Ajker Patrika

আমাদের বাউল রবি ঠাকুর

মাহাবুব খালাসী, ঢাকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [২৫ বৈশাখ ১২৬৮–২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [২৫ বৈশাখ ১২৬৮–২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ]

‘ও তোর মনের মানুষ এলে দ্বারে, মন যখন জাগলি না রে’ অথবা, ‘এবার তোর মারা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’ গানগুলো শুনলে মনে হয় এ যেন কোনো বাউল প্রাণেরই আর্তনাদ। অথচ এ গান কোনো আখড়াই বা গৃহবাউলের গান নয়। এ গান এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পুত্রের, এ গান রবি ঠাকুরের, রবি বাউলের।

শহর কলকাতার মধ্যভাগে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী স্বভাবের। লোকায়ত জীবনের সরলতা, সহজতা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল সুদৃঢ় শৈশবেই।  

রবিঠাকুর পারিবারিকভাবেই গানের আবহে বেড়ে উঠেছেন। তবে তা লোক বা বাউল গান নয়, শাস্ত্রীয় সংগীত। তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত ভারতবর্ষের বড় বড় ওস্তাদেরা উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর করতেন। বরোদা, গোয়ালিয়র, অযোধ্যা, দিল্লি, আগ্রা, মোরাদাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে সংগীতশিল্পীরা ভিড় জমাতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। উচ্চাঙ্গ সংগীতের এমন কঠোর প্রাচীর ভেদ করে ধুলোমাটির লোকসুর রবীন্দ্র মানসে কীভাবে পশিল, তা কৌতূহল জাগায়। প্রশ্ন জাগে, রবিঠাকুর কীভাবে হয়ে উঠলেন রবি-বাউল।

কবিগুরু তাঁর জীবনের বেশ কিছু কাল অতিবাহিত করেন পূর্ববঙ্গের রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, পতিসরসহ বীরভূমের নানা পল্লি অঞ্চলে। পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে কাটানো এ সময়ই প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে রবি বাবুর বাউল সত্তার পেছনে। বিশেষ করে ১৮৯০ সালে জমিদারি দেখার সুবাদে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আগমনকালে অগণিত লোকশিল্পীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওইসব লোকশিল্পীর প্রভাবেই লোকসংগীতের সঙ্গে রবি ঠাকুরের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়। তারপর থেকে রবীন্দ্রনাথের গানে লোকায়ত ভাবধারা বিশেষ জায়গা দখল করে বসে।  

একদা শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরার মুখে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি শুনে নিজের আত্মদর্শনই যেন উপলব্ধি করেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গানেরই অনুকরণে সৃষ্টি করেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যা এখন আমাদের জাতীয় সংগীত। এ ছাড়া ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ, যেগুলোর সুরও লোকাশ্রিত।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া ‘হরি নাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’–এর অনুকরণে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’, ‘আমার সোনার গৌর কেনে’–এর অনুকরণে ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘মন মাঝি সামাল সামাল’–এর অনুকরণে ‘এবার তোর মরা গাঙে’, ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ এসব গান রচনা করেন রবি ঠাকুর।  

এগুলো ছাড়াও ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ’, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘যে তোরে পাগল বলে’–এর মতো অসংখ্য লোকধারার গান লিখেছেন রবি ঠাকুর, যা শুনলে মনে হয় এ যেন বাংলার কোনো লোককবি, লোকসাধকদেরই অন্তরের আর্তনাদ।

জানা যায়, বেদ, পুরাণ, কোরান, বাইবেল ও লালনের জীবনীগ্ৰন্থ সব সময় রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলে থাকত। জীবন সম্পর্কে বাউলদের ধারণা তন্ত্র-মন্ত্র, মন্দির-মসজিদ বা দেবতা-আশ্রিত নয়। মানবদেহ, আত্মা বা পরমাত্মাই তাদের সাধনার মূল লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িকতাহীন ওই স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের প্রতি কবিগুরু ছিলেন বিশেষ কৌতূহলী ও উৎসাহী। এ কৌতূহল থেকে তিনি বারবার ছুটে যেতেন শিলাইদহে, সঙ্গ করতেন লালন ও সমসাময়িক বাউল ফকিরদের।  

ড. সুকুমার সেন বলেছেন, বাউল গানের প্রচলন আমাদের দেশে চিরদিনই ছিল, কিন্তু ভদ্র, শিক্ষিত সমাজে তার কোনো মূল্য ও মর্যাদা ছিল না। বাউল গানের সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা প্রথমত ও শ্রেষ্ঠতম।

রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন, আমাদের সাহিত্যের প্রাণভ্রোমরা এসব গ্রাম্য সাহিত্যের মধ্যেই লুকায়িত রয়েছে। তাই তো লালন ফকির ও তাঁর গান নিযে পরম যত্মের সঙ্গে কাজ করে গেছেন রবি ঠাকুর। দায়িত্ব নিয়ে সংগ্রহ করেছেন লালনের সমস্ত গান। নয়তো অনাদর–অযত্নে কালের গহ্বরে হারিয়ে যেত পারত বাংলা গানের সমৃদ্ধ এ ভান্ডার।

প্রখ্যাত গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন, ‘শিলাইদহে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, গোঁসাই রামলাল, গোঁসাই গেপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী ও লালনের শিষ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-পরিচয় হয়েছে। শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল থেকে সংগৃহীত লালন ফকির ও গগন হরকরার গান তিনি সুধীসমাজে প্রচার করেন। শিলাইদহ অঞ্চল থেকে লোকসাহিত্য এবং লোকশিল্পের বিভিন্ন উপকরণ ও নিদর্শনও সংগ্রহ করেছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথ আমাদের লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন, আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেন। তিনি লোকসাহিত্যের অন্তর্নিহিত রসতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করে বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমর অধ্যায় যুক্ত করেছেন। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি আজও একটি একক আসনের অধিকারী, তিনিই এ ধারার সূত্রপাত করে আমাদের পথিকৃত হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথের দিয়েই আমরা বাউল গানের অতীন্দ্রিয় রস অনুভব করিতে শিখেছি।

আমরা যদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ করি, দেখা যাবে, সব দেশের মহান কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তাঁদের স্বদেশানুরাগ ও স্বাজাত্যবোধই প্রেরণার প্রধান উৎস। রবীন্দ্রনাথ সে জায়গাটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নানান বর্ণের রবীন্দ্রনাথের অন্যতম একটি বর্ণ, তাঁর বাউল বর্ণ। বিশ্বজনের রবি ঠাকুরের মতোই তিনি ব্রাত্য, লোকজনের রবি বাউল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

এবার ‘পাকিস্তানপন্থার’ বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আসিফ মাহমুদ

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

বাহাত্তরের সংবিধান, জুলাই সনদ, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা নিয়ে আইন উপদেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য

রাতে গ্রেপ্তারের পর দুপুরে মুক্ত, পরে আবার গ্রেপ্তার তামান্না

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত