Ajker Patrika

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওয়ারশ যাওয়ার ট্রেনে

মঈনুস সুলতান
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওয়ারশ যাওয়ার ট্রেনে

ঘুরে বেড়ানোর জন্য হাতে আরও সপ্তাখানেকের মতো অবসর আছে। কিন্তু জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আমি আর থাকতে চাচ্ছি না। ভাবছি পোলান্ডের দিকে যাব। ওয়ারশ শহরে জাহাজি শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে খানিক খোঁজখবর নেব। কোনো এজেন্ডা ছাড়া হাঁটব ফুটপাতে। এখন সামার চলছে, রোডসাইড ক্যাফেতে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে ঢুঁ মারব শিপ-ইয়ার্ডে; মওকা পেলে খালাসিদের পানশালায় বসে চুটিয়ে শুনে নেব জাহাজিদের পছন্দসই ব্যান্ডের বাজনা। 

না, ফ্লাই করার মতো অর্থবল নেই, আবার সাততাড়াতাড়ি উড়ে গিয়ে ওয়ারশতে ল্যান্ড করার কোনো প্রয়োজনও আমার নেই। তাই ট্রেনের টিকিট কেনার জন্য চলে আসি মস্ত এক রেলওয়ে স্টেশনে। কিছুদিন হলো আমি ইউরোপে ট্রাভেল করছি, কিন্তু যানবাহন কীভাবে ম্যানেজ করতে হবে, কোথায় টিকিট কাটতে হবে, কোন জায়গায় পাতালরেল থেকে বেরিয়ে ট্রাম ধরতে হবে; বিষয়গুলো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। তাই রেলওয়ে স্টেশনে এসে টিকিট কাউন্টার খুঁজে পেতে আমার বিস্তর সময় লাগে। 

ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হলেও তখনো জার্মানিতে আজকালকার মতো অনলাইনে টিকিট কেনার বিষয়টি চালু হয়নি। কাউন্টারের কাছাকাছি আমি এক মহিলাকে কুঁজো হয়ে রেলওয়ে ম্যাপ ও টাইমটেবিল ঘাঁটতে দেখি। মহিলার বয়স হয়েছে বিস্তর, তাঁর চুলের রং পিজিওন ডাভ নামক এক ধরনের পাখির পালকের মতো রুপালি মেশানো ধূসর। 

মাত্র মিনিট কয়েক আগে আমি কাউন্টারে নীল-চোখা গাবদাগোবদা এক ক্লার্কের সঙ্গে ওয়ারশর টিকিট কেনা বাবদে কথা বলেছি। তাঁর জার্মান ভাষা আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি, তাই সবিনয় অনুরোধে, ক্লার্ক ওভারকোট মোছার ব্রাশ দিয়ে ঘন দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে ইংরেজিতে টিকিটের দাম ইত্যাদি বুঝিয়ে বলেছেন। তাঁর ইংরেজি বুলিতে নাখটে-মুখটেজাতীয় উচ্চারণ বিভ্রাট থাকায় আমি তাঁরও বিশেষ কিছু বুঝতে পারিনি। তাই তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে সরে এসেছি কাউন্টার থেকে। এবার এক বৃদ্ধা মহিলাকে ম্যাপ ঘাঁটতে দেখে ভাবি, কথাবার্তা বলে দেখি, যদি তিনি ইংরেজি বুঝতে পারেন, তাহলে তাঁর কাছে সাহায্য চাইব। 

মহিলাও নাকের ব্রিজে হাই পাওয়ারের রিডিং-গ্লাস ঝুলিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে দেখেন। দিন কয়েক হলো, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি হামলা বেড়েছে বিঘতভাবে। বোমা বর্ষণে মৃত্যু হচ্ছে নারী ও শিশুসহ বেসমারিক আমজনতার। ফিলিস্তিনিরা গড়ে তুলছে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা প্রতিরোধ আন্দোলন। এগিয়ে আসা ইসরায়েলি ট্যাংকের দিকে তারা ছুড়ছে পাথরের ঢেলা। আমি ইন্তিফাদার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে গলায় পেঁচিয়েছি কেফ্যিয়া বা সাদাকালো চেককাটা স্কার্ফ। আমার হ্যাট ও গালফশার্টে গাঁথা বেশ কয়েকটি বোতাম; তার প্রতিটিতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা একাধিক স্লোগান। হাই পাওয়ারের গ্লাসের ওপর দিয়ে মহিলার চোখের দৃষ্টিকে উদাসীন দেখালেও স্পষ্টত তিনি স্লোগানের বাণীগুলো নিরিখ করে দেখছেন। 

তাঁর সঙ্গে কথা বলার এবং সম্ভব হলে টিকিট কেনা বাবদে তাঁর সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজন আমার আছে। সুতরাং, এগিয়ে যেতে যেতে বৃদ্ধার মুখের এক্সপ্রেশন নিয়ে দ্রুত চিন্তা করি। না, ওখানে করুণা কিংবা সহনুভূতির ছিটেফোঁটাও নেই, তবে আছে শত বছরের পুরোনো কোনো বইয়ের জরাজীর্ণ পাতার মতো এক ধরনের উদাসীন ভাবগাম্ভীর্য। পাতাটি যেন বিবর্ণ হতে হতে ঝাপসা হয়ে এসেছে, তাই আমি তাঁর অভিব্যক্তিতে বিশেষ কিছু পড়তে পারি না। 

তবে তিনি ‘হোয়াটস্ আপ?’ বলে একটু পজ নিয়ে ‘হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে?’ বললে, আমি যেন তৃষ্ণায় বরফ দেয়া সোডাজলের তালাশ পাই। তাঁর ইংরেজি বাগবিধিটি স্পষ্টত আমেরিকান। তিনি হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে নিজেকে মিসেস এলিশেভা গারফিংকেল বলে পরিচয় দেন। 

আমি হাত মেলাতে গেলে, তাঁর গলার লকেটে পাঁচ আঙুলের পাঞ্জার ডিজাইনটি নজরে পড়ে। নকশার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট ডায়মন্ড দিয়ে আঁকা কিং ডেভিডের নক্ষত্র প্রতীক ঝলসে ওঠে। আশকানাজি গোত্রের সেকেলেপন্থী ইহুদি মহিলারা এ ধরনের জমকালো জুইশ সিম্বলঅলা অলংকার পরে থাকেন, এ ব্যাপারে আমি সচেতন। 

 আজ আমি ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে টিশার্টে পিনওয়ালা বোতাম গেঁথে গলায় কেফ্যিয়া পেঁচিয়ে সড়কে বেরিয়েছি। এখন একজন ইহুদি মহিলার কাছে হেল্প চাইতে এসেছি, মনের ভেতর একটু বিব্রতভাব মাথা চাড়া দেয়। 

কিন্তু মিসেস এলিশেভা ‘হাউ মে আই হেল্প ইউ?’ বললে, ওয়ারশ যাওয়ার টিকিটের প্রসঙ্গটি সংক্ষিপ্তভাবে তাঁকে জানাই। তিনি খুব সুন্দর করে হাসেন। তাঁর হাসিটি যেন কচুরিপানার ঝোপের আড়ালে লুকানো জলপদ্মের মতো স্নিগ্ধতা ছড়ায়। বলেন, ‘গোয়িং টু ওয়ারশ বাই ট্রেন ইজ ভেরি ইজি, জাস্ট এ পিস অব কেইক। ইউরো-রেলের ট্রেন চালানো কোম্পানিটি আজকাল এত ইউজার ফ্রেন্ডলি হয়েছে যে এতে চড়ে বসলে অনায়াসে যাওয়া যায় চব্বিশটি দেশের পনেরো হাজার শহরের যেকোন একটায়। তোমার সমস্যা হচ্ছে কোথায়? কোন ট্রেনটি ধরতে চাও?’ 

একটু পজ নিয়ে বৃদ্ধা ফের কথা বলেন, ‘অপসন ওয়ান হচ্ছে—প্রথমে ইউরো রেল ধরে যাবে ফ্রাঙ্কফুর্ট টু বার্লিন। ৭০০ কিলোমিটারের ধাক্কা। সময় লাগবে চার ঘণ্টার মতো। বার্লিনে একটু জিরিয়ে-জুরিয়ে ধরতে পারো ওয়ারশ যাওয়ার ট্রেন। বার্লিন-ওয়ারশ এক্সপ্রেস কোম্পানি জয়েন্টলি এ ট্রেনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে। টিকিট একটু এক্সপেনসিভ হলেও খুবই ওয়েল ম্যানেজড। মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ভেতর পোল্যান্ডের বর্ডার ছাড়িয়ে পৌঁছে যাবে ওয়ারশ সিটিতে।’ 

‘মিসেস গারফিংকেল, আমি একটু সস্তায় যেতে চাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ওয়ারশ পৌঁছার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অন্য অপশন আর কী আছে?’ 

তিনি জার্মান ভাষায় লেখা টাইমটেবিলের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বলেন, ‘তাহলে চলো আমার সঙ্গে। আমিও ওয়ারশতে ফিরে যাচ্ছি, অনেক বছর পর, ৬০ কিংবা ৭০ বছর আগে আমি যখন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওয়ারশতে রাতের ট্রেনে চড়ে যাই, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। দ্যাটস অ্যা লং লং টাইম এ গো। সে ওভারনাইট ট্রেনটি এখনো চালু আছে। ফ্রাঙ্কফুর্টের এ সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ছাড়বে রাত ১০টার দিকে। পরদিন বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছাবে ওয়ারশতে। উড ইউ লাইক টু গো উইথ মি?’ আমি ঘাড় হেলিয়ে তাঁর প্রস্তাবে সায় দিই। 

কাউন্টারে আমি নাইট ট্রেনের টিকিট কিনতে আসি। মিসেস এলিশেভা গারফিংকেলও আমার সঙ্গে সঙ্গে আসেন। এমনি আমার অগোছালো স্বভাব, কিছুতে ব্যাকপ্যাকে পাসপোর্ট, আইডি ইত্যাদি খুঁজে পাই না। একটি ফোল্ডার থেকে অবশেষে ট্রাভেলার চেক বের করতে গেলে, এক তাড়া পত্রিকার কাটিং ছড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। মিসেস এলিশেভা কুঁজো হয়ে তা কুড়িয়ে তোলেন। টিকিট কাটা হয়ে যেতেই দেখি, তিনি কাটিংগুলো গোছাতে গোছাতে চশমা চোখে তা খুঁটিয়ে দেখছেন। 

পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের ইন্টারন্যাশনাল এডিশন থেকে কিছু তথ্য ও ফিলিস্তিনি নিপীড়নের ছবি আমি কেটে রেখেছি। ভাবছি, একটু প্রতিফলন করে এ বিষয়ে একটি লেখা তৈরি করব। 

আমরা হেঁটে টার্মিনালের এক প্রান্তে এসে একটি বেঞ্চে বসি। মিসেস এলিশেভা ফোল্ডারে কাটিংগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘আই সি, ইউ আর থিংকিং অ্যাবাউট প্যালেস্টাইন ইস্যু।’ আমি জবাব দিই, ‘আই অ্যাম এফরেইড, উই মে হ্যাভ অ্যা ডিফরেন্ট পজিশনস্। মনে হয়, আমরা দুই বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছি।’ 

তিনি খুব নির্লিপ্তভাবে জানান, ‘ইয়েস, অ্যাজ অ্যা জু, আমি ইসরায়েলের রাষ্ট্র হিসেবে একজিস্ট করার অধিকারকে সমর্থন করি।’ আমি কোনো জবাব না দিয়ে ব্যাকপ্যাক থেকে বের করি ছোট্ট শর্টওয়েভ রেডিও। মিনিট দুয়েকের ভেতর তাতে ‘এন-পি-আর’ বা ‘ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও’র বার্লিন থেকে প্রচারিত ইংরেজি নিউজ শুনতে পাওয়া যায়। 

নিউজ-কাস্টার দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে বলেন যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন আল আকসা মসজিদসংলগ্ন টেম্পল মাউন্টেন ভিজিট করতে আসলে জেরুজালেমে রায়টের সূত্রপাত হয়। গেল পাঁচ দিনের সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন, আর আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮৮৫ জন ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ। আহত-নিহতদের বেশির ভাগই বয়সের দিক থেকে তরুণ ও কিশোর। এদের অনেকে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ইসরায়েলি সৈনিকদের দিকে পাথর ছুড়তে গিয়ে লাইভ বুলেটের আঘাতে খুন কিংবা জখম হয়। 

বিবরণের শেষ দিকে নিউজ-কাস্টার আজকের একটি ঘটনার ওপর বিশেষভাবে ফোকাস করেন। পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে বাজার থেকে সওদাপাতি নিয়ে বাবার সঙ্গে ফিরছিল আট বছরের বালক মোহাম্মদ আল ডোরাহ। সড়কে প্রতিবাদী মিছিল চলছে। ইসরায়েলি হেলিকপ্টার উড়ে আসলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। 

হেলিকপ্টারের জানালা থেকে স্নাইপাররা দালানকোঠা, ঘরদুয়ারের আড়ালে আশ্রয় নেয়া তরুণদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। মোহাম্মদ আল ডোরাহের বাবা ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়েন। হেলিকপ্টার উড়ে আসে তাঁর মাথার ওপর। আল ডোরাহ তার বাবার পেছনে কোটের প্রান্ত খামচে ধরে মাথা নিচু করে লুকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু স্নাইপারের গুলি এসে তার ঘাড়ে লাগে। শিশুটির ললিপপ কামড়ে থাকা নিহত দেহের ছবি ছাপা হয়েছে ইউরোপের পত্রপত্রিকায়। 

সংবাদভাষ্যটি শেষ হওয়ার আগেই ধড়মড় করে উঠে পড়েন মিসেস এলিশেভা গারফিংকেল। তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অকওয়ার্ডভাবে বিদায় নিলে আমি বলি, ‘সরি, মিসেস গারফিংকেল, আশা করি এ ধরনের সেনসেটিভ নিউজ শুনিয়ে আমি আপনাকে আপসেট করে দিইনি।’ 

তিনি আমার মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়ে চলে যেতে থাকেন টার্মিনালের অন্যদিকে। খানিক পর দেখি, মিসেস এলিশেভা আবার ফিরে আসছেন আমার বেঞ্চের দিকে। তাঁকে আরও বয়স্ক দেখায়। নড়বড়ে ফার্নিচারের মতো ঝুরঝুরে দেহকাঠামো নিয়ে তিনি আমার পাশে বসেন, কাঁপা দুই হাত নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বলেন, ‘সরি ফর শোয়িং ইমোশন। তুমি কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা বিষয় কিন্তু বলতে হয়।’ 

আমি নীরবে তাঁর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করি। তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নাৎসি জার্মানরা ইহুদিদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল, ঠিক একইভাবে বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।’ 

আমি এবার জানতে চাই, ‘মিসেস গারফিংকেল, জার্মানিতে হলোকাস্টের সময় ইহুদিদের জীবনে যা ঘটেছিল, সে সম্পর্কে প্রচলিত অথেনটিক কোনো কাহিনি আপনি কারও কাছে শুনেছেন কি?’ তিনি জবাব দেন, ‘এ বিষয়কে ঠিক কাহিনি বলা যায় না। আমার জীবদ্দশায়ই তো এসব ঘটেছিল। ১৯৩৩ সালে যে বছর নাৎসিরা ইহুদিদের দোকানপাট বয়কট করল, সে বছর আমার জন্ম হয় এ ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। আমার গ্র্যান্ডফাদারের ছিল জুয়েলারির দোকান, গারফিংকেলরা শত বছর ধরে ডায়মন্ডের ব্যবসা করে আসছে। আমার গ্র্যান্ডফাদার ছিলেন প্লাটিনাম বা হোয়াইট গোল্ডে ডায়মন্ড সেটিংয়ের ব্যাপারে স্পেশালিস্ট। আমার বাবা ও কাকা ছিলেন যথাক্রমে ডাক্তার ও আইনজীবী। তাঁরা পরিবারের বংশগত জুয়েলারি ব্যবসায় যাননি। ১৯৩৬ সালে জার্মানিতে ইহুদিদের পেশাগত চাকরি-বাকরি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। তো দুজনে বেকার জীবনযাপন শুরু করেন।’ 

মিসেস এলিশেভা এবার বোতলের জল দিয়ে ক্লনোপিন বলে একটি ট্র্যাংকুলাইজার ট্যাবলেট নেন। তারপর দীর্ঘ পজ নিয়ে আমার দিকে তাকান। আমি জানতে চাই, ‘আপনার পরিবারের সবাই কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর অবধি বেঁচে ছিলেন?’ 

যেন খুব স্টুপিড ডাম্ব একটি প্রশ্ন করেছি, এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাগরিক হিসেবে বসবাস করত জুইশ সম্প্রদায়ের ৫ লাখ ২২ হাজার মানুষ। ১৯৪৩ সালে নাৎসিরা জুডেনরেইন বা ক্লিনিং অব জুজ অভিযান শুরু করলে, কেবল ২ লাখ ১৪ হাজার ইহুদি জার্মানি থেকে পালিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ বা আমেরিকায় শরণার্থী হওয়ার সুযোগ পায়। বাকিদের কেউই গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর নিয়তি থেকে রেহাই পায়নি। আমার বাবা-কাকা-মা-মাসি সবাই এ পরিসংখ্যানের অন্তর্গত।’ 

মিসেস এলিশেভা গারফিংকেল এবার উঠে পড়তে পড়তে বলেন, ‘আই হোপ নাউ ইউ উড আন্ডারস্ট্যান্ড... ইহুদি সম্প্রদায় কেন মরিয়া হয়ে একটি রাষ্ট্র চায়, ইসরায়েলের অস্তিত্ব না থাকলে আমাদের যাওয়ার যে আর কোনো স্থান নেই। উই আর সো ভেরি মাচ ডেসপারেট!’ তিনি গুডবাই না বলে বেঞ্চ ছেড়ে চলে যান এক্সিট সাইনের নিশানা ধরে। 

ওয়ারশ যাওয়ার নাইট ট্রেনে বসে আমি মনে মনে মিসেস এলিশেভা গারফিংকেলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খুব নার্ভাস লাগছিল। অনেক দিন ধরে আমি ট্রাভেল করছি, কিন্তু নতুন কোনো দেশে যেতে হলে আমার অস্থির লাগে, বর্ডার ক্রসিং ম্যানেজ করতে পারব কি না তা ভেবে তীব্র আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করি। 

বিকেলে একটি নির্জন লাইব্রেরিতে বসে ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গ নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখতে চেষ্টা করেছি। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিষয়টি হাইলাইট করতে গিয়ে মনে জলছাপের মতো ভেসে গেছে মিসেস গারফিংকেলের করুণ—বয়সের ভারে জীর্ণ মুখাবয়ব। তাঁর সঙ্গে একত্রে ওয়ারশ অবধি ট্রাভেল করা সহজ নাও হতে পারে? 


এসব উদ্বেগ থেকে মনকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য, আমি ম্যাক্স আরন্সট্ বলে এক পরাবাস্তববাদী চিত্রকরের পেইন্টিংঅলা বইয়ের পাতা উল্টাই। শিল্পী শুধু কয়েকটি টপ-হ্যাট দিয়ে তৈরি করেছেন বিচিত্র মনুষ্য ফিগার, আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তীব্র স্ট্রেসের সময় পরাবাস্তবাদী কোনো চিত্র অবলোকন করলে তা খানিকটা লাগব হয়। সুতরাং, আমি পাতা উল্টিয়ে তেলের পিপা ব্যবহার করে তাঁর আঁকা ‘মেকানিক্যাল হাতি’র ছবির পাতায় জন্তুটির হোজ পাইপের মতো শুঁড় আঙুল দিয়ে বারবার স্পর্শ করি। 

 তখনই মিসেস গারফিংকেল এসে লাইব্রেরির রিডিংরুমে ঢোকেন। তো আমি চিত্রকলার বইখানা শোল্ডারব্যাগের নিচে ঠেলে দিয়ে লুকিয়ে ফেলি। কেন জানি মনে হয়—আমি মেকানিক্যাল হাতির অদ্ভুত আকৃতির দিকে তাকিয়ে আছি দেখতে পেলে, হয়তো মিসেস এলিশেভা আমাকে রীতিমতো উইয়ার্ড বা কিম্ভূত রুচির লোক বলে ভাববেন। 

মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসেন। আবার কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পদ্ম ফুলের স্নিগ্ধ ইমেজের কথা মনে পড়ে। তিনি জানতে চান, ‘তুমি কি আমাদের পারিবারিক কয়েক পুরুষের বসতবাড়ির ছবি দেখবে?’ 

ঘাড় হেলিয়ে সায় দিই। তিনি ব্যাগের জিপার খুলে বের করেন বেলারুশিয়ার ইহুদি চিত্রশিল্পী মার্ক শ্যাগালের ছবির রঙিন প্লেটওয়ালা একটি বড়সড় পেইন্টিংয়ের বই। তার ভেতরে বুকমার্কের মতো গুঁজে রাখা দুটি সাদাকালো ফটোগ্রাফ। তা বের করে আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এ তিনতলা বাড়িটি আমার গ্র্যান্ডফাদারের আগের প্রজন্মের পূর্বপুরুষ ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে তৈরি করান ১৮৩২ সালে।’ 

আমি বিশাল ঝাড়বাতিওয়ালা হলকামরার ইনটেরিওরের ছবিটি হাতে নিয়ে, তাতে রাখা ঝাপসা হয়ে আসা গ্র্যান্ড পিয়ানোর দিকে তাকাই। জানতে চাই, ‘বাড়িটি এখনো আছে কি?’ তিনি জবাব দেন, ‘১৯৪৩ সালের মে মাস অবধি এ বাড়িতে আমার গ্র্যান্ডফাদার বসবাস করতেন। জুলাই মাসে পরিবারের সবাইকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেয়া হয়। তার পরের বছর মিত্রশক্তির বোমাবর্ষণে বাড়িটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।’ লাইব্রেরিতে নীরবতা বজায় রাখতে হয়। তো কথাবার্তা না বলে অতঃপর নীরব ইশারায় গুডবাই বলে উঠে যান মিসেস গারফিংকেল। 

সন্ধ্যার পর, আলাদা আলাদাভাবে আমরা এসে পৌঁছাই স্টেশনে। একটি ডাবল কুপের রিজার্ভ করা কামরায় টিকিটের নাম্বার মিলিয়ে আমরা বসি। ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ ডুয়িং’ বলে মহিলা খুলে বসেন মার্ক শ্যাগালের চিত্রকলার বইটি। তিনি মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখছেন। গ্রন্থটি আকারে বিশাল, সিটে পৃষ্ঠা দুটি ছড়িয়ে দেয়ায় আমিও চিত্রের কালার-প্লেটগুলো দেখার সুযোগ পাই। ‘দ্য পোয়েট’, এবং ‘ফিডলার’ বা ‘বেহালাবাদক’ শিরোনামের ছবিগুলোর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ‘কাউ উইথ প্যারাসল’, বা ‘ছাতা মাথায় গরু’র ছবির পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকিয়ে থাকেন তিনি। পরাবাস্তববাদী কেতার এ চিত্রটি সত্যিই বিচিত্র। একটি গরু তার নীল বর্ণের মুখমণ্ডলে তীব্র বিষাদ ফুটিয়ে, সামনের পা বাঁকা করে খুরে ধরে আছে কারুকাজ করা একটি ছাতা। 

তার দিকে তাকাতে তাকাতে মিসেস এলিশেভা যেন জনান্তিকে কথা বলেন, ‘আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে আমি এ ট্রেনে চড়ে ওয়ারশতে যাই। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। খুব স্ট্রেস হচ্ছিল। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার জার্মান ন্যানি বা আয়া আমাকে স্লিপিং পিল দিয়ে ঘুম পাড়াতে চাচ্ছিল। এ ট্রেনের কথা ভাবলেই কেমন জানি উদ্বেগ লাগে।’ 

মহিলা বোতল থেকে গলায় জল ঢেলে ক্লনোপিন বলে একটি অ্যান্টি অ্যাংজাইটি পিল নেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন, ‘মনে দুশ্চিন্তা হলে, মার্ক শ্যাগালের চিত্রের মতো উপকারী আর কিছু নেই।’ 

আমি জানালার কাচে তাঁর প্রতিফলনের দিকে তাকাই। ওখানে আমাদের দুজনের ছায়া প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। আমাদের চেহারাসুরত, বয়স ও জেন্ডারে বিস্তর পার্থক্য। কিন্তু কোথায় যেন—আত্মবিশ্বাসের অভাবে, কিংবা চিত্রকলার রুচিতে খানিকটা মিল আছে। এ বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে আমি খুব অবাক হই! 

