রিয়াদ আল ফেরদৌস

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।
রিয়াদ আল ফেরদৌস

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র
০৪ মে ২০২৩
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র
০৪ মে ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র
০৪ মে ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র
০৪ মে ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৬ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৭ দিন আগে