছিল, শহর থেকে বাসে করে বসফরাসে যেতে হবে (আমার দৌড় তো সাগর/সমুদ্র মানে বঙ্গোপসাগর), কিন্তু এভাবে যে সাগরের বুকজুড়ে শহর গড়ে উঠেছে বা শহরের অলিগলির মতো যে সাগর থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অনেক বাইরে ছিল। ভাবলাম, ঘুরতেই যখন এসেছি, বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে হেঁটে হেঁটে চলে যাই। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ট্রলি টেনে শুরু করলাম হাঁটা। কিছু পথচারীর পিছু পিছু একটা জেব্রা ক্রসিং খুঁজে নিয়ে পথ রাস্তা পেরিয়ে ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই নাকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। মনে হলো আরেকটু এগিয়ে গেলেই কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তটা পেয়ে যাব। ভাবতে ভাবতে ব্রিজে উঠে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার দশা। সারি সারি লোক ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাগরের বাতাস খেতে খেতে সাগরে ছিপ ফেলে টপাটপ মাছ তুলছে। পানির দেশের লোক আমি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমার অতিপরিচিত দৃশ্য। কিন্তু সাগরের ওপরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক-দেড় শ ফুট নিচে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আমার কল্পনাকেও হার মানায়। কেউ যদি প্রশ্ন করে উচ্চতা মেপেছি কি না, তাহলেই আমি ধরা। তবে ব্রিজের নিচ দিয়ে যে বহুতল জাহাজগুলো যাচ্ছিল, সেগুলো এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তা দেখে মনে মনে ভেবে নিলাম উচ্চতা এক-দেড় শ ফুট তো হবেই হবে। মনে পড়ে গেল সেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথা, যাদের হাতে এখানে মানব বসতির সূত্রপাত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে (ইন্টারনেট থেকে পাওয়া জ্ঞান)।
বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে ব্রিজ পার হয়ে মনে হলো এইবার কোন দিকে? চারদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, তা ছাড়া কে যে ভালো আর কে যে বাটপার, তা-ও তো বোঝার উপায় নেই। সাধারণত মধ্যবয়স্ক মানুষ, যারা ফ্যামিলি নিয়ে বের হয়েছে, তারা নিরাপদ হয় কিন্তু এমন কাউকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে দুই তরুণকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞাসা করা যায়। আমার বাড়ানো ঠিকানা দেখে তারা নিজেদের মাঝে কিছুক্ষণ আলাপ করে অবশেষে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তারপর হাসিমুখে বলল, আমি হোটেলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে। খুশিমনে তাদের দেখানো পথে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু হোটেল আর পাই না। আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাড়া নেই। আরও একজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোচ্ছি, হোটেল তো পাই না! বাঁ পাশের রাস্তাগুলো ঢাল বেয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে! মনে মনে প্রমাদ গুনছি, এই বাক্স-প্যাটরা টেনে না আবার ওই পাহাড়ে উঠতে হয়। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন বলল, এই বাঁ পাশের রাস্তা ধরে সেজা ওপরে উঠে যাও, পেলেও পেতে পারো। খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে রাস্তা। অগত্যা মধুসূদন! বাক্স-প্যাটরা টেনে ওপরে উঠে শুনি, এই পথে না, আমার হোটেল সামনের ঢালে। পরের ঢালে উঠে শুনি, এই ঢালেও না, সামনের ঢালে হতে পারে! নেমে এলাম। টার্কিশ সিম নেওয়া হয়নি, তাই গুগল ম্যাপও কাজ করছে না! পথের আশপাশে অনেক হোটেল আছে কিন্তু নেহাত অনলাইনে হোটেল বুক করে পেমেন্ট করা আছে তাই টাকার মায়ায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজতে লাগলাম, পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে করে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি কী বলি তারা বোঝে না, আমিও তাদের উচ্চারণ ধরতে পারি না। ঘুরপাক খেতে খেতে মনে হলো পথচারীদের জিজ্ঞাসা না করে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করা ভালো। প্রথম যে দোকানটা পেলাম তাতে জিজ্ঞাসা করতেই দোকানি বেশ গম্ভীরভাবে বলল—সামনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত সামনে? এক রাস্তা, নাকি ডান-বাম আছে? আরও গম্ভীর হয়ে সে হাত তুলে আমার প্রশ্নবাণ থামিয়ে বলল, প্রথম উত্তরটা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। এখন থেকে প্রতি প্রশ্নের জন্য চার্জ ৫ লিরা। একটু হোঁচট খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক কষ্টে গম্ভীর করে রাখা মুখের ওপরে হাসি হাসি চোখ! সাথে সাথেই আমার অবচেতন মন আমাকে সিগন্যাল দিল, এই লোকের ওপর ভরসা করা যায়। তার হাত ধরে যা বললাম, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়, ‘ভাই মারলেও তুমি, রাখলেও তুমি, আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে এসে দেড় ঘণ্টা ধরে হোটেল খুঁজছি।’ ওই ভদ্রলোক তারপর আমাকে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন, আর আমি তিন মিনিটের মধ্যে হোটেল পেয়ে গেলাম। ছিমছাম ছোট এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল, ঢুকতেই রিসিপশনে বসা তরুণী হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। নাম বলে আমার রুমের কথা বলতেই তারা জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট সম্পন্ন না হওয়ায় আমার বুকিং বাতিল হয়ে গেছে, তবে আমার কপাল ভালো যে তাদের একটা রুম এখনো খালি আছে, আমি চাইলে সেটা নিতে পারি। হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইন্টারনেটে কানেক্ট হতেই দেখি সেবার বেশ কিছু মেসেজ, কার্ডে ঝামেলার কারণে পেমেন্ট করা যায়নি। রিসিপশনিস্টের কোনো কথাই আর কানে ঢুকছিল না। স্ক্রিনের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, চোখে ভাসতে লাগল টাকার মায়ায় দেড়/দুই ঘণ্টা ধরে বাক্স-প্যাটরা টেনে টেনে পেরোনো পথ—পাহাড়ের ঢাল আর পথের দুই পাশের হোটেলের সারি।
জিনিসপত্র রুমবন্দী করে একটা জম্পেশ শাওয়ার দিয়েই ছুট লাগালাম নিচে। হোটেলের রিসিপশনিস্টের দেওয়া ম্যাপ আর বর্ণনা ভরসা করে ৫ মিনিটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বসফরাসের জেটিতে। ২০ লিরা দিয়ে ট্যুরিস্ট লঞ্চের টিকেট কেটে জেটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে, চাইলে এদিক-সেদিক ঘুরে আসা যেত কিন্তু পথ হারানোর ভয়ে কোথাও না গিয়ে জেটিতে বসেই মানুষ দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরা লোকের ভিড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রিটফুড বিক্রেতাদের আনাগোনা। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে আমাদের কত রকম ফর্মালিটি পোহাতে হয়, আর এখানে দিনের কাজ শেষে ভিসা- পাসপোর্ট ছাড়াই দলে দলে লোকে ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ এশিয়া থেকে ইউরোপে ফিরছে! একটা শহর দুটি মহাদেশ! ইস্তাম্বুল সম্ভবত গ্লোবাল ম্যাপের একমাত্র শহর, যার একটা পাশ পড়েছে এশিয়ায়, আরেকটা ইউরোপে।
দিনের আলো কমে আসার সাথে সাথে বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপ। যেখানে দিনের বেলায় আমি ক্রমাগত ঘামছিলাম, সেখানে সন্ধ্যা হওয়ার পর আমি পর্যাপ্ত শীতের কাপড়, টুপি, দস্তানা এগুলো পরেও কাঁপতে লাগলাম। কনকনে শীতের মধ্যেও আমি বাইরে বেরিয়ে ডকে দাঁড়ালাম। সাধের বসফরাস বলে কথা! এক কাপ ধূমায়িত কফি হাতে বন্ধু-স্বজনদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতে না পারার আফসোস বুকে চেপে শিপের রেলিং ধরে দুচোখ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম বসফরাস। পাশে বেশ কয়েকটা গ্রুপ হুল্লোড় করছে আর আমার বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তার ওপর নুনের ছিটার মতো দু-একটি গ্রুপ আবার আমাকে দিয়ে তাদের গ্রুপ ছবিও তুলিয়ে নিল। ছবি তোলার ফাঁকে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার বসফরাসেই মগ্ন হলাম। লঞ্চ চলছে, দুই ধারে নানা রঙের আলোয় ঝলমল করছে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আর বর্তমান স্থাপত্যগুলো। একেকটা করে বিশেষ স্থাপনা পার হচ্ছে আর মাইকে কয়েকটি ভাষায় তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ সেদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখি, এটা ফলো করতে গেলে দেখা হয় না, আবার দেখতে গেলে ধারাবিবরণী খেয়াল করা হয় না।
আমি নামধাম বোঝার চেয়ে চারদিকের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম আর কল্পনার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিলাম সময়ের উলটোরথে। এই তো বসফরাস, বাইজেন্টাইন-অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম রক্ষক ও ভৌগোলিক গুরুত্বের চিহ্ন-চাবিকাঠি। আমি ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম ইস্তাম্বুল থেকে কনস্টান্টিনোপল, অটোমান থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে। সেখানে দেখা হলো কত কত সম্রাট আর সুলতান, জেনোইস (বাইজেন্টাইনদের বিশেষ বাহিনী), জানিসারিসের (অটোমানদের বিশেষ বাহিনী) সাথে; ওই তো গোল্ডেন হর্ন, এখানেই তো আলাদা হয়েছে কৃষ্ণসাগর থেকে মারমারা সাগর। এই গোল্ডেন হর্নেই ছিল বাইজেন্টাইনদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যার কারণে শত্রুরা স্থলপথে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান শহর কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) অবরোধ করে থাকলেও সহজেই তারা বসফরাস দিয়ে রসদ সংগ্রহ করতে পারত। ফলে কোনো অবরোধই সহজে তাদের কাবু করতে পারত না। অটোমান সুলতান মাহমুদ বিষয়টা বিশ্লেষণ করে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থল ও জল উভয় পথে একসঙ্গে অবরোধ করার জন্য। কিন্তু তার মাঝারি পাল্লার কামানসমেত নৌবাহিনী গোল্ডেন হর্নের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ভারী কামানগুলোর সামনে টিকতেই পারছিল না। অবরোধের ব্যপ্তি বাড়ছিল কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। তখন তারা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করল। পোতাশ্রয়ের পেছনের পাহাড়গুলোর বুকে রাতের আঁধারে রাস্তা তৈরি করে তাতে গাছ-তেল চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে সন্তর্পণে সাগর থেকে জাহাজগুলো সে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে টেনে পাহাড় ডিঙিয়ে পোতাশ্রয়ে নিয়ে আসে। সকালে দেখা যায় এখন আমি যেখানে লঞ্চে ঘুরছি, গোল্ডেন হর্ন আর কনস্টান্টিনোপলের মধ্যবর্তী সেই বসফরাস পোতাশ্রয়ে বীরদর্পে ভাসছে ৭০টা অটোমান যুদ্ধজাহাজ। তারপর অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল দখল করে তাকে ইস্তাম্বুল বানানো ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এভাবেই এখানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতি টেনে সূত্রপাত হয়েছিল অটোমানদের আমল। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে আচমকা একটা ঝাঁকি লেগে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমাদের জাহাজ গোল্ডেন হর্ন চক্কর দিয়ে জেটিতে এসে ভিড়েছে, এ তারই ঝাঁকুনি।
জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই হঠাৎ রণবাদ্য শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে হঠাৎ এক কিশোর এসে ছোট এক ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র তুমুল তালে বাজাতে শুরু করেছে। আধুনিককালে আমরা যে ব্যান্ড মিউজিক শুনি, তার সূচনার অন্যতম সূতিকাগার কিন্তু অটোমানদের রণসংগীত। সব ট্যুরিস্টের সাথে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে মনে জাবর কাটতে কাটতে অজানা সে কিশোরের অপূর্ব বাজনা উপভোগ করতে লাগলাম। মনে মনে একটা ভাবও চলে এল, আগের দিনে সুলতানরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে যেমন ঢাকঢোল-বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে আওয়াজ দিত, অনেকটা ওই রকম ভাব নিয়েই সেই তালে তালে সম্পন্ন করে ফেললাম আমার বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে হাওয়া খাওয়ার খায়েশ।
ইমু হাসান

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জাহাজে ওঠার জন্য। তাঁর মতে, এই দীর্ঘ সময় জাহাজে বসে থেকে ক্লান্ত না হয়ে ঝটিকা সফরে আর কিছু না হোক, অন্তত পিরামিডটা দেখে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় আর ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরে একটা নতুন সভ্যতা তো দেখা হবে! ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউরোপে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। খুঁজতে থাকলাম চলতি পথে আর কোথায় ঢু মারা যায়, কোন বিমানে গেলে কোথায় ট্রানজিট; কেননা এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝঞ্ঝাট। বিশেষত, বাড়তি সময় ও বিমানভাড়ার কোনো ঝক্কি নেই। পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকল ইস্তাম্বুল। সেই একই ভাবনা, আর কিছু না হোক শেষ বিকেলের আলোয় বসফরাসের পাড়ে বসে এক বেলা হাওয়া তো খাওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, শুরু করলাম খোঁজখবর নেওয়া। বিদেশে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে থাকে তা হলো, ভিসা পাব তো? খোঁজ নিয়ে জানলাম সেনজেন ভিসা থাকলে তুরস্কের অন অ্যারাইভাল ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না, তবুও বাড়তি সাবধানতা হিসেবে আর সময় বাঁচাতে অন অ্যারাইভাল ভিসার আশায় না থেকে আগেই ই-ভিসা করে নিলাম। ভিসা ফি পড়ল বাংলা টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা মাত্র। হিসাব করে দেখলাম, এর বাইরে এক রাত থাকতে ২-৩ হাজার টাকা আর পেটেভাতে ঘুরতে ৩-৪ হাজার টাকা, সর্বমোট ১০-১৫ হাজার টাকায় একটা নতুন দেশ দেখা যাবে। আর যায় কই? এ তো ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার চেয়েও সস্তা! শেষ ধাপ হিসেবে ইউরোপ যাওয়ার সময় টার্কিশ এয়ারের টিকিট কাটলাম ফেরার পথে ইস্তাম্বুলে এক রাত দেড় দিনের ট্রানজিটসহ।
ইউরোপে আমার শেষ স্টপেজ ছিল রোম। একদম সকালের ফ্লাইট, ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। এদিকে রোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যায় রাত ১১টার দিকে (একটু কমবেশি হতে পারে, স্পষ্ট মনে নেই)। বিকল্প আছে ট্যাক্সি, যাতে খরচ পড়বে প্রায় ৫০ ইউরো! আমার পুরো ইস্তাম্বুল ট্রিপের বাজেটের সমান!! রোমের বন্ধুদের যাবতীয় অনুরোধ ও মায়া উপেক্ষা করে শেষ মেট্রো ধরে এয়ারপোর্টে চলে এসে একটা ট্রলিতে আমার যাবতীয় মালামাল চাপিয়ে দুই-তিনটা সিট জুড়ে ঝিমাতে ঝিমাতে হেডফোনে গান শুনছিলাম আর ব্রাউজ করে ইস্তাম্বুল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জড়ো করছিলাম। কিন্তু কোথায় হোটেল নেব বুঝতে পারছিলাম না। ইস্তাম্বুল চেনা দূরে থাক, আগে ইস্তাম্বুল গেছে এমন কাউকে চিনিও না। হঠাৎ চোখে পড়ল ইসিলের মেসেজ। তুর্কি ড্যান্স কোরিওগ্রাফার ইসিলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ব্রাসেলস যাওয়ার পথে, প্লেনে। দিন দুয়েক আগে তাকে মেসেঞ্জারে নক করে লিখেছিলাম, ‘আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে যাব বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া আর দু চুমুক কফির আশায়। কোন এলাকায় হোটেলে উঠলে আমার মনের বাসনা সহজে পূরণ হবে জানালে কৃতার্থ হই।’ এত স্বল্প পরিচয়ে মেসেজ পাঠাতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল। তারপরও সাত-পাঁচ ভেবে পাঠানো মেসেজের জবাব যে একদম সময়মতো পেয়ে যাব, তা কল্পনাতেও ছিল না। তার মেসেজ দেখে হালে পানি পেলাম বলে মনে হলো। চট করে মাথায় আরেকটা বুদ্ধি চলে এলো, দেড় দিনের জন্য ইস্তাম্বুল গিয়ে হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট করার কী দরকার? অনলাইনে বুক করে নিলেই তো হয়! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, বোর্ডিং আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। প্রাণসখা সেবা চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমি প্লেনে উঠে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি কারাকৈ বা এর আশপাশের কোনো হোটেল বুক করে আমাকে ঠিকানাটা যেন পাঠায় (আমার যে সিম তা তুরস্কে কাজ করবে না, তাই ঠিকানাটা ফ্লাই করার আগেই জরুরি ভিত্তিতে দরকার)। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেবা জানাল, একটা হোটেল মোটামুটি পছন্দ হয়েছে কিন্তু পেমেন্টে জটিলতা হচ্ছে, তাই কনফার্ম করা যাচ্ছে না। আপাতত আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছে আর সে ভাইয়ার (আমার বড় ভাই) সঙ্গে সমন্বয় করে তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে রুম কনফার্ম করার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, তবে তা-ই হোক, আগে তো যাই।
ই-ভিসা দেখিয়ে পাসপোর্টে এন্ট্রান্স সিল লাগিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বুক ভরে একটা জোরে নিশ্বাস নিলাম, আহ ইস্তাম্বুল, আহ তুরস্ক! অটোমান, বাইজেন্টাইনের কেন্দ্রভূমি! নানান জাতি-ধর্মের মিলনমেলা! মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগল, কখন হোটেলে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা রেখে ছুটে যাব বসফরাসের পাড়ে, সময় তো মাত্র দেড় দিন! কারাকৈর কোনো সরাসরি বাস না থাকায় আলি আহমেদ হামিদগামী একটা বাসে চেপে বসলাম। পথে একটা জায়গায় নেমে বাস চেঞ্জ করতে হবে, ১৮ লিরা ভাড়া। বগল বাজাতে বাজাতে বাসে চেপে বসলাম (হোটেলের পিক সার্ভিস চেয়েছিল ৫০ ইউরো!! এর কম মনে হয় তারা গুনতে পারে না)।
তুমুল স্পিডে বাস চলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক। মাত্র দেড় দিনের সফর। আমার হাঁ করে শহর দেখার কথা কিন্তু সেদিকে আমার নজর নেই। আমার টেনশন জায়গামতো বাস থেকে নামতে পারব তো? বাসে কোনো হেলপার নেই, পথের পাশের সাইনবোর্ড বেশির ভাগই টার্কিশ ভাষায় লেখা, যা দু-একটা ইংরেজি শব্দ চোখে পড়ে, তা-ও পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় বাসের গতির কারণে। একটু পর পর উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি, আমার স্টপেজ কখন আসবে? ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে, সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধো। আমি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর করুণ ইশারায় ড্রাইভারকে বোঝাতে চাইলাম, ভাই, আমার দেশে বাসে সিটবেল্টের বালাই নেই, উপরন্তু হ্যান্ডেলের সঙ্গে ঝোলানো বেল্টে ঝুলে ঝুলে আমরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিই, আমার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, আছে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তুমি আমাকে তোমার পাশের হেলপারের সিটে বসতে দাও আর জায়গামতো নামিয়ে দাও। কে শোনে কার কথা! তার গরম চক্ষু সইতে না পেরে সিটে গিয়ে বেল্ট বেঁধে টুকটাক আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা সবাই আলি আহমেদ নামবে। উসখুস করতে করতে অবশেষে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামলাম (নামটা ভুলে গেছি)। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম। কোথায় পাই বদলি বাস, কোনদিকেই বা যাই? একটু ধাতস্থ হয়ে দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কারাকৈ এখান থেকে কমবেশি এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, মেট্রোর একটা স্টপেজ সামনে। হেঁটে গেলে সামনে যে দুটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয়টা পেরোলেই পৌঁছে যাব। যখন শুনলাম ব্রিজগুলো বসফরাসের বুকে, আমার আর মেট্রোতে উঠতে ইচ্ছে করল না। আমার ধারণা ছিল, শহর থেকে বাসে করে বসফরাসে যেতে হবে (আমার দৌড় তো সাগর/সমুদ্র মানে বঙ্গোপসাগর), কিন্তু এভাবে যে সাগরের বুকজুড়ে শহর গড়ে উঠেছে বা শহরের অলিগলির মতো যে সাগর থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অনেক বাইরে ছিল। ভাবলাম, ঘুরতেই যখন এসেছি, বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে হেঁটে হেঁটে চলে যাই। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ট্রলি টেনে শুরু করলাম হাঁটা। কিছু পথচারীর পিছু পিছু একটা জেব্রা ক্রসিং খুঁজে নিয়ে পথ রাস্তা পেরিয়ে ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই নাকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। মনে হলো আরেকটু এগিয়ে গেলেই কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তটা পেয়ে যাব। ভাবতে ভাবতে ব্রিজে উঠে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার দশা। সারি সারি লোক ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাগরের বাতাস খেতে খেতে সাগরে ছিপ ফেলে টপাটপ মাছ তুলছে। পানির দেশের লোক আমি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমার অতিপরিচিত দৃশ্য। কিন্তু সাগরের ওপরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক-দেড় শ ফুট নিচে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আমার কল্পনাকেও হার মানায়। কেউ যদি প্রশ্ন করে উচ্চতা মেপেছি কি না, তাহলেই আমি ধরা। তবে ব্রিজের নিচ দিয়ে যে বহুতল জাহাজগুলো যাচ্ছিল, সেগুলো এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তা দেখে মনে মনে ভেবে নিলাম উচ্চতা এক-দেড় শ ফুট তো হবেই হবে। মনে পড়ে গেল সেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথা, যাদের হাতে এখানে মানব বসতির সূত্রপাত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে (ইন্টারনেট থেকে পাওয়া জ্ঞান)।
বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে ব্রিজ পার হয়ে মনে হলো এইবার কোন দিকে? চারদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, তা ছাড়া কে যে ভালো আর কে যে বাটপার, তা-ও তো বোঝার উপায় নেই। সাধারণত মধ্যবয়স্ক মানুষ, যারা ফ্যামিলি নিয়ে বের হয়েছে, তারা নিরাপদ হয় কিন্তু এমন কাউকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে দুই তরুণকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞাসা করা যায়। আমার বাড়ানো ঠিকানা দেখে তারা নিজেদের মাঝে কিছুক্ষণ আলাপ করে অবশেষে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তারপর হাসিমুখে বলল, আমি হোটেলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে। খুশিমনে তাদের দেখানো পথে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু হোটেল আর পাই না। আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাড়া নেই। আরও একজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোচ্ছি, হোটেল তো পাই না! বাঁ পাশের রাস্তাগুলো ঢাল বেয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে! মনে মনে প্রমাদ গুনছি, এই বাক্স-প্যাটরা টেনে না আবার ওই পাহাড়ে উঠতে হয়। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন বলল, এই বাঁ পাশের রাস্তা ধরে সেজা ওপরে উঠে যাও, পেলেও পেতে পারো। খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে রাস্তা। অগত্যা মধুসূদন! বাক্স-প্যাটরা টেনে ওপরে উঠে শুনি, এই পথে না, আমার হোটেল সামনের ঢালে। পরের ঢালে উঠে শুনি, এই ঢালেও না, সামনের ঢালে হতে পারে! নেমে এলাম। টার্কিশ সিম নেওয়া হয়নি, তাই গুগল ম্যাপও কাজ করছে না! পথের আশপাশে অনেক হোটেল আছে কিন্তু নেহাত অনলাইনে হোটেল বুক করে পেমেন্ট করা আছে তাই টাকার মায়ায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজতে লাগলাম, পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে করে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি কী বলি তারা বোঝে না, আমিও তাদের উচ্চারণ ধরতে পারি না। ঘুরপাক খেতে খেতে মনে হলো পথচারীদের জিজ্ঞাসা না করে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করা ভালো। প্রথম যে দোকানটা পেলাম তাতে জিজ্ঞাসা করতেই দোকানি বেশ গম্ভীরভাবে বলল—সামনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত সামনে? এক রাস্তা, নাকি ডান-বাম আছে? আরও গম্ভীর হয়ে সে হাত তুলে আমার প্রশ্নবাণ থামিয়ে বলল, প্রথম উত্তরটা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। এখন থেকে প্রতি প্রশ্নের জন্য চার্জ ৫ লিরা। একটু হোঁচট খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক কষ্টে গম্ভীর করে রাখা মুখের ওপরে হাসি হাসি চোখ! সাথে সাথেই আমার অবচেতন মন আমাকে সিগন্যাল দিল, এই লোকের ওপর ভরসা করা যায়। তার হাত ধরে যা বললাম, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়, ‘ভাই মারলেও তুমি, রাখলেও তুমি, আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে এসে দেড় ঘণ্টা ধরে হোটেল খুঁজছি।’ ওই ভদ্রলোক তারপর আমাকে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন, আর আমি তিন মিনিটের মধ্যে হোটেল পেয়ে গেলাম। ছিমছাম ছোট এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল, ঢুকতেই রিসিপশনে বসা তরুণী হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। নাম বলে আমার রুমের কথা বলতেই তারা জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট সম্পন্ন না হওয়ায় আমার বুকিং বাতিল হয়ে গেছে, তবে আমার কপাল ভালো যে তাদের একটা রুম এখনো খালি আছে, আমি চাইলে সেটা নিতে পারি। হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইন্টারনেটে কানেক্ট হতেই দেখি সেবার বেশ কিছু মেসেজ, কার্ডে ঝামেলার কারণে পেমেন্ট করা যায়নি। রিসিপশনিস্টের কোনো কথাই আর কানে ঢুকছিল না। স্ক্রিনের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, চোখে ভাসতে লাগল টাকার মায়ায় দেড়/দুই ঘণ্টা ধরে বাক্স-প্যাটরা টেনে টেনে পেরোনো পথ—পাহাড়ের ঢাল আর পথের দুই পাশের হোটেলের সারি।
জিনিসপত্র রুমবন্দী করে একটা জম্পেশ শাওয়ার দিয়েই ছুট লাগালাম নিচে। হোটেলের রিসিপশনিস্টের দেওয়া ম্যাপ আর বর্ণনা ভরসা করে ৫ মিনিটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বসফরাসের জেটিতে। ২০ লিরা দিয়ে ট্যুরিস্ট লঞ্চের টিকেট কেটে জেটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে, চাইলে এদিক-সেদিক ঘুরে আসা যেত কিন্তু পথ হারানোর ভয়ে কোথাও না গিয়ে জেটিতে বসেই মানুষ দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরা লোকের ভিড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রিটফুড বিক্রেতাদের আনাগোনা। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে আমাদের কত রকম ফর্মালিটি পোহাতে হয়, আর এখানে দিনের কাজ শেষে ভিসা- পাসপোর্ট ছাড়াই দলে দলে লোকে ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ এশিয়া থেকে ইউরোপে ফিরছে! একটা শহর দুটি মহাদেশ! ইস্তাম্বুল সম্ভবত গ্লোবাল ম্যাপের একমাত্র শহর, যার একটা পাশ পড়েছে এশিয়ায়, আরেকটা ইউরোপে।
দিনের আলো কমে আসার সাথে সাথে বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপ। যেখানে দিনের বেলায় আমি ক্রমাগত ঘামছিলাম, সেখানে সন্ধ্যা হওয়ার পর আমি পর্যাপ্ত শীতের কাপড়, টুপি, দস্তানা এগুলো পরেও কাঁপতে লাগলাম। কনকনে শীতের মধ্যেও আমি বাইরে বেরিয়ে ডকে দাঁড়ালাম। সাধের বসফরাস বলে কথা! এক কাপ ধূমায়িত কফি হাতে বন্ধু-স্বজনদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতে না পারার আফসোস বুকে চেপে শিপের রেলিং ধরে দুচোখ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম বসফরাস। পাশে বেশ কয়েকটা গ্রুপ হুল্লোড় করছে আর আমার বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তার ওপর নুনের ছিটার মতো দু-একটি গ্রুপ আবার আমাকে দিয়ে তাদের গ্রুপ ছবিও তুলিয়ে নিল। ছবি তোলার ফাঁকে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার বসফরাসেই মগ্ন হলাম। লঞ্চ চলছে, দুই ধারে নানা রঙের আলোয় ঝলমল করছে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আর বর্তমান স্থাপত্যগুলো। একেকটা করে বিশেষ স্থাপনা পার হচ্ছে আর মাইকে কয়েকটি ভাষায় তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ সেদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখি, এটা ফলো করতে গেলে দেখা হয় না, আবার দেখতে গেলে ধারাবিবরণী খেয়াল করা হয় না।
আমি নামধাম বোঝার চেয়ে চারদিকের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম আর কল্পনার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিলাম সময়ের উলটোরথে। এই তো বসফরাস, বাইজেন্টাইন-অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম রক্ষক ও ভৌগোলিক গুরুত্বের চিহ্ন-চাবিকাঠি। আমি ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম ইস্তাম্বুল থেকে কনস্টান্টিনোপল, অটোমান থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে। সেখানে দেখা হলো কত কত সম্রাট আর সুলতান, জেনোইস (বাইজেন্টাইনদের বিশেষ বাহিনী), জানিসারিসের (অটোমানদের বিশেষ বাহিনী) সাথে; ওই তো গোল্ডেন হর্ন, এখানেই তো আলাদা হয়েছে কৃষ্ণসাগর থেকে মারমারা সাগর। এই গোল্ডেন হর্নেই ছিল বাইজেন্টাইনদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যার কারণে শত্রুরা স্থলপথে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান শহর কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) অবরোধ করে থাকলেও সহজেই তারা বসফরাস দিয়ে রসদ সংগ্রহ করতে পারত। ফলে কোনো অবরোধই সহজে তাদের কাবু করতে পারত না। অটোমান সুলতান মাহমুদ বিষয়টা বিশ্লেষণ করে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থল ও জল উভয় পথে একসঙ্গে অবরোধ করার জন্য। কিন্তু তার মাঝারি পাল্লার কামানসমেত নৌবাহিনী গোল্ডেন হর্নের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ভারী কামানগুলোর সামনে টিকতেই পারছিল না। অবরোধের ব্যপ্তি বাড়ছিল কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। তখন তারা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করল। পোতাশ্রয়ের পেছনের পাহাড়গুলোর বুকে রাতের আঁধারে রাস্তা তৈরি করে তাতে গাছ-তেল চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে সন্তর্পণে সাগর থেকে জাহাজগুলো সে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে টেনে পাহাড় ডিঙিয়ে পোতাশ্রয়ে নিয়ে আসে। সকালে দেখা যায় এখন আমি যেখানে লঞ্চে ঘুরছি, গোল্ডেন হর্ন আর কনস্টান্টিনোপলের মধ্যবর্তী সেই বসফরাস পোতাশ্রয়ে বীরদর্পে ভাসছে ৭০টা অটোমান যুদ্ধজাহাজ। তারপর অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল দখল করে তাকে ইস্তাম্বুল বানানো ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এভাবেই এখানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতি টেনে সূত্রপাত হয়েছিল অটোমানদের আমল। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে আচমকা একটা ঝাঁকি লেগে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমাদের জাহাজ গোল্ডেন হর্ন চক্কর দিয়ে জেটিতে এসে ভিড়েছে, এ তারই ঝাঁকুনি।
জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই হঠাৎ রণবাদ্য শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে হঠাৎ এক কিশোর এসে ছোট এক ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র তুমুল তালে বাজাতে শুরু করেছে। আধুনিককালে আমরা যে ব্যান্ড মিউজিক শুনি, তার সূচনার অন্যতম সূতিকাগার কিন্তু অটোমানদের রণসংগীত। সব ট্যুরিস্টের সাথে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে মনে জাবর কাটতে কাটতে অজানা সে কিশোরের অপূর্ব বাজনা উপভোগ করতে লাগলাম। মনে মনে একটা ভাবও চলে এল, আগের দিনে সুলতানরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে যেমন ঢাকঢোল-বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে আওয়াজ দিত, অনেকটা ওই রকম ভাব নিয়েই সেই তালে তালে সম্পন্ন করে ফেললাম আমার বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে হাওয়া খাওয়ার খায়েশ।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জাহাজে ওঠার জন্য। তাঁর মতে, এই দীর্ঘ সময় জাহাজে বসে থেকে ক্লান্ত না হয়ে ঝটিকা সফরে আর কিছু না হোক, অন্তত পিরামিডটা দেখে নেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় আর ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরে একটা নতুন সভ্যতা তো দেখা হবে! ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইউরোপে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল। খুঁজতে থাকলাম চলতি পথে আর কোথায় ঢু মারা যায়, কোন বিমানে গেলে কোথায় ট্রানজিট; কেননা এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝঞ্ঝাট। বিশেষত, বাড়তি সময় ও বিমানভাড়ার কোনো ঝক্কি নেই। পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকল ইস্তাম্বুল। সেই একই ভাবনা, আর কিছু না হোক শেষ বিকেলের আলোয় বসফরাসের পাড়ে বসে এক বেলা হাওয়া তো খাওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, শুরু করলাম খোঁজখবর নেওয়া। বিদেশে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে থাকে তা হলো, ভিসা পাব তো? খোঁজ নিয়ে জানলাম সেনজেন ভিসা থাকলে তুরস্কের অন অ্যারাইভাল ভিসা পেতে কোনো সমস্যা হয় না, তবুও বাড়তি সাবধানতা হিসেবে আর সময় বাঁচাতে অন অ্যারাইভাল ভিসার আশায় না থেকে আগেই ই-ভিসা করে নিলাম। ভিসা ফি পড়ল বাংলা টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা মাত্র। হিসাব করে দেখলাম, এর বাইরে এক রাত থাকতে ২-৩ হাজার টাকা আর পেটেভাতে ঘুরতে ৩-৪ হাজার টাকা, সর্বমোট ১০-১৫ হাজার টাকায় একটা নতুন দেশ দেখা যাবে। আর যায় কই? এ তো ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার চেয়েও সস্তা! শেষ ধাপ হিসেবে ইউরোপ যাওয়ার সময় টার্কিশ এয়ারের টিকিট কাটলাম ফেরার পথে ইস্তাম্বুলে এক রাত দেড় দিনের ট্রানজিটসহ।
ইউরোপে আমার শেষ স্টপেজ ছিল রোম। একদম সকালের ফ্লাইট, ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। এদিকে রোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যায় রাত ১১টার দিকে (একটু কমবেশি হতে পারে, স্পষ্ট মনে নেই)। বিকল্প আছে ট্যাক্সি, যাতে খরচ পড়বে প্রায় ৫০ ইউরো! আমার পুরো ইস্তাম্বুল ট্রিপের বাজেটের সমান!! রোমের বন্ধুদের যাবতীয় অনুরোধ ও মায়া উপেক্ষা করে শেষ মেট্রো ধরে এয়ারপোর্টে চলে এসে একটা ট্রলিতে আমার যাবতীয় মালামাল চাপিয়ে দুই-তিনটা সিট জুড়ে ঝিমাতে ঝিমাতে হেডফোনে গান শুনছিলাম আর ব্রাউজ করে ইস্তাম্বুল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জড়ো করছিলাম। কিন্তু কোথায় হোটেল নেব বুঝতে পারছিলাম না। ইস্তাম্বুল চেনা দূরে থাক, আগে ইস্তাম্বুল গেছে এমন কাউকে চিনিও না। হঠাৎ চোখে পড়ল ইসিলের মেসেজ। তুর্কি ড্যান্স কোরিওগ্রাফার ইসিলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ব্রাসেলস যাওয়ার পথে, প্লেনে। দিন দুয়েক আগে তাকে মেসেঞ্জারে নক করে লিখেছিলাম, ‘আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে যাব বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া আর দু চুমুক কফির আশায়। কোন এলাকায় হোটেলে উঠলে আমার মনের বাসনা সহজে পূরণ হবে জানালে কৃতার্থ হই।’ এত স্বল্প পরিচয়ে মেসেজ পাঠাতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল। তারপরও সাত-পাঁচ ভেবে পাঠানো মেসেজের জবাব যে একদম সময়মতো পেয়ে যাব, তা কল্পনাতেও ছিল না। তার মেসেজ দেখে হালে পানি পেলাম বলে মনে হলো। চট করে মাথায় আরেকটা বুদ্ধি চলে এলো, দেড় দিনের জন্য ইস্তাম্বুল গিয়ে হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট করার কী দরকার? অনলাইনে বুক করে নিলেই তো হয়! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, বোর্ডিং আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। প্রাণসখা সেবা চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমি প্লেনে উঠে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি কারাকৈ বা এর আশপাশের কোনো হোটেল বুক করে আমাকে ঠিকানাটা যেন পাঠায় (আমার যে সিম তা তুরস্কে কাজ করবে না, তাই ঠিকানাটা ফ্লাই করার আগেই জরুরি ভিত্তিতে দরকার)। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেবা জানাল, একটা হোটেল মোটামুটি পছন্দ হয়েছে কিন্তু পেমেন্টে জটিলতা হচ্ছে, তাই কনফার্ম করা যাচ্ছে না। আপাতত আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছে আর সে ভাইয়ার (আমার বড় ভাই) সঙ্গে সমন্বয় করে তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে রুম কনফার্ম করার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, তবে তা-ই হোক, আগে তো যাই।
ই-ভিসা দেখিয়ে পাসপোর্টে এন্ট্রান্স সিল লাগিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে প্রথমেই বুক ভরে একটা জোরে নিশ্বাস নিলাম, আহ ইস্তাম্বুল, আহ তুরস্ক! অটোমান, বাইজেন্টাইনের কেন্দ্রভূমি! নানান জাতি-ধর্মের মিলনমেলা! মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগল, কখন হোটেলে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা রেখে ছুটে যাব বসফরাসের পাড়ে, সময় তো মাত্র দেড় দিন! কারাকৈর কোনো সরাসরি বাস না থাকায় আলি আহমেদ হামিদগামী একটা বাসে চেপে বসলাম। পথে একটা জায়গায় নেমে বাস চেঞ্জ করতে হবে, ১৮ লিরা ভাড়া। বগল বাজাতে বাজাতে বাসে চেপে বসলাম (হোটেলের পিক সার্ভিস চেয়েছিল ৫০ ইউরো!! এর কম মনে হয় তারা গুনতে পারে না)।
তুমুল স্পিডে বাস চলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক। মাত্র দেড় দিনের সফর। আমার হাঁ করে শহর দেখার কথা কিন্তু সেদিকে আমার নজর নেই। আমার টেনশন জায়গামতো বাস থেকে নামতে পারব তো? বাসে কোনো হেলপার নেই, পথের পাশের সাইনবোর্ড বেশির ভাগই টার্কিশ ভাষায় লেখা, যা দু-একটা ইংরেজি শব্দ চোখে পড়ে, তা-ও পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় বাসের গতির কারণে। একটু পর পর উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করি, আমার স্টপেজ কখন আসবে? ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলে, সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধো। আমি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর করুণ ইশারায় ড্রাইভারকে বোঝাতে চাইলাম, ভাই, আমার দেশে বাসে সিটবেল্টের বালাই নেই, উপরন্তু হ্যান্ডেলের সঙ্গে ঝোলানো বেল্টে ঝুলে ঝুলে আমরা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিই, আমার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, আছে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তুমি আমাকে তোমার পাশের হেলপারের সিটে বসতে দাও আর জায়গামতো নামিয়ে দাও। কে শোনে কার কথা! তার গরম চক্ষু সইতে না পেরে সিটে গিয়ে বেল্ট বেঁধে টুকটাক আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা সবাই আলি আহমেদ নামবে। উসখুস করতে করতে অবশেষে নির্দিষ্ট স্টপেজে নামলাম (নামটা ভুলে গেছি)। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে এসে পড়লাম। কোথায় পাই বদলি বাস, কোনদিকেই বা যাই? একটু ধাতস্থ হয়ে দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কারাকৈ এখান থেকে কমবেশি এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, মেট্রোর একটা স্টপেজ সামনে। হেঁটে গেলে সামনে যে দুটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছে তার দ্বিতীয়টা পেরোলেই পৌঁছে যাব। যখন শুনলাম ব্রিজগুলো বসফরাসের বুকে, আমার আর মেট্রোতে উঠতে ইচ্ছে করল না। আমার ধারণা ছিল, শহর থেকে বাসে করে বসফরাসে যেতে হবে (আমার দৌড় তো সাগর/সমুদ্র মানে বঙ্গোপসাগর), কিন্তু এভাবে যে সাগরের বুকজুড়ে শহর গড়ে উঠেছে বা শহরের অলিগলির মতো যে সাগর থাকতে পারে, তা আমার কল্পনারও অনেক বাইরে ছিল। ভাবলাম, ঘুরতেই যখন এসেছি, বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে হেঁটে হেঁটে চলে যাই। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ট্রলি টেনে শুরু করলাম হাঁটা। কিছু পথচারীর পিছু পিছু একটা জেব্রা ক্রসিং খুঁজে নিয়ে পথ রাস্তা পেরিয়ে ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই নাকে একটা আঁশটে গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। মনে হলো আরেকটু এগিয়ে গেলেই কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তটা পেয়ে যাব। ভাবতে ভাবতে ব্রিজে উঠে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার দশা। সারি সারি লোক ব্রিজে দাঁড়িয়ে সাগরের বাতাস খেতে খেতে সাগরে ছিপ ফেলে টপাটপ মাছ তুলছে। পানির দেশের লোক আমি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমার অতিপরিচিত দৃশ্য। কিন্তু সাগরের ওপরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক-দেড় শ ফুট নিচে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আমার কল্পনাকেও হার মানায়। কেউ যদি প্রশ্ন করে উচ্চতা মেপেছি কি না, তাহলেই আমি ধরা। তবে ব্রিজের নিচ দিয়ে যে বহুতল জাহাজগুলো যাচ্ছিল, সেগুলো এত নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তা দেখে মনে মনে ভেবে নিলাম উচ্চতা এক-দেড় শ ফুট তো হবেই হবে। মনে পড়ে গেল সেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথা, যাদের হাতে এখানে মানব বসতির সূত্রপাত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে (ইন্টারনেট থেকে পাওয়া জ্ঞান)।
বসফরাসের বাতাস খেতে খেতে ব্রিজ পার হয়ে মনে হলো এইবার কোন দিকে? চারদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, তা ছাড়া কে যে ভালো আর কে যে বাটপার, তা-ও তো বোঝার উপায় নেই। সাধারণত মধ্যবয়স্ক মানুষ, যারা ফ্যামিলি নিয়ে বের হয়েছে, তারা নিরাপদ হয় কিন্তু এমন কাউকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে দুই তরুণকে দেখে মনে হলো জিজ্ঞাসা করা যায়। আমার বাড়ানো ঠিকানা দেখে তারা নিজেদের মাঝে কিছুক্ষণ আলাপ করে অবশেষে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পেরে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তারপর হাসিমুখে বলল, আমি হোটেলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে। খুশিমনে তাদের দেখানো পথে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু হোটেল আর পাই না। আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাড়া নেই। আরও একজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোচ্ছি, হোটেল তো পাই না! বাঁ পাশের রাস্তাগুলো ঢাল বেয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছে! মনে মনে প্রমাদ গুনছি, এই বাক্স-প্যাটরা টেনে না আবার ওই পাহাড়ে উঠতে হয়। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে একজন বলল, এই বাঁ পাশের রাস্তা ধরে সেজা ওপরে উঠে যাও, পেলেও পেতে পারো। খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে রাস্তা। অগত্যা মধুসূদন! বাক্স-প্যাটরা টেনে ওপরে উঠে শুনি, এই পথে না, আমার হোটেল সামনের ঢালে। পরের ঢালে উঠে শুনি, এই ঢালেও না, সামনের ঢালে হতে পারে! নেমে এলাম। টার্কিশ সিম নেওয়া হয়নি, তাই গুগল ম্যাপও কাজ করছে না! পথের আশপাশে অনেক হোটেল আছে কিন্তু নেহাত অনলাইনে হোটেল বুক করে পেমেন্ট করা আছে তাই টাকার মায়ায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজতে লাগলাম, পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে করে এগোতে লাগলাম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি কী বলি তারা বোঝে না, আমিও তাদের উচ্চারণ ধরতে পারি না। ঘুরপাক খেতে খেতে মনে হলো পথচারীদের জিজ্ঞাসা না করে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করা ভালো। প্রথম যে দোকানটা পেলাম তাতে জিজ্ঞাসা করতেই দোকানি বেশ গম্ভীরভাবে বলল—সামনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কত সামনে? এক রাস্তা, নাকি ডান-বাম আছে? আরও গম্ভীর হয়ে সে হাত তুলে আমার প্রশ্নবাণ থামিয়ে বলল, প্রথম উত্তরটা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। এখন থেকে প্রতি প্রশ্নের জন্য চার্জ ৫ লিরা। একটু হোঁচট খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক কষ্টে গম্ভীর করে রাখা মুখের ওপরে হাসি হাসি চোখ! সাথে সাথেই আমার অবচেতন মন আমাকে সিগন্যাল দিল, এই লোকের ওপর ভরসা করা যায়। তার হাত ধরে যা বললাম, বাংলায় এর মানে দাঁড়ায়, ‘ভাই মারলেও তুমি, রাখলেও তুমি, আমি দেড় দিনের জন্য তোমার দেশে এসে দেড় ঘণ্টা ধরে হোটেল খুঁজছি।’ ওই ভদ্রলোক তারপর আমাকে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন, আর আমি তিন মিনিটের মধ্যে হোটেল পেয়ে গেলাম। ছিমছাম ছোট এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল, ঢুকতেই রিসিপশনে বসা তরুণী হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। নাম বলে আমার রুমের কথা বলতেই তারা জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট সম্পন্ন না হওয়ায় আমার বুকিং বাতিল হয়ে গেছে, তবে আমার কপাল ভালো যে তাদের একটা রুম এখনো খালি আছে, আমি চাইলে সেটা নিতে পারি। হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইন্টারনেটে কানেক্ট হতেই দেখি সেবার বেশ কিছু মেসেজ, কার্ডে ঝামেলার কারণে পেমেন্ট করা যায়নি। রিসিপশনিস্টের কোনো কথাই আর কানে ঢুকছিল না। স্ক্রিনের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল, চোখে ভাসতে লাগল টাকার মায়ায় দেড়/দুই ঘণ্টা ধরে বাক্স-প্যাটরা টেনে টেনে পেরোনো পথ—পাহাড়ের ঢাল আর পথের দুই পাশের হোটেলের সারি।
জিনিসপত্র রুমবন্দী করে একটা জম্পেশ শাওয়ার দিয়েই ছুট লাগালাম নিচে। হোটেলের রিসিপশনিস্টের দেওয়া ম্যাপ আর বর্ণনা ভরসা করে ৫ মিনিটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বসফরাসের জেটিতে। ২০ লিরা দিয়ে ট্যুরিস্ট লঞ্চের টিকেট কেটে জেটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হাতে ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে, চাইলে এদিক-সেদিক ঘুরে আসা যেত কিন্তু পথ হারানোর ভয়ে কোথাও না গিয়ে জেটিতে বসেই মানুষ দেখতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরা লোকের ভিড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রিটফুড বিক্রেতাদের আনাগোনা। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে আমাদের কত রকম ফর্মালিটি পোহাতে হয়, আর এখানে দিনের কাজ শেষে ভিসা- পাসপোর্ট ছাড়াই দলে দলে লোকে ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ এশিয়া থেকে ইউরোপে ফিরছে! একটা শহর দুটি মহাদেশ! ইস্তাম্বুল সম্ভবত গ্লোবাল ম্যাপের একমাত্র শহর, যার একটা পাশ পড়েছে এশিয়ায়, আরেকটা ইউরোপে।
দিনের আলো কমে আসার সাথে সাথে বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপ। যেখানে দিনের বেলায় আমি ক্রমাগত ঘামছিলাম, সেখানে সন্ধ্যা হওয়ার পর আমি পর্যাপ্ত শীতের কাপড়, টুপি, দস্তানা এগুলো পরেও কাঁপতে লাগলাম। কনকনে শীতের মধ্যেও আমি বাইরে বেরিয়ে ডকে দাঁড়ালাম। সাধের বসফরাস বলে কথা! এক কাপ ধূমায়িত কফি হাতে বন্ধু-স্বজনদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতে না পারার আফসোস বুকে চেপে শিপের রেলিং ধরে দুচোখ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম বসফরাস। পাশে বেশ কয়েকটা গ্রুপ হুল্লোড় করছে আর আমার বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছে। তার ওপর নুনের ছিটার মতো দু-একটি গ্রুপ আবার আমাকে দিয়ে তাদের গ্রুপ ছবিও তুলিয়ে নিল। ছবি তোলার ফাঁকে তাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার বসফরাসেই মগ্ন হলাম। লঞ্চ চলছে, দুই ধারে নানা রঙের আলোয় ঝলমল করছে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আর বর্তমান স্থাপত্যগুলো। একেকটা করে বিশেষ স্থাপনা পার হচ্ছে আর মাইকে কয়েকটি ভাষায় তার বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ সেদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখি, এটা ফলো করতে গেলে দেখা হয় না, আবার দেখতে গেলে ধারাবিবরণী খেয়াল করা হয় না।
আমি নামধাম বোঝার চেয়ে চারদিকের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম আর কল্পনার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিলাম সময়ের উলটোরথে। এই তো বসফরাস, বাইজেন্টাইন-অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম রক্ষক ও ভৌগোলিক গুরুত্বের চিহ্ন-চাবিকাঠি। আমি ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম ইস্তাম্বুল থেকে কনস্টান্টিনোপল, অটোমান থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে। সেখানে দেখা হলো কত কত সম্রাট আর সুলতান, জেনোইস (বাইজেন্টাইনদের বিশেষ বাহিনী), জানিসারিসের (অটোমানদের বিশেষ বাহিনী) সাথে; ওই তো গোল্ডেন হর্ন, এখানেই তো আলাদা হয়েছে কৃষ্ণসাগর থেকে মারমারা সাগর। এই গোল্ডেন হর্নেই ছিল বাইজেন্টাইনদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যার কারণে শত্রুরা স্থলপথে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান শহর কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) অবরোধ করে থাকলেও সহজেই তারা বসফরাস দিয়ে রসদ সংগ্রহ করতে পারত। ফলে কোনো অবরোধই সহজে তাদের কাবু করতে পারত না। অটোমান সুলতান মাহমুদ বিষয়টা বিশ্লেষণ করে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থল ও জল উভয় পথে একসঙ্গে অবরোধ করার জন্য। কিন্তু তার মাঝারি পাল্লার কামানসমেত নৌবাহিনী গোল্ডেন হর্নের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ভারী কামানগুলোর সামনে টিকতেই পারছিল না। অবরোধের ব্যপ্তি বাড়ছিল কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। তখন তারা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করল। পোতাশ্রয়ের পেছনের পাহাড়গুলোর বুকে রাতের আঁধারে রাস্তা তৈরি করে তাতে গাছ-তেল চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করে সন্তর্পণে সাগর থেকে জাহাজগুলো সে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে টেনে পাহাড় ডিঙিয়ে পোতাশ্রয়ে নিয়ে আসে। সকালে দেখা যায় এখন আমি যেখানে লঞ্চে ঘুরছি, গোল্ডেন হর্ন আর কনস্টান্টিনোপলের মধ্যবর্তী সেই বসফরাস পোতাশ্রয়ে বীরদর্পে ভাসছে ৭০টা অটোমান যুদ্ধজাহাজ। তারপর অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল দখল করে তাকে ইস্তাম্বুল বানানো ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এভাবেই এখানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতি টেনে সূত্রপাত হয়েছিল অটোমানদের আমল। কল্পনায় ভাসতে ভাসতে আচমকা একটা ঝাঁকি লেগে বাস্তবে ফিরে এলাম। আমাদের জাহাজ গোল্ডেন হর্ন চক্কর দিয়ে জেটিতে এসে ভিড়েছে, এ তারই ঝাঁকুনি।
জাহাজ থেকে নামতে না নামতেই হঠাৎ রণবাদ্য শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে হঠাৎ এক কিশোর এসে ছোট এক ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্র তুমুল তালে বাজাতে শুরু করেছে। আধুনিককালে আমরা যে ব্যান্ড মিউজিক শুনি, তার সূচনার অন্যতম সূতিকাগার কিন্তু অটোমানদের রণসংগীত। সব ট্যুরিস্টের সাথে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে মনে জাবর কাটতে কাটতে অজানা সে কিশোরের অপূর্ব বাজনা উপভোগ করতে লাগলাম। মনে মনে একটা ভাবও চলে এল, আগের দিনে সুলতানরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে যেমন ঢাকঢোল-বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে আওয়াজ দিত, অনেকটা ওই রকম ভাব নিয়েই সেই তালে তালে সম্পন্ন করে ফেললাম আমার বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে হাওয়া খাওয়ার খায়েশ।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১০ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
২১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জ
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
২১ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জ
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
২১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জ
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১০ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
২১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

দুই পাড়ের ভাঙন রোধ করতে সুয়েজ খালে জাহাজের সর্বোচ্চ গতিসীমা কমবেশি ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে, এখানে জাহাজ চলে গরুর গাড়ির গতিতে। তাই যেকালে মানুষ জাহাজে করে বিলাত যেত, তখন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে করে কায়রো গিয়ে, সেখানে এক দিন কাটিয়ে আবার পোর্ট সৈয়দ থেকে জ
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১০ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
২১ দিন আগে