একটু রাত হলে মহিলা তাঁর নড়বড়ে শরীর নিয়ে আপার বার্থে উঠতে যান। পা ফসকে পড়ে গিয়ে যদি হাত-পা ভাঙেন, এ আতঙ্কে আমি বলি যে ‘মিসেস গারফিংকেল, আপনি কাইন্ডলি নিচে ঘুমান, আমি ওপরের বার্থে উঠছি।’ কিন্তু কিছুতেই তিনি তাতে রাজি হন না। পা বাঁকিয়ে-চুরিয়ে বাতব্যাধিগ্রস্ত মহিলা কাতরানোর ধ্বনি করে, ওপরের বার্থে কোনোক্রমে উঠে শুয়ে পড়ে মৃদুস্বরে কোঁকান। 

 বেশ রাতে ট্রেন থামে। বর্ডার পুলিশের বুটের শব্দে ঘুম ভাঙে। মনে হয়, পুলিশ যুগলের একজন জার্মান আর অন্যজন পোলিশ। তাঁরা আমার পাসপোর্ট চেক করে মিসেস এলিশেভাকে জাগাতে যান। কিন্তু । অ্যান্টি অ্যাংজাইটি পিল খেয়ে মহিলা ঘুমিয়েছেন। জার্মান কিংবা পোলিশ ভাষার ডাকাডাকিতে তাঁর ঘুম ভাঙে না। আমার টেনশন লাগে। আমি নিচের বার্থে জড়সড় হয়ে বসে তাঁর নাক ডাকার শব্দ শুনি। 

মহিলা তাঁর বালিশের পাশে আমেরিকান পাসপোর্ট রেখে ঘুমিয়েছেন। পুলিশ তা তুলে নিয়ে খুলে দেখে তা বালিশের পাশে রেখে বেরিয়ে যায়। বর্ডার চেকিং সারা হলে—ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসেন মিসেস এলিশেভা। পরিষ্কার বুঝতে পারি, তিনি এতক্ষণ মটকা মেরে পড়ে ছিলেন। 

আমাকে ডেকে তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে দিতে বলেন। পানি দিতে গেলে তিনি ফিক করে হেসে বলেন, ‘১০ বছর বয়সে যখন জার্মান ন্যানির সঙ্গে এ ট্রেনে করে ওয়ারশতে পালিয়ে যাই, তখনও ঘুমের ভান করে এ রকম আপার বার্থে শুয়েছিলাম। ন্যানি বর্ডার-পুলিশকে বোঝায় যে—আমার শরীর খারাপ। ন্যানি চাচ্ছিল না যে আমার সঙ্গে পুলিশের সরাসরি কোনো কথা হোক। কারণ আমার চেহারা দেখে যদি নাৎসি পুলিশ আমাকে জুইশ গার্ল বলে সন্দেহ করে!’ তিনি বোতলের জল দিয়ে আবার একটি অ্যান্টি অ্যাংজাইটি পিল নেন। 

ওয়ারশতে নেমে আমি তাঁর কাছে বিদায় নিতে গেলে তিনি আমার দিকে একটুক্ষণ নিরিখ করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বিদায় সম্ভাষণের কোনো জবাব না দিয়ে, তাঁর নড়বড়ে শরীরে ভারী ব্যাগ জাপটে ধরে সোজা হেঁটে যান ট্যাক্সির দিকে। আমি ওয়ারশ স্টেশনে অসহায় হালতে দাঁড়িয়ে থাকি। 

 (চলবে)

আরো পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।

মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।

মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।

নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল যেন তাঁর দীর্ঘ কোনো বাক্যের সমাপ্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ছবি: সংগৃহীত

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।

১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।

তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।

ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।

তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।

২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।

চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।

তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১০
সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের কলম

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।

লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।

লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।

‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।

এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত