দীপংকর গৌতম

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়। আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি নারায়ণগঞ্জ যেতে হাকিমাবাদের পীরের খানকা শরিফ, বরদেশ্বরী কালীবাড়ি-মানসিংহ যাত্রাবাড়ীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে যে দিঘিটা তাঁর সেনাবাহিনী দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন, তার পাড়ে বসে ইতিহাস শুনেছি। ইতিহাসের পাঠ নিতে নিতে তাঁর ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত ‘তবক দেওয়া পান’। একটা স্টিলের বাক্স। সেটার যে কত তলা, তা বোঝা দায়। একেক পার্ট থেকে একেক রকমের সুগন্ধি মসলা। আমি খুব পছন্দ করতাম তাঁর পান খেতে। একবার এক ঘটনা ঘটল—তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির হরতাল। আমি শাহবাগ মোড়ে, পিকেটিং চলছে। হঠাৎ দেখি আসাদ চৌধুরী যাচ্ছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বললাম, ‘পান খাব তো।’
তিনি বললেন, ‘এখন পুলিশ তাড়া করলে?’
আমি বললাম, ‘আসাদ চৌধুরীকে পুলিশ কিছু বলবে না।’
তিনি শিশুতোষ হাসি দিয়ে ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন স্টিলের হাজার দুয়ারি বাক্স। তারপর পান বানানো শুরু হতে হতে টিয়ার গ্যাস। পুলিশ এসে বলছেন, ‘আপনারা কী করছেন?’
আসাদ চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, ‘একটু পান দিয়েই চলে যাব।’
পান দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন, এখন ওদিকে যাবে না। চলো পিজি মার্কেটে। আমি ওনার সঙ্গে গিয়ে আবার পিকেটিংয়ে ফিরে এলাম।
আসাদ চৌধুরীর সাধারণ জীবনযাপন দেখে মনে হতো না কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফারসি ভাষা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অসীম। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারি ঢাকায় উর্দু কবিদের একটি সোসাইটি আছে। তাঁদের মধ্যে অনেক ভালো কবি আছেন। মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় আমি গিয়েছি কয়েকবার। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। কবি আসাদ চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত করতেন। কাঁধে ঝোলা, ঝাঁকড়া চুল। অনেক মসলা দিয়ে পান খাওয়ায় ঠোঁট থাকত লাল। আর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছাড়া তাঁকে ভাবা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঢাকা শহরে কবি, বাংলাদেশে মাটির মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী হেঁটে যাচ্ছেন।
নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হাঁটছেন। সেই ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা প্রেম, দ্রোহ ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরী হাঁটছেন, শহরজুড়ে তাঁর পদধ্বনির মুখরতা। শুদ্ধ বাংলায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী। জীবনে কবি আসাদ চৌধুরীর পরিচয়ের অন্ত ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক বিন্যাস গড়েছেন। পরিচয় উঠে এসেছে প্রাজ্ঞ, আলোচক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, আরও কত কী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ কোনো ছোট ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কবিতায় যে দহন, যে প্রতিবাদ, পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, কবিতায় তিনি তা লিখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন—সবই তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালির ওপর কী ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, কবিতায় সে কথা লিখতে লিখতে না জানি এই মানুষটি কতবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা/তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ওটা একটা জল্লাদের ছবি/পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে/মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে/অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ/বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়/দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে/গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি/সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয় থেঁতলে দেয়।’
ঠিক একইভাবে এই কবিতায় যখন আরেক ছত্রে যাই, তখন বুকটা শীতল হয়ে আসে। হাত চলে না। কবিতার কত শক্তি, ভাষা ব্যবহারে কী মুনশিয়ানা, মাটি ও মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা বহন করতেন তিনি, তা তাঁর কবিতায় বোঝা যায়—‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে/আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল/সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে/তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে তিনি শিউরে উঠবেন/অভিধান থেকে নয় আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী/জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো।’ এর প্রতিটি লাইন যেকোনো মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়ে দেবে। তাঁর কবিতার শাণিত তেজ কয়েক লক্ষ বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী। প্রতিটি কবিতার কাঠামো-বিন্যাস, ভাষার সজীবতা, উৎপ্রেক্ষা অনবদ্য। বাঙালির জন্ম জড়ুল মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত সেরা কবিতা লেখা হয়েছে, আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই সে তালিকায় পড়বে বলে বিশ্বাস করি। আরেকটি কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ তার কাঠামোটাই আলাদা। তিনি লিখেছেন, ‘কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফণা/শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা/আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/স্বপ্ন ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিলো সব অন্যায়।’ মুক্তিযোদ্ধা কবি তাঁর কবিতায় পশুপাখি, মাছ, বালুর কণা সবই যে যুদ্ধে শামিল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে যেসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করছেন, সেটাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। তাঁর কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অনন্য সম্পদ। কবিতা যে সাহিত্যে কত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার, তা ভালো কবিতা পড়লে বোঝা যায়। চেতনা জাগানিয়া কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ভাষা ব্যবহারের কৌশল শক্তি কতটা, সেটা নিবিষ্ট চিত্তে বোঝা সহজ হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস-দুঃসময়ের কালপর্ব কত মোহনীয় শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়, সেটা আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রতীয়মান।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য ১০১ জন বাংলাদেশি কর্মী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় সম্ভবত প্রজন্ম’৭১ নামে সংগঠনটি একটা পোস্টার প্রকাশ করেছিল। ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এ দুটো লাইন ছিল সেই পোস্টারের গায়ে লেখা। কী শক্তিশালী দুটি লাইন, এর মধ্য দিয়ে যে অস্ফুট আর্তনাদ লুকানো, তা তাঁরাই জানে, একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা যাদের সামান্যও ছুঁয়েছে। এই লাইন দুটো আর পোস্টারটি যেন চেতনার গহিনে আজও গেঁথে আছে।
পরে জেনেছি, আসাদ চৌধুরীর ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতা থেকে লাইন দুটি নেওয়া হয়েছিল। সেই কবিতার লাইনগুলো ছিল, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ? শেষ কথাটি সুখের ছিল? ঘৃণার ছিল? নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের, কোনটা ছিল?’
বাংলার সূর্যসন্তানদের হত্যা করে একেকটি পরিবারের সদস্যদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতই শুধু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, দেশকে করা হয়েছিল মেধাশূন্য। পরিকল্পিত এই হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী আর কার্যকর করেছে এদেশীয় দালালেরা। যাদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তারপরও শহীদ পরিবারগুলোর খবর কে রাখে? কেউ কি রাখে? রায়ের বাজারের একাত্তরের বধ্যভূমি দেখলে কি মনে হয় না একদম ভেতর থেকে কথাটি লিখেছেন আসাদ চৌধুরী। তাঁর আরেকটি কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত স্বভাব। আর তাঁদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি হার্মাদদের নারকীয়তা। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়/বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে/তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে/প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে/কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা/সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী/অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে/আমি তার সুরকার তার রক্তে স্বরলিপি লিখি/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে ঝিয়ে/খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো, অস্ফুট গোলাপকলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/কার কী বা আসে যায়।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের কাহিনি আর কত বলা যায়? একজন কবি কতটা বেদনা নিয়ে এই ইতিহাস লিখেছেন কাব্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে। এই ইতিহাসের কথাকার, গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত। প্রাণবান চিরতরুণ এই কবি। কবি আসাদ চৌধুরী কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে টরন্টোতে বসবাস করছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন অটোয়ায়। মাসখানেক আগে কবি আসাদ চৌধুরীর এনজিওগ্রাম করে দুটি ব্লকের ৯৯ ও ৮৮ শতাংশ সারানো হয়। এরপর তিনি বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তাঁর শরীর খারাপ করলে কানাডার ওসোয়ার হাসপাতালটিতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস ও হার্ট দুটিরই খুব জটিল অবস্থা ছিল কিন্তু তারপরে? বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি লোকান্তরিত হন। বাংলাদেশে এ খবর আসার পরে শোকে যেন মুষড়ে ওঠে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর কবিতা ‘সত্য ফেরারী’র মতো বলতে ইচ্ছে করে—‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো? রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার কাজ দিয়ে। মানুষ মারা যাবে, এটাই সত্য। কিন্তু বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। সেদিক থেকে আসাদ ভাইকে ভুলবে না কেউ। দুহাতে লিখেছেন তিনি বহুমাত্রিক লেখা। তাঁকে ভোলার নয়। কবি আসাদ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তাঁর অনন্য সৃষ্টির মধ্যে।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়। আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি নারায়ণগঞ্জ যেতে হাকিমাবাদের পীরের খানকা শরিফ, বরদেশ্বরী কালীবাড়ি-মানসিংহ যাত্রাবাড়ীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে যে দিঘিটা তাঁর সেনাবাহিনী দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন, তার পাড়ে বসে ইতিহাস শুনেছি। ইতিহাসের পাঠ নিতে নিতে তাঁর ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত ‘তবক দেওয়া পান’। একটা স্টিলের বাক্স। সেটার যে কত তলা, তা বোঝা দায়। একেক পার্ট থেকে একেক রকমের সুগন্ধি মসলা। আমি খুব পছন্দ করতাম তাঁর পান খেতে। একবার এক ঘটনা ঘটল—তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির হরতাল। আমি শাহবাগ মোড়ে, পিকেটিং চলছে। হঠাৎ দেখি আসাদ চৌধুরী যাচ্ছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বললাম, ‘পান খাব তো।’
তিনি বললেন, ‘এখন পুলিশ তাড়া করলে?’
আমি বললাম, ‘আসাদ চৌধুরীকে পুলিশ কিছু বলবে না।’
তিনি শিশুতোষ হাসি দিয়ে ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন স্টিলের হাজার দুয়ারি বাক্স। তারপর পান বানানো শুরু হতে হতে টিয়ার গ্যাস। পুলিশ এসে বলছেন, ‘আপনারা কী করছেন?’
আসাদ চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, ‘একটু পান দিয়েই চলে যাব।’
পান দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন, এখন ওদিকে যাবে না। চলো পিজি মার্কেটে। আমি ওনার সঙ্গে গিয়ে আবার পিকেটিংয়ে ফিরে এলাম।
আসাদ চৌধুরীর সাধারণ জীবনযাপন দেখে মনে হতো না কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফারসি ভাষা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অসীম। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারি ঢাকায় উর্দু কবিদের একটি সোসাইটি আছে। তাঁদের মধ্যে অনেক ভালো কবি আছেন। মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় আমি গিয়েছি কয়েকবার। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। কবি আসাদ চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত করতেন। কাঁধে ঝোলা, ঝাঁকড়া চুল। অনেক মসলা দিয়ে পান খাওয়ায় ঠোঁট থাকত লাল। আর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছাড়া তাঁকে ভাবা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঢাকা শহরে কবি, বাংলাদেশে মাটির মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী হেঁটে যাচ্ছেন।
নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হাঁটছেন। সেই ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা প্রেম, দ্রোহ ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরী হাঁটছেন, শহরজুড়ে তাঁর পদধ্বনির মুখরতা। শুদ্ধ বাংলায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী। জীবনে কবি আসাদ চৌধুরীর পরিচয়ের অন্ত ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক বিন্যাস গড়েছেন। পরিচয় উঠে এসেছে প্রাজ্ঞ, আলোচক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, আরও কত কী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ কোনো ছোট ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কবিতায় যে দহন, যে প্রতিবাদ, পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, কবিতায় তিনি তা লিখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন—সবই তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালির ওপর কী ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, কবিতায় সে কথা লিখতে লিখতে না জানি এই মানুষটি কতবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা/তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ওটা একটা জল্লাদের ছবি/পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে/মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে/অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ/বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়/দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে/গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি/সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয় থেঁতলে দেয়।’
ঠিক একইভাবে এই কবিতায় যখন আরেক ছত্রে যাই, তখন বুকটা শীতল হয়ে আসে। হাত চলে না। কবিতার কত শক্তি, ভাষা ব্যবহারে কী মুনশিয়ানা, মাটি ও মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা বহন করতেন তিনি, তা তাঁর কবিতায় বোঝা যায়—‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে/আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল/সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে/তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে তিনি শিউরে উঠবেন/অভিধান থেকে নয় আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী/জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো।’ এর প্রতিটি লাইন যেকোনো মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়ে দেবে। তাঁর কবিতার শাণিত তেজ কয়েক লক্ষ বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী। প্রতিটি কবিতার কাঠামো-বিন্যাস, ভাষার সজীবতা, উৎপ্রেক্ষা অনবদ্য। বাঙালির জন্ম জড়ুল মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত সেরা কবিতা লেখা হয়েছে, আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই সে তালিকায় পড়বে বলে বিশ্বাস করি। আরেকটি কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ তার কাঠামোটাই আলাদা। তিনি লিখেছেন, ‘কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফণা/শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা/আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/স্বপ্ন ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিলো সব অন্যায়।’ মুক্তিযোদ্ধা কবি তাঁর কবিতায় পশুপাখি, মাছ, বালুর কণা সবই যে যুদ্ধে শামিল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে যেসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করছেন, সেটাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। তাঁর কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অনন্য সম্পদ। কবিতা যে সাহিত্যে কত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার, তা ভালো কবিতা পড়লে বোঝা যায়। চেতনা জাগানিয়া কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ভাষা ব্যবহারের কৌশল শক্তি কতটা, সেটা নিবিষ্ট চিত্তে বোঝা সহজ হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস-দুঃসময়ের কালপর্ব কত মোহনীয় শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়, সেটা আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রতীয়মান।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য ১০১ জন বাংলাদেশি কর্মী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় সম্ভবত প্রজন্ম’৭১ নামে সংগঠনটি একটা পোস্টার প্রকাশ করেছিল। ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এ দুটো লাইন ছিল সেই পোস্টারের গায়ে লেখা। কী শক্তিশালী দুটি লাইন, এর মধ্য দিয়ে যে অস্ফুট আর্তনাদ লুকানো, তা তাঁরাই জানে, একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা যাদের সামান্যও ছুঁয়েছে। এই লাইন দুটো আর পোস্টারটি যেন চেতনার গহিনে আজও গেঁথে আছে।
পরে জেনেছি, আসাদ চৌধুরীর ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতা থেকে লাইন দুটি নেওয়া হয়েছিল। সেই কবিতার লাইনগুলো ছিল, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ? শেষ কথাটি সুখের ছিল? ঘৃণার ছিল? নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের, কোনটা ছিল?’
বাংলার সূর্যসন্তানদের হত্যা করে একেকটি পরিবারের সদস্যদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতই শুধু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, দেশকে করা হয়েছিল মেধাশূন্য। পরিকল্পিত এই হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী আর কার্যকর করেছে এদেশীয় দালালেরা। যাদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তারপরও শহীদ পরিবারগুলোর খবর কে রাখে? কেউ কি রাখে? রায়ের বাজারের একাত্তরের বধ্যভূমি দেখলে কি মনে হয় না একদম ভেতর থেকে কথাটি লিখেছেন আসাদ চৌধুরী। তাঁর আরেকটি কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত স্বভাব। আর তাঁদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি হার্মাদদের নারকীয়তা। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়/বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে/তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে/প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে/কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা/সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী/অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে/আমি তার সুরকার তার রক্তে স্বরলিপি লিখি/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে ঝিয়ে/খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো, অস্ফুট গোলাপকলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/কার কী বা আসে যায়।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের কাহিনি আর কত বলা যায়? একজন কবি কতটা বেদনা নিয়ে এই ইতিহাস লিখেছেন কাব্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে। এই ইতিহাসের কথাকার, গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত। প্রাণবান চিরতরুণ এই কবি। কবি আসাদ চৌধুরী কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে টরন্টোতে বসবাস করছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন অটোয়ায়। মাসখানেক আগে কবি আসাদ চৌধুরীর এনজিওগ্রাম করে দুটি ব্লকের ৯৯ ও ৮৮ শতাংশ সারানো হয়। এরপর তিনি বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তাঁর শরীর খারাপ করলে কানাডার ওসোয়ার হাসপাতালটিতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস ও হার্ট দুটিরই খুব জটিল অবস্থা ছিল কিন্তু তারপরে? বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি লোকান্তরিত হন। বাংলাদেশে এ খবর আসার পরে শোকে যেন মুষড়ে ওঠে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর কবিতা ‘সত্য ফেরারী’র মতো বলতে ইচ্ছে করে—‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো? রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার কাজ দিয়ে। মানুষ মারা যাবে, এটাই সত্য। কিন্তু বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। সেদিক থেকে আসাদ ভাইকে ভুলবে না কেউ। দুহাতে লিখেছেন তিনি বহুমাত্রিক লেখা। তাঁকে ভোলার নয়। কবি আসাদ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তাঁর অনন্য সৃষ্টির মধ্যে।
দীপংকর গৌতম

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়। আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি নারায়ণগঞ্জ যেতে হাকিমাবাদের পীরের খানকা শরিফ, বরদেশ্বরী কালীবাড়ি-মানসিংহ যাত্রাবাড়ীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে যে দিঘিটা তাঁর সেনাবাহিনী দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন, তার পাড়ে বসে ইতিহাস শুনেছি। ইতিহাসের পাঠ নিতে নিতে তাঁর ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত ‘তবক দেওয়া পান’। একটা স্টিলের বাক্স। সেটার যে কত তলা, তা বোঝা দায়। একেক পার্ট থেকে একেক রকমের সুগন্ধি মসলা। আমি খুব পছন্দ করতাম তাঁর পান খেতে। একবার এক ঘটনা ঘটল—তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির হরতাল। আমি শাহবাগ মোড়ে, পিকেটিং চলছে। হঠাৎ দেখি আসাদ চৌধুরী যাচ্ছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বললাম, ‘পান খাব তো।’
তিনি বললেন, ‘এখন পুলিশ তাড়া করলে?’
আমি বললাম, ‘আসাদ চৌধুরীকে পুলিশ কিছু বলবে না।’
তিনি শিশুতোষ হাসি দিয়ে ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন স্টিলের হাজার দুয়ারি বাক্স। তারপর পান বানানো শুরু হতে হতে টিয়ার গ্যাস। পুলিশ এসে বলছেন, ‘আপনারা কী করছেন?’
আসাদ চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, ‘একটু পান দিয়েই চলে যাব।’
পান দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন, এখন ওদিকে যাবে না। চলো পিজি মার্কেটে। আমি ওনার সঙ্গে গিয়ে আবার পিকেটিংয়ে ফিরে এলাম।
আসাদ চৌধুরীর সাধারণ জীবনযাপন দেখে মনে হতো না কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফারসি ভাষা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অসীম। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারি ঢাকায় উর্দু কবিদের একটি সোসাইটি আছে। তাঁদের মধ্যে অনেক ভালো কবি আছেন। মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় আমি গিয়েছি কয়েকবার। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। কবি আসাদ চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত করতেন। কাঁধে ঝোলা, ঝাঁকড়া চুল। অনেক মসলা দিয়ে পান খাওয়ায় ঠোঁট থাকত লাল। আর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছাড়া তাঁকে ভাবা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঢাকা শহরে কবি, বাংলাদেশে মাটির মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী হেঁটে যাচ্ছেন।
নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হাঁটছেন। সেই ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা প্রেম, দ্রোহ ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরী হাঁটছেন, শহরজুড়ে তাঁর পদধ্বনির মুখরতা। শুদ্ধ বাংলায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী। জীবনে কবি আসাদ চৌধুরীর পরিচয়ের অন্ত ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক বিন্যাস গড়েছেন। পরিচয় উঠে এসেছে প্রাজ্ঞ, আলোচক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, আরও কত কী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ কোনো ছোট ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কবিতায় যে দহন, যে প্রতিবাদ, পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, কবিতায় তিনি তা লিখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন—সবই তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালির ওপর কী ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, কবিতায় সে কথা লিখতে লিখতে না জানি এই মানুষটি কতবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা/তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ওটা একটা জল্লাদের ছবি/পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে/মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে/অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ/বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়/দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে/গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি/সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয় থেঁতলে দেয়।’
ঠিক একইভাবে এই কবিতায় যখন আরেক ছত্রে যাই, তখন বুকটা শীতল হয়ে আসে। হাত চলে না। কবিতার কত শক্তি, ভাষা ব্যবহারে কী মুনশিয়ানা, মাটি ও মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা বহন করতেন তিনি, তা তাঁর কবিতায় বোঝা যায়—‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে/আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল/সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে/তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে তিনি শিউরে উঠবেন/অভিধান থেকে নয় আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী/জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো।’ এর প্রতিটি লাইন যেকোনো মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়ে দেবে। তাঁর কবিতার শাণিত তেজ কয়েক লক্ষ বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী। প্রতিটি কবিতার কাঠামো-বিন্যাস, ভাষার সজীবতা, উৎপ্রেক্ষা অনবদ্য। বাঙালির জন্ম জড়ুল মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত সেরা কবিতা লেখা হয়েছে, আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই সে তালিকায় পড়বে বলে বিশ্বাস করি। আরেকটি কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ তার কাঠামোটাই আলাদা। তিনি লিখেছেন, ‘কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফণা/শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা/আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/স্বপ্ন ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিলো সব অন্যায়।’ মুক্তিযোদ্ধা কবি তাঁর কবিতায় পশুপাখি, মাছ, বালুর কণা সবই যে যুদ্ধে শামিল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে যেসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করছেন, সেটাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। তাঁর কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অনন্য সম্পদ। কবিতা যে সাহিত্যে কত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার, তা ভালো কবিতা পড়লে বোঝা যায়। চেতনা জাগানিয়া কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ভাষা ব্যবহারের কৌশল শক্তি কতটা, সেটা নিবিষ্ট চিত্তে বোঝা সহজ হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস-দুঃসময়ের কালপর্ব কত মোহনীয় শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়, সেটা আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রতীয়মান।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য ১০১ জন বাংলাদেশি কর্মী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় সম্ভবত প্রজন্ম’৭১ নামে সংগঠনটি একটা পোস্টার প্রকাশ করেছিল। ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এ দুটো লাইন ছিল সেই পোস্টারের গায়ে লেখা। কী শক্তিশালী দুটি লাইন, এর মধ্য দিয়ে যে অস্ফুট আর্তনাদ লুকানো, তা তাঁরাই জানে, একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা যাদের সামান্যও ছুঁয়েছে। এই লাইন দুটো আর পোস্টারটি যেন চেতনার গহিনে আজও গেঁথে আছে।
পরে জেনেছি, আসাদ চৌধুরীর ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতা থেকে লাইন দুটি নেওয়া হয়েছিল। সেই কবিতার লাইনগুলো ছিল, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ? শেষ কথাটি সুখের ছিল? ঘৃণার ছিল? নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের, কোনটা ছিল?’
বাংলার সূর্যসন্তানদের হত্যা করে একেকটি পরিবারের সদস্যদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতই শুধু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, দেশকে করা হয়েছিল মেধাশূন্য। পরিকল্পিত এই হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী আর কার্যকর করেছে এদেশীয় দালালেরা। যাদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তারপরও শহীদ পরিবারগুলোর খবর কে রাখে? কেউ কি রাখে? রায়ের বাজারের একাত্তরের বধ্যভূমি দেখলে কি মনে হয় না একদম ভেতর থেকে কথাটি লিখেছেন আসাদ চৌধুরী। তাঁর আরেকটি কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত স্বভাব। আর তাঁদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি হার্মাদদের নারকীয়তা। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়/বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে/তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে/প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে/কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা/সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী/অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে/আমি তার সুরকার তার রক্তে স্বরলিপি লিখি/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে ঝিয়ে/খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো, অস্ফুট গোলাপকলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/কার কী বা আসে যায়।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের কাহিনি আর কত বলা যায়? একজন কবি কতটা বেদনা নিয়ে এই ইতিহাস লিখেছেন কাব্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে। এই ইতিহাসের কথাকার, গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত। প্রাণবান চিরতরুণ এই কবি। কবি আসাদ চৌধুরী কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে টরন্টোতে বসবাস করছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন অটোয়ায়। মাসখানেক আগে কবি আসাদ চৌধুরীর এনজিওগ্রাম করে দুটি ব্লকের ৯৯ ও ৮৮ শতাংশ সারানো হয়। এরপর তিনি বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তাঁর শরীর খারাপ করলে কানাডার ওসোয়ার হাসপাতালটিতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস ও হার্ট দুটিরই খুব জটিল অবস্থা ছিল কিন্তু তারপরে? বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি লোকান্তরিত হন। বাংলাদেশে এ খবর আসার পরে শোকে যেন মুষড়ে ওঠে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর কবিতা ‘সত্য ফেরারী’র মতো বলতে ইচ্ছে করে—‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো? রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার কাজ দিয়ে। মানুষ মারা যাবে, এটাই সত্য। কিন্তু বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। সেদিক থেকে আসাদ ভাইকে ভুলবে না কেউ। দুহাতে লিখেছেন তিনি বহুমাত্রিক লেখা। তাঁকে ভোলার নয়। কবি আসাদ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তাঁর অনন্য সৃষ্টির মধ্যে।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়। আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি নারায়ণগঞ্জ যেতে হাকিমাবাদের পীরের খানকা শরিফ, বরদেশ্বরী কালীবাড়ি-মানসিংহ যাত্রাবাড়ীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে যে দিঘিটা তাঁর সেনাবাহিনী দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন, তার পাড়ে বসে ইতিহাস শুনেছি। ইতিহাসের পাঠ নিতে নিতে তাঁর ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত ‘তবক দেওয়া পান’। একটা স্টিলের বাক্স। সেটার যে কত তলা, তা বোঝা দায়। একেক পার্ট থেকে একেক রকমের সুগন্ধি মসলা। আমি খুব পছন্দ করতাম তাঁর পান খেতে। একবার এক ঘটনা ঘটল—তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির হরতাল। আমি শাহবাগ মোড়ে, পিকেটিং চলছে। হঠাৎ দেখি আসাদ চৌধুরী যাচ্ছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বললাম, ‘পান খাব তো।’
তিনি বললেন, ‘এখন পুলিশ তাড়া করলে?’
আমি বললাম, ‘আসাদ চৌধুরীকে পুলিশ কিছু বলবে না।’
তিনি শিশুতোষ হাসি দিয়ে ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন স্টিলের হাজার দুয়ারি বাক্স। তারপর পান বানানো শুরু হতে হতে টিয়ার গ্যাস। পুলিশ এসে বলছেন, ‘আপনারা কী করছেন?’
আসাদ চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, ‘একটু পান দিয়েই চলে যাব।’
পান দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন, এখন ওদিকে যাবে না। চলো পিজি মার্কেটে। আমি ওনার সঙ্গে গিয়ে আবার পিকেটিংয়ে ফিরে এলাম।
আসাদ চৌধুরীর সাধারণ জীবনযাপন দেখে মনে হতো না কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফারসি ভাষা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অসীম। তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারি ঢাকায় উর্দু কবিদের একটি সোসাইটি আছে। তাঁদের মধ্যে অনেক ভালো কবি আছেন। মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় আমি গিয়েছি কয়েকবার। কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। কবি আসাদ চৌধুরী তাঁদের সঙ্গে উর্দুতে বাতচিত করতেন। কাঁধে ঝোলা, ঝাঁকড়া চুল। অনেক মসলা দিয়ে পান খাওয়ায় ঠোঁট থাকত লাল। আর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছাড়া তাঁকে ভাবা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঢাকা শহরে কবি, বাংলাদেশে মাটির মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী হেঁটে যাচ্ছেন।
নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হাঁটছেন। সেই ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা প্রেম, দ্রোহ ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরী হাঁটছেন, শহরজুড়ে তাঁর পদধ্বনির মুখরতা। শুদ্ধ বাংলায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী। জীবনে কবি আসাদ চৌধুরীর পরিচয়ের অন্ত ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক বিন্যাস গড়েছেন। পরিচয় উঠে এসেছে প্রাজ্ঞ, আলোচক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, আরও কত কী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ কোনো ছোট ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর কবিতায় যে দহন, যে প্রতিবাদ, পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, কবিতায় তিনি তা লিখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন—সবই তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালির ওপর কী ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, কবিতায় সে কথা লিখতে লিখতে না জানি এই মানুষটি কতবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা/তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ওটা একটা জল্লাদের ছবি/পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে/মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে/অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ/বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়/দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে/গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস, মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি/সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয় থেঁতলে দেয়।’
ঠিক একইভাবে এই কবিতায় যখন আরেক ছত্রে যাই, তখন বুকটা শীতল হয়ে আসে। হাত চলে না। কবিতার কত শক্তি, ভাষা ব্যবহারে কী মুনশিয়ানা, মাটি ও মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসা বহন করতেন তিনি, তা তাঁর কবিতায় বোঝা যায়—‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে/আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল/সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে/তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে তিনি শিউরে উঠবেন/অভিধান থেকে নয় আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী/জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো।’ এর প্রতিটি লাইন যেকোনো মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়ে দেবে। তাঁর কবিতার শাণিত তেজ কয়েক লক্ষ বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী। প্রতিটি কবিতার কাঠামো-বিন্যাস, ভাষার সজীবতা, উৎপ্রেক্ষা অনবদ্য। বাঙালির জন্ম জড়ুল মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত সেরা কবিতা লেখা হয়েছে, আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই সে তালিকায় পড়বে বলে বিশ্বাস করি। আরেকটি কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ তার কাঠামোটাই আলাদা। তিনি লিখেছেন, ‘কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফণা/শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা/আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/স্বপ্ন ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিলো সব অন্যায়।’ মুক্তিযোদ্ধা কবি তাঁর কবিতায় পশুপাখি, মাছ, বালুর কণা সবই যে যুদ্ধে শামিল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে যেসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করছেন, সেটাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। তাঁর কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অনন্য সম্পদ। কবিতা যে সাহিত্যে কত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার, তা ভালো কবিতা পড়লে বোঝা যায়। চেতনা জাগানিয়া কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ভাষা ব্যবহারের কৌশল শক্তি কতটা, সেটা নিবিষ্ট চিত্তে বোঝা সহজ হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস-দুঃসময়ের কালপর্ব কত মোহনীয় শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়, সেটা আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রতীয়মান।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য ১০১ জন বাংলাদেশি কর্মী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় সম্ভবত প্রজন্ম’৭১ নামে সংগঠনটি একটা পোস্টার প্রকাশ করেছিল। ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এ দুটো লাইন ছিল সেই পোস্টারের গায়ে লেখা। কী শক্তিশালী দুটি লাইন, এর মধ্য দিয়ে যে অস্ফুট আর্তনাদ লুকানো, তা তাঁরাই জানে, একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা যাদের সামান্যও ছুঁয়েছে। এই লাইন দুটো আর পোস্টারটি যেন চেতনার গহিনে আজও গেঁথে আছে।
পরে জেনেছি, আসাদ চৌধুরীর ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতা থেকে লাইন দুটি নেওয়া হয়েছিল। সেই কবিতার লাইনগুলো ছিল, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ? শেষ কথাটি সুখের ছিল? ঘৃণার ছিল? নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের, কোনটা ছিল?’
বাংলার সূর্যসন্তানদের হত্যা করে একেকটি পরিবারের সদস্যদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতই শুধু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, দেশকে করা হয়েছিল মেধাশূন্য। পরিকল্পিত এই হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী আর কার্যকর করেছে এদেশীয় দালালেরা। যাদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তারপরও শহীদ পরিবারগুলোর খবর কে রাখে? কেউ কি রাখে? রায়ের বাজারের একাত্তরের বধ্যভূমি দেখলে কি মনে হয় না একদম ভেতর থেকে কথাটি লিখেছেন আসাদ চৌধুরী। তাঁর আরেকটি কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত স্বভাব। আর তাঁদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি হার্মাদদের নারকীয়তা। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়/বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে/তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে/প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে/কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা/সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী/অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে/আমি তার সুরকার তার রক্তে স্বরলিপি লিখি/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে ঝিয়ে/খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো, অস্ফুট গোলাপকলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/কার কী বা আসে যায়।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের কাহিনি আর কত বলা যায়? একজন কবি কতটা বেদনা নিয়ে এই ইতিহাস লিখেছেন কাব্যের ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে। এই ইতিহাসের কথাকার, গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত। প্রাণবান চিরতরুণ এই কবি। কবি আসাদ চৌধুরী কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে টরন্টোতে বসবাস করছিলেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন অটোয়ায়। মাসখানেক আগে কবি আসাদ চৌধুরীর এনজিওগ্রাম করে দুটি ব্লকের ৯৯ ও ৮৮ শতাংশ সারানো হয়। এরপর তিনি বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তাঁর শরীর খারাপ করলে কানাডার ওসোয়ার হাসপাতালটিতে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস ও হার্ট দুটিরই খুব জটিল অবস্থা ছিল কিন্তু তারপরে? বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি লোকান্তরিত হন। বাংলাদেশে এ খবর আসার পরে শোকে যেন মুষড়ে ওঠে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর কবিতা ‘সত্য ফেরারী’র মতো বলতে ইচ্ছে করে—‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো? রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার কাজ দিয়ে। মানুষ মারা যাবে, এটাই সত্য। কিন্তু বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্য দিয়ে। সেদিক থেকে আসাদ ভাইকে ভুলবে না কেউ। দুহাতে লিখেছেন তিনি বহুমাত্রিক লেখা। তাঁকে ভোলার নয়। কবি আসাদ চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তাঁর অনন্য সৃষ্টির মধ্যে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়।
০৬ অক্টোবর ২০২৩
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়।
০৬ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়।
০৬ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

কবি আসাদ চৌধুরী নেই—তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন। খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয়, তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়।
০৬ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে