খান মুহাম্মদ রুমেল
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে। তার পাখায় ঝিলিক দিচ্ছে নীলাভ আভা। বকটা উড়তে উড়তে একসময় নেমে আসে তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো—একেবারে চোখবরাবর। যেন সুচালো নখের আঁচড়ে তুলে নেবে চোখ জোড়া। অথবা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তখন। চাইলেও সরে যাওয়া যায় না। পা দুটো যেন জমে পাথর হয়ে যায়। অথবা মনে হয় মাঠের বয়সী জামগাছটার শক্ত শেকড়ের মতো মাটির অনেক গভীরে দেবে গেছে পা জোড়া। ধারালো নখের তীব্র আক্রমণের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বকটা নেমে আসছে…শো শো শব্দ বেড়েই চলেছে!
তুহিনের বালিশের পাশে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তুলে কাঁপছে তার সেলফোনটা। খ্যাপা লাল ষাঁড়কে আঁটোদড়িতে বেঁধে রাখলে বাঁধন ছেঁড়ার জন্য পাক খেয়ে যেমন ঘুরতে থাকে—চরম কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে সেই রকম করে ঘুরছে ফোনটা। কিন্তু বেশি দূর যেতেও পারছে না। ঘুম ভেঙে যায় তুহিনের। স্বপ্ন দেখছিল সে। সেই পুরোনো স্বপ্ন। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বপ্নটা দেখছে সে। বেশির ভাগ সময় ভোরের দিকে, না হয় সকালের দিকেই স্বপ্নটা দেখে সে। কিন্তু স্বপ্নের শেষটা আজ পর্যন্ত দেখা হলো না। কোনো না কোনো বাগড়া বাধেই। আজ যেমন ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনো দিন হয়তো পেপারওয়ালা এসে কলবেল বাজায়। কোনো দিন হয়তো নিচের রাস্তায় চেঁচিয়ে ওঠে তালাচাবিওয়ালা! কিংবা কোনো দিন দেখা যায় একটা মাইক নিয়ে নেমে পড়েছে কেউ। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প অথবা কোনো রাজনৈতিক সভার প্রচার চালাচ্ছে গলা ফাটিয়ে!
এদিকে অনেকক্ষণ কেঁপে কেঁপে থেমে গেছে ফোনটা। হাতে নিয়ে তুহিন দেখে সাতটা মিসড কল। তিনটা অফিস কলিগদের। অথচ আজকে ছুটির দিন। অফিস থেকে কেন ফোন আসবে? খুব বিরক্ত লাগে তার। বাকি চারটা ফোন আবিদের। আবিদ তার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খুব মাখামাখি বন্ধুত্ব ছিল। পরে ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। একই শহরে থেকেও যোগাযোগটা কেমন আলগা হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ বিরতিতে যখনই কথা হয়, পুরোনো সেই উচ্ছ্বাসটা ঠিকই ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আজকে এই ছুটির দিনের ভোরে আবিদ হঠাৎ কেন এতবার ফোন করল, ভেবে পায় না তুহিন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোর ঘরে! এত বেলা হয়ে গেছে? নিজের কাছেই কিছুটা লজ্জা লাগে তার। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না সে। যত রাত করেই ঘুমাক, ঠিকই সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে সে।
বিছানায় শুয়েই আবিদকে ফোন করে তুহিন। রিং হয়। একবার, দুবার, তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে আবিদ।
হ্যালো
কী রে! সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। তোর কোনো খবরই নাই।
ঘুমাচ্ছিলাম দোস্ত।
এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস? তোর না আগে ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল!
এত সকালে ফোন দিয়েছিলি কেন?
একটা খারাপ খবর আছে দোস্ত।
কতটা খারাপ? হয়েছে কী, বল তো?
দোস্ত, তুলি মারা গেছে!
তুলি? কোন তুলি? সমাজবিজ্ঞানের?
হুম।
হায় আল্লাহ, কী বলিস? কীভাবে মারা গেল?
আত্মহত্যা করেছে!
কী বলছিস এসব? তুলি কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? কী যা-তা বলছিস?
এত কথা বলতে পারব না। আমি আছি তুলির বাসায়। তুই পারলে আয়।
ফোন কেটে দেয় আবিদ। নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ পাথরের মতো বসে থাকে তুহিন। এটা কেমন কথা। তুলি কেন মরে যাবে? কেন আত্মহত্যা করবে তুলির মতো একটা মেয়ে। খরস্রোতা নদীর মতো সারাক্ষণ কলকল করে বয়ে চলা তুলি, জোছনার নরম আলোর মতো মায়া হয়ে ছড়িয়ে থাকা তুলি, ঝরনাজলের মতো প্রবল বেগে আছড়ে পড়া তুলি কেন নিজেকে শেষ করে দেবে? কেন তার কাছে এই দুনিয়াটাকে নরক মনে হবে? কেন মনে হবে এখানে আর থাকা যাবে না? কেন সে জীবনের ছেদবিন্দু টেনে দেবে এই অসময়ে? মেলে না, কিছুতেই হিসাব মেলে না তুহিনের।
তুহিনরা পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তুলি সমাজবিজ্ঞানে। ফিলোসফির সাবসিডিয়ারি কোর্সে দেখা হতো তাদের। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব। পুরো ক্যাম্পাসজীবনের তুলিকে দেখেছে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হিসেবে। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। প্রায়ই হল থেকে তাদের জন্য এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে আসত তুলি। খুব ভালো রান্না করত মেয়েটা। তবে একদিন দুষ্টুমি করে রসি বলেছিল—কী সব রান্না করে আনিস, মুখে দেয়া যায় না! তখন তুলি কোনো কথা বলেনি। হেসেছে বরং। কিন্তু পরে তারা শুনেছে ইফফাতের কাছে—কমনরুমে গিয়ে নাকি কেঁদে ভাসিয়েছে তুলি। হল প্রভোস্টের চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমের হিটার জ্বালিয়ে বন্ধুদের জন্য শখ করে রান্না করে আনে সে—আর এটা নিয়ে বন্ধুরা এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল? না হয় তার রান্না খারাপই! তাই বলে মুখের ওপর এমন করে বলবে? তুলি ভেতরে ভেতরে অনেক অভিমানী ছিল। সেই অভিমানটা টের পেত না বেশির ভাগ মানুষ। আসলে এমনই হয়। আমরা সবাই বাইরের মানুষটাকে দেখি। একটা মানুষের ভেতরের আনন্দ, বেদনা, বিরহ, যাতনা—এসব আমরা খতিয়ে দেখি না বা দেখার চেষ্টা করি না। বোঝার-জানার চেষ্টা করি না।
দ্রুত রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তুহিন। রাই বাসায় নেই অনেক দিন হলো। সেই যে এক বিকেলে বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে আর আসার নাম নেই। এর আগেও এমন হয়েছে—রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে রাই। কিন্তু ফিরে এসেছে দুয়েক দিন পরই। এবার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে তবু ফেরার নাম নেই। রাই চলে যাওয়ার এক দিন পরই ফোন করে তাকে ফেরার অনুরোধ করেছে তুহিন। কিন্তু কিছুতেই কাজ না হলে এক সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিল রাইদের ধানমন্ডির বাসায়। রাই খুব হেসে হেসে কথা বলেছে তুহিনের সঙ্গে। আদর-যত্ন করে রাতের খাবার খাইয়েছে। কিন্তু যেই তুহিন বাসায় ফেরার কথা বলেছে—ওমনি বেঁকে বসেছে রাই। কিছুতেই ফিরবে না সে। রাইয়ের মাকে বলেছে তুহিন—ওকে আমার সঙ্গে আসতে বলেন আম্মা। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই বোঝো, আমি এখানে কী বলব, বলো?—এটুকু বলেই কথা সেরেছেন সাবেরা বেগম। ফলে আর কথা বাড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে নীরবে। শুধু ফেরার পথে কী মনে করে তাকিয়েছে পেছন ফিরে। চোখে পড়েছে দোতলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই। কেমন যেন ক্লান্ত-অলস লাগে রাইকে। একবার মনে হয়েছে ফিরে গিয়ে আবার অনুরোধ করে রাইকে। কিন্তু আর দাঁড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে দ্রুত পায়ে। এখন রাইয়ের অনুপস্থিতিতে কিছুই ঠিকঠাক মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। সকালের নাশতাও বাদ গেল মাসখানেক ধরে। আর আজকে তো নাশতা করে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই আসে না। ছুটির দিনের সকালের রাস্তা বেশ ফাঁকা। সহজেই একটা রিকশা পেয়ে যায়। মোবাইল ফোনে আবিদের এসএমএস। তুলির বাসার ঠিকানা লেখা। আদাবরে পৌঁছে বাসাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। একটা সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে মারা গেছে, আত্মহত্যা করেছে গত রাতের কোনো এক সময়—এটা এলাকার কারও জানতে বাকি নেই। ভাড়া দিয়ে ধীরপায়ে রিকশা থেকে নামে তুহিন। এগিয়ে আসে আবিদ। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকত তুলি। তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা এখন পুলিশের দখলে। মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে তারা। লাশের সুরতহাল করা হবে এখন। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তুলিকে। সাততলা বাড়িটার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। জটলা করে আছেন দুনিয়ার মানুষ। সেই ভিড়ের এক কোনায় বন্ধুদের দেখতে পায় তুহিন। একটা নিচু দেয়ালের ওপর স্থবির হয়ে বসে আছে সুতপা। তার ঠিক পাশে রাস্তার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রফিক। অন্য বন্ধুরা আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবিদকে দেখা যায় না কোথাও। ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় তুহিন। সুতপার চোখে জল। লাল হয়ে আছে রফিকের চোখ। তুহিনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুতপা। তার পাশে বসে আলতো করে হাত রাখে তুহিন বন্ধুর কাঁধে। সুতপার কান্না আরও বেড়ে যায়। পৃথিবীর সব জল যেন আজ নেমে আসবে সুতপার চোখ বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে সুতপা—গতকাল বিকেলেও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল তুলির সঙ্গে। আমাদের আজ সকালে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটি নিয়ে আলাপ করার জন্য রাতে আবার ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেনি তুলি। তারপর সকালবেলা ওর বাসায় এসে বারবার নক করার পরও দরজা খুলছিল না সে। তখন দারোয়ানকে ডেকে আনা হয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এরপর পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলে ঝুলতে দেখা যায় তুলিকে। ফ্যানের সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সুতপা। আমাদের তুলি, কেন এভাবে চলে যাবে? কী এমন কষ্ট ছিল রে তুলি তোর মনে? আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সুতপা। ওর কান্না দেখে চোখ মোছে অন্য বন্ধুরা। আশপাশে জড়ো হওয়া কারও কারও চোখেও দেখা যায় জল। তুহিনের কেবল কান্না পায় না। চোখে জল নামে না। তবে ভেঙে যেতে থাকে বুকের ভেতরটা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দশ বছর আগের এক ঝলমলে সকাল। না গরম, না শীতের সেই সকালটায় সূর্যিত-রাঙা হয়েছিল চারপাশ। শেষ রাতের শিশির পড়ে গাছের পাতাগুলো ছিল ভেজা ভেজা। তুহিনরা দাঁড়িয়ে ছিল কলাভবনের করিডরে। ফিলোসফি সাবসিডিয়ারি ক্লাসের জন্য অপেক্ষা। তুহিন, আবিদ এবং রসি দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিল। এমন সময় কলকল-ছলছল করতে করতে এসেছিল সুতপা আর তুলি। প্রথম দিনের ক্লাসে তুহিনদের সঙ্গে বসেছিল তারা দুজন। প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাদের। এরপর সেই বন্ধুত্বের গাছ বড় হয়েছে দিনে দিনে। ডালপালা মেলেছে ক্যাম্পাসজুড়ে। বন্ধুত্বের মালায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন নাম। এরপর কত অর্থহীন আড্ডায়, কত কাজে-অকাজে, কত জানা-অজানায়, কত রাগে-অনুরাগে, কত মান-অভিমানে, কত ঝগড়া-বিষাদে, কত আনন্দ-দুঃখে, কত ব্যথা-অনুভবে, কত হর্ষ-উল্লাসে কেটেছে তাদের একেকটি দিন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যাত্রা কত দিন মাঝরাত ছুঁয়েছে। কত দিন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে পুড়েছি, শীতে কেঁপেছি। আজ আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল তুলি! কেন চলে যেতে হলো তাকে—ভাবনার ঝড় চলে তুহিনের মনের ভেতর।
আবিদ কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, টের পায় না তুহিন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সুতপাকে রুহীর কাছে রেখে তারা দুজন একটু দূরে গিয়ে বসে। কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। একপর্যায়ে কথা বলে তুহিন—তুলির বাসায় আর কে কে থাকে?
তুলি একাই! ছোট্ট উত্তর আবিদের।
তবে আমরা জানি, তুলির সঙ্গে তার বরের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল চার বছর আগে। এরপর থেকে তুলি একাই থাকত বাসায়। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটা এসে থাকত তার সঙ্গে। তুলি একটা ভালো চাকরি করত। একার জীবনে টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হতো না তার। কিন্তু করোনার সময় আচমকা তার চাকরিটা চলে যায়। তবে একবারে অথই সাগরে পড়েনি তুলি। জমানো টাকা দিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছিল সে। বন্ধুদের মধ্যে সুতপার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল তুলি। তুলির পেটের খবর সব ওর জানা। সুতপাও বলছে তুলিকে কখনো হতাশ, বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি তার। তবুও কেন এমন অসময়ে স্বেচ্ছায় চলে গেল সে? এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র দিতে পারত তুলিই। কিন্তু সে তো এখন শুয়ে আছে নিঃসাড় নিজের ঘরের মেঝেতে। একটি সাদা ব্যাগে মুড়ে একটু পর তাকে নামিয়ে আনা হবে নিচে। অন্ধকার হিমঘরে থাকবে হয়তো সারা রাত। অথচ তুলিটা অন্ধকার বড় ভয় পেত।
অনেক রাতের পরে তুলিকে হিমঘরে রেখে তারা সবাই বাড়ির দিকে যাত্রা করে। এর মধ্যে চলে এসেছে তুলির ছোট ভাইটা। এসেছে অন্য স্বজনেরাও। খবর পেয়ে যশোর থেকে রওনা দিয়েছেন তুলির বাবা-মা। সুতপাকে নিতে আসে তার বর। তাদের সঙ্গে যায় রুহী। বাকি বন্ধুরাও যে যার মতো চলে যায়, সকালে আবার আসবে বলে! কী মনে করে যেন তুহিন ফোন করে রাইকে। রিং হয় একবার, দুবার, তিনবার। ফোন রিসিভ করে না রাই। আবিদ কি কিছু বুঝতে পারে?
দোস্ত, চল, আজকে তোর সঙ্গে থাকব। অনেক দিন মন খুলে কথা বলি না আমরা।
আবিদের প্রস্তাবে রাজি হয় তুহিন। দুই বন্ধু হাঁটতে থাকে শহরের পথ ধরে। আদাবর থেকে হাতিরপুল অনেকটা পথ। তারা দুজন হাঁটছে ধীরপায়ে। আকাশে সেদিন চাঁদ ছিল না। একেবারে নিকষ কালো আকাশে ছিল না কোনো তারাও।
প্রায় শেষরাতের দিকে আবিদ আর তুহিনকে দেখা যায় বসে আছে বারান্দায়। বেতের চেয়ারটাতে বসে একটু একটু করে দুলছে আবিদ। তুহিন বসে আছে একটা মোড়ায়।
পাভেলের কথা মনে আছে তোর? আবিদের কথার উত্তরে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে তুহিন।
তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ। শেষ রাতের এই সময়টাতে আকাশের গুমোট কেটে গিয়ে বসেছে লক্ষ তারার মেলা। বাতাস বইছে ধীরে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে।
পাভেল যেদিন মারা গেল, সেদিনও আজকের মতোই ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিলি তুই। রাতের নীরবতা ভেঙে কথাটা বলে তুহিন। আবিদ কিছুই বলে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বহু দূরে তাকিয়ে থাকে শূন্য চোখে।
আমরা জানি, তাদের প্রিয় বন্ধু পাভেল অনার্স শেষের পরই চলে গিয়েছিল নিউইয়র্ক। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ভালো জমিয়ে তুলেছিল। কিন্তু কী করে যেন মার্কিন মুলুকে কিডনির রোগ বাঁধিয়ে ফেলে পাভেল। অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎসার পর কোনো এক গভীর রাতে নিউইয়র্কের কোনো এক হাসপাতালে নীরব-নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় তার।
আচ্ছা আবিদ তুই কি জানিস, পাভেল তুলিকে খুব ভালোবাসত? প্রেম ছিল তাদের দুজনের!
হুম জানি। এ-ও জানি, এক দুপুরে তারা ঠিক করেছিল—বিয়ে করে ফেলবে। এরপর সেই সারাটা দুপুর তারা পুরো নিউমার্কেট চষে ঘর-গৃহস্থালির জিনিস কিনেছিল। রাতুলের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকাও ধার নিয়েছিল পাভেল। বিয়ের সময় কিছু টাকাপয়সা হাতে রাখা দরকার। কিন্তু কী কারণে জানি পরে আর বিয়েটা হয়নি।
সমবয়সীকে বিয়ে করবে তুলি—এটা তার বাবা মা কিছুতেই চায়নি। আর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে কোনো মতেই রাজি হয়নি তুলি।
দুই বন্ধুর আলাপ এরপর আর এগোয় না। যেন তাদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে। অথবা কোনো অচেনা স্টেশনে বসে আছে দুজন অপরিচিত কোনো লোক। যেন তুহিন আর আবিদ কেউ কাউকে চেনে না। অথবা তারা দুজন মানুষ সম্পূর্ণ বোবা মানুষ। তাদের কোনো ভাষা নেই। এভাবে কাটে অনেকটা সময়। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। এরপর কাছের মসজিদগুলো থেকেও একের পর আসতে থাকে আজানের সুমধুর সুর।
এই সময় আমরা দেখি আজন্মের নীরবতা ভেঙে গলা ছেড়ে কাঁদছে আবিদ আর তুহিন। তুমুল তারুণ্যের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন দশ বছর আগেই পেছনে ফেলে এসেছে তারা। অথচ সেই সব দিনের স্মৃতি একের পর পর সতেজ-সজীব-জীবন্ত হয়ে ভাসছে তাদের চোখে। বুক ভেসে যায় দুজনের অকাল মৃত দুই বন্ধুর জন্য। যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছিল কিন্তু কেউ কারও হয়নি। আর তিন বছরের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দুজনেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। আহারে তুলি! আহারে পাভেল!
জীবন কেন সব সময় জয়ের বন্দরে ভেড়ে না!
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে। তার পাখায় ঝিলিক দিচ্ছে নীলাভ আভা। বকটা উড়তে উড়তে একসময় নেমে আসে তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো—একেবারে চোখবরাবর। যেন সুচালো নখের আঁচড়ে তুলে নেবে চোখ জোড়া। অথবা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তখন। চাইলেও সরে যাওয়া যায় না। পা দুটো যেন জমে পাথর হয়ে যায়। অথবা মনে হয় মাঠের বয়সী জামগাছটার শক্ত শেকড়ের মতো মাটির অনেক গভীরে দেবে গেছে পা জোড়া। ধারালো নখের তীব্র আক্রমণের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বকটা নেমে আসছে…শো শো শব্দ বেড়েই চলেছে!
তুহিনের বালিশের পাশে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তুলে কাঁপছে তার সেলফোনটা। খ্যাপা লাল ষাঁড়কে আঁটোদড়িতে বেঁধে রাখলে বাঁধন ছেঁড়ার জন্য পাক খেয়ে যেমন ঘুরতে থাকে—চরম কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে সেই রকম করে ঘুরছে ফোনটা। কিন্তু বেশি দূর যেতেও পারছে না। ঘুম ভেঙে যায় তুহিনের। স্বপ্ন দেখছিল সে। সেই পুরোনো স্বপ্ন। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বপ্নটা দেখছে সে। বেশির ভাগ সময় ভোরের দিকে, না হয় সকালের দিকেই স্বপ্নটা দেখে সে। কিন্তু স্বপ্নের শেষটা আজ পর্যন্ত দেখা হলো না। কোনো না কোনো বাগড়া বাধেই। আজ যেমন ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনো দিন হয়তো পেপারওয়ালা এসে কলবেল বাজায়। কোনো দিন হয়তো নিচের রাস্তায় চেঁচিয়ে ওঠে তালাচাবিওয়ালা! কিংবা কোনো দিন দেখা যায় একটা মাইক নিয়ে নেমে পড়েছে কেউ। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প অথবা কোনো রাজনৈতিক সভার প্রচার চালাচ্ছে গলা ফাটিয়ে!
এদিকে অনেকক্ষণ কেঁপে কেঁপে থেমে গেছে ফোনটা। হাতে নিয়ে তুহিন দেখে সাতটা মিসড কল। তিনটা অফিস কলিগদের। অথচ আজকে ছুটির দিন। অফিস থেকে কেন ফোন আসবে? খুব বিরক্ত লাগে তার। বাকি চারটা ফোন আবিদের। আবিদ তার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খুব মাখামাখি বন্ধুত্ব ছিল। পরে ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। একই শহরে থেকেও যোগাযোগটা কেমন আলগা হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ বিরতিতে যখনই কথা হয়, পুরোনো সেই উচ্ছ্বাসটা ঠিকই ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আজকে এই ছুটির দিনের ভোরে আবিদ হঠাৎ কেন এতবার ফোন করল, ভেবে পায় না তুহিন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোর ঘরে! এত বেলা হয়ে গেছে? নিজের কাছেই কিছুটা লজ্জা লাগে তার। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না সে। যত রাত করেই ঘুমাক, ঠিকই সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে সে।
বিছানায় শুয়েই আবিদকে ফোন করে তুহিন। রিং হয়। একবার, দুবার, তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে আবিদ।
হ্যালো
কী রে! সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। তোর কোনো খবরই নাই।
ঘুমাচ্ছিলাম দোস্ত।
এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস? তোর না আগে ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল!
এত সকালে ফোন দিয়েছিলি কেন?
একটা খারাপ খবর আছে দোস্ত।
কতটা খারাপ? হয়েছে কী, বল তো?
দোস্ত, তুলি মারা গেছে!
তুলি? কোন তুলি? সমাজবিজ্ঞানের?
হুম।
হায় আল্লাহ, কী বলিস? কীভাবে মারা গেল?
আত্মহত্যা করেছে!
কী বলছিস এসব? তুলি কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? কী যা-তা বলছিস?
এত কথা বলতে পারব না। আমি আছি তুলির বাসায়। তুই পারলে আয়।
ফোন কেটে দেয় আবিদ। নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ পাথরের মতো বসে থাকে তুহিন। এটা কেমন কথা। তুলি কেন মরে যাবে? কেন আত্মহত্যা করবে তুলির মতো একটা মেয়ে। খরস্রোতা নদীর মতো সারাক্ষণ কলকল করে বয়ে চলা তুলি, জোছনার নরম আলোর মতো মায়া হয়ে ছড়িয়ে থাকা তুলি, ঝরনাজলের মতো প্রবল বেগে আছড়ে পড়া তুলি কেন নিজেকে শেষ করে দেবে? কেন তার কাছে এই দুনিয়াটাকে নরক মনে হবে? কেন মনে হবে এখানে আর থাকা যাবে না? কেন সে জীবনের ছেদবিন্দু টেনে দেবে এই অসময়ে? মেলে না, কিছুতেই হিসাব মেলে না তুহিনের।
তুহিনরা পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তুলি সমাজবিজ্ঞানে। ফিলোসফির সাবসিডিয়ারি কোর্সে দেখা হতো তাদের। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব। পুরো ক্যাম্পাসজীবনের তুলিকে দেখেছে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হিসেবে। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। প্রায়ই হল থেকে তাদের জন্য এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে আসত তুলি। খুব ভালো রান্না করত মেয়েটা। তবে একদিন দুষ্টুমি করে রসি বলেছিল—কী সব রান্না করে আনিস, মুখে দেয়া যায় না! তখন তুলি কোনো কথা বলেনি। হেসেছে বরং। কিন্তু পরে তারা শুনেছে ইফফাতের কাছে—কমনরুমে গিয়ে নাকি কেঁদে ভাসিয়েছে তুলি। হল প্রভোস্টের চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমের হিটার জ্বালিয়ে বন্ধুদের জন্য শখ করে রান্না করে আনে সে—আর এটা নিয়ে বন্ধুরা এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল? না হয় তার রান্না খারাপই! তাই বলে মুখের ওপর এমন করে বলবে? তুলি ভেতরে ভেতরে অনেক অভিমানী ছিল। সেই অভিমানটা টের পেত না বেশির ভাগ মানুষ। আসলে এমনই হয়। আমরা সবাই বাইরের মানুষটাকে দেখি। একটা মানুষের ভেতরের আনন্দ, বেদনা, বিরহ, যাতনা—এসব আমরা খতিয়ে দেখি না বা দেখার চেষ্টা করি না। বোঝার-জানার চেষ্টা করি না।
দ্রুত রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তুহিন। রাই বাসায় নেই অনেক দিন হলো। সেই যে এক বিকেলে বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে আর আসার নাম নেই। এর আগেও এমন হয়েছে—রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে রাই। কিন্তু ফিরে এসেছে দুয়েক দিন পরই। এবার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে তবু ফেরার নাম নেই। রাই চলে যাওয়ার এক দিন পরই ফোন করে তাকে ফেরার অনুরোধ করেছে তুহিন। কিন্তু কিছুতেই কাজ না হলে এক সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিল রাইদের ধানমন্ডির বাসায়। রাই খুব হেসে হেসে কথা বলেছে তুহিনের সঙ্গে। আদর-যত্ন করে রাতের খাবার খাইয়েছে। কিন্তু যেই তুহিন বাসায় ফেরার কথা বলেছে—ওমনি বেঁকে বসেছে রাই। কিছুতেই ফিরবে না সে। রাইয়ের মাকে বলেছে তুহিন—ওকে আমার সঙ্গে আসতে বলেন আম্মা। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই বোঝো, আমি এখানে কী বলব, বলো?—এটুকু বলেই কথা সেরেছেন সাবেরা বেগম। ফলে আর কথা বাড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে নীরবে। শুধু ফেরার পথে কী মনে করে তাকিয়েছে পেছন ফিরে। চোখে পড়েছে দোতলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই। কেমন যেন ক্লান্ত-অলস লাগে রাইকে। একবার মনে হয়েছে ফিরে গিয়ে আবার অনুরোধ করে রাইকে। কিন্তু আর দাঁড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে দ্রুত পায়ে। এখন রাইয়ের অনুপস্থিতিতে কিছুই ঠিকঠাক মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। সকালের নাশতাও বাদ গেল মাসখানেক ধরে। আর আজকে তো নাশতা করে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই আসে না। ছুটির দিনের সকালের রাস্তা বেশ ফাঁকা। সহজেই একটা রিকশা পেয়ে যায়। মোবাইল ফোনে আবিদের এসএমএস। তুলির বাসার ঠিকানা লেখা। আদাবরে পৌঁছে বাসাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। একটা সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে মারা গেছে, আত্মহত্যা করেছে গত রাতের কোনো এক সময়—এটা এলাকার কারও জানতে বাকি নেই। ভাড়া দিয়ে ধীরপায়ে রিকশা থেকে নামে তুহিন। এগিয়ে আসে আবিদ। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকত তুলি। তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা এখন পুলিশের দখলে। মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে তারা। লাশের সুরতহাল করা হবে এখন। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তুলিকে। সাততলা বাড়িটার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। জটলা করে আছেন দুনিয়ার মানুষ। সেই ভিড়ের এক কোনায় বন্ধুদের দেখতে পায় তুহিন। একটা নিচু দেয়ালের ওপর স্থবির হয়ে বসে আছে সুতপা। তার ঠিক পাশে রাস্তার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রফিক। অন্য বন্ধুরা আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবিদকে দেখা যায় না কোথাও। ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় তুহিন। সুতপার চোখে জল। লাল হয়ে আছে রফিকের চোখ। তুহিনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুতপা। তার পাশে বসে আলতো করে হাত রাখে তুহিন বন্ধুর কাঁধে। সুতপার কান্না আরও বেড়ে যায়। পৃথিবীর সব জল যেন আজ নেমে আসবে সুতপার চোখ বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে সুতপা—গতকাল বিকেলেও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল তুলির সঙ্গে। আমাদের আজ সকালে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটি নিয়ে আলাপ করার জন্য রাতে আবার ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেনি তুলি। তারপর সকালবেলা ওর বাসায় এসে বারবার নক করার পরও দরজা খুলছিল না সে। তখন দারোয়ানকে ডেকে আনা হয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এরপর পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলে ঝুলতে দেখা যায় তুলিকে। ফ্যানের সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সুতপা। আমাদের তুলি, কেন এভাবে চলে যাবে? কী এমন কষ্ট ছিল রে তুলি তোর মনে? আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সুতপা। ওর কান্না দেখে চোখ মোছে অন্য বন্ধুরা। আশপাশে জড়ো হওয়া কারও কারও চোখেও দেখা যায় জল। তুহিনের কেবল কান্না পায় না। চোখে জল নামে না। তবে ভেঙে যেতে থাকে বুকের ভেতরটা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দশ বছর আগের এক ঝলমলে সকাল। না গরম, না শীতের সেই সকালটায় সূর্যিত-রাঙা হয়েছিল চারপাশ। শেষ রাতের শিশির পড়ে গাছের পাতাগুলো ছিল ভেজা ভেজা। তুহিনরা দাঁড়িয়ে ছিল কলাভবনের করিডরে। ফিলোসফি সাবসিডিয়ারি ক্লাসের জন্য অপেক্ষা। তুহিন, আবিদ এবং রসি দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিল। এমন সময় কলকল-ছলছল করতে করতে এসেছিল সুতপা আর তুলি। প্রথম দিনের ক্লাসে তুহিনদের সঙ্গে বসেছিল তারা দুজন। প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাদের। এরপর সেই বন্ধুত্বের গাছ বড় হয়েছে দিনে দিনে। ডালপালা মেলেছে ক্যাম্পাসজুড়ে। বন্ধুত্বের মালায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন নাম। এরপর কত অর্থহীন আড্ডায়, কত কাজে-অকাজে, কত জানা-অজানায়, কত রাগে-অনুরাগে, কত মান-অভিমানে, কত ঝগড়া-বিষাদে, কত আনন্দ-দুঃখে, কত ব্যথা-অনুভবে, কত হর্ষ-উল্লাসে কেটেছে তাদের একেকটি দিন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যাত্রা কত দিন মাঝরাত ছুঁয়েছে। কত দিন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে পুড়েছি, শীতে কেঁপেছি। আজ আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল তুলি! কেন চলে যেতে হলো তাকে—ভাবনার ঝড় চলে তুহিনের মনের ভেতর।
আবিদ কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, টের পায় না তুহিন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সুতপাকে রুহীর কাছে রেখে তারা দুজন একটু দূরে গিয়ে বসে। কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। একপর্যায়ে কথা বলে তুহিন—তুলির বাসায় আর কে কে থাকে?
তুলি একাই! ছোট্ট উত্তর আবিদের।
তবে আমরা জানি, তুলির সঙ্গে তার বরের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল চার বছর আগে। এরপর থেকে তুলি একাই থাকত বাসায়। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটা এসে থাকত তার সঙ্গে। তুলি একটা ভালো চাকরি করত। একার জীবনে টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হতো না তার। কিন্তু করোনার সময় আচমকা তার চাকরিটা চলে যায়। তবে একবারে অথই সাগরে পড়েনি তুলি। জমানো টাকা দিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছিল সে। বন্ধুদের মধ্যে সুতপার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল তুলি। তুলির পেটের খবর সব ওর জানা। সুতপাও বলছে তুলিকে কখনো হতাশ, বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি তার। তবুও কেন এমন অসময়ে স্বেচ্ছায় চলে গেল সে? এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র দিতে পারত তুলিই। কিন্তু সে তো এখন শুয়ে আছে নিঃসাড় নিজের ঘরের মেঝেতে। একটি সাদা ব্যাগে মুড়ে একটু পর তাকে নামিয়ে আনা হবে নিচে। অন্ধকার হিমঘরে থাকবে হয়তো সারা রাত। অথচ তুলিটা অন্ধকার বড় ভয় পেত।
অনেক রাতের পরে তুলিকে হিমঘরে রেখে তারা সবাই বাড়ির দিকে যাত্রা করে। এর মধ্যে চলে এসেছে তুলির ছোট ভাইটা। এসেছে অন্য স্বজনেরাও। খবর পেয়ে যশোর থেকে রওনা দিয়েছেন তুলির বাবা-মা। সুতপাকে নিতে আসে তার বর। তাদের সঙ্গে যায় রুহী। বাকি বন্ধুরাও যে যার মতো চলে যায়, সকালে আবার আসবে বলে! কী মনে করে যেন তুহিন ফোন করে রাইকে। রিং হয় একবার, দুবার, তিনবার। ফোন রিসিভ করে না রাই। আবিদ কি কিছু বুঝতে পারে?
দোস্ত, চল, আজকে তোর সঙ্গে থাকব। অনেক দিন মন খুলে কথা বলি না আমরা।
আবিদের প্রস্তাবে রাজি হয় তুহিন। দুই বন্ধু হাঁটতে থাকে শহরের পথ ধরে। আদাবর থেকে হাতিরপুল অনেকটা পথ। তারা দুজন হাঁটছে ধীরপায়ে। আকাশে সেদিন চাঁদ ছিল না। একেবারে নিকষ কালো আকাশে ছিল না কোনো তারাও।
প্রায় শেষরাতের দিকে আবিদ আর তুহিনকে দেখা যায় বসে আছে বারান্দায়। বেতের চেয়ারটাতে বসে একটু একটু করে দুলছে আবিদ। তুহিন বসে আছে একটা মোড়ায়।
পাভেলের কথা মনে আছে তোর? আবিদের কথার উত্তরে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে তুহিন।
তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ। শেষ রাতের এই সময়টাতে আকাশের গুমোট কেটে গিয়ে বসেছে লক্ষ তারার মেলা। বাতাস বইছে ধীরে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে।
পাভেল যেদিন মারা গেল, সেদিনও আজকের মতোই ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিলি তুই। রাতের নীরবতা ভেঙে কথাটা বলে তুহিন। আবিদ কিছুই বলে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বহু দূরে তাকিয়ে থাকে শূন্য চোখে।
আমরা জানি, তাদের প্রিয় বন্ধু পাভেল অনার্স শেষের পরই চলে গিয়েছিল নিউইয়র্ক। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ভালো জমিয়ে তুলেছিল। কিন্তু কী করে যেন মার্কিন মুলুকে কিডনির রোগ বাঁধিয়ে ফেলে পাভেল। অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎসার পর কোনো এক গভীর রাতে নিউইয়র্কের কোনো এক হাসপাতালে নীরব-নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় তার।
আচ্ছা আবিদ তুই কি জানিস, পাভেল তুলিকে খুব ভালোবাসত? প্রেম ছিল তাদের দুজনের!
হুম জানি। এ-ও জানি, এক দুপুরে তারা ঠিক করেছিল—বিয়ে করে ফেলবে। এরপর সেই সারাটা দুপুর তারা পুরো নিউমার্কেট চষে ঘর-গৃহস্থালির জিনিস কিনেছিল। রাতুলের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকাও ধার নিয়েছিল পাভেল। বিয়ের সময় কিছু টাকাপয়সা হাতে রাখা দরকার। কিন্তু কী কারণে জানি পরে আর বিয়েটা হয়নি।
সমবয়সীকে বিয়ে করবে তুলি—এটা তার বাবা মা কিছুতেই চায়নি। আর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে কোনো মতেই রাজি হয়নি তুলি।
দুই বন্ধুর আলাপ এরপর আর এগোয় না। যেন তাদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে। অথবা কোনো অচেনা স্টেশনে বসে আছে দুজন অপরিচিত কোনো লোক। যেন তুহিন আর আবিদ কেউ কাউকে চেনে না। অথবা তারা দুজন মানুষ সম্পূর্ণ বোবা মানুষ। তাদের কোনো ভাষা নেই। এভাবে কাটে অনেকটা সময়। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। এরপর কাছের মসজিদগুলো থেকেও একের পর আসতে থাকে আজানের সুমধুর সুর।
এই সময় আমরা দেখি আজন্মের নীরবতা ভেঙে গলা ছেড়ে কাঁদছে আবিদ আর তুহিন। তুমুল তারুণ্যের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন দশ বছর আগেই পেছনে ফেলে এসেছে তারা। অথচ সেই সব দিনের স্মৃতি একের পর পর সতেজ-সজীব-জীবন্ত হয়ে ভাসছে তাদের চোখে। বুক ভেসে যায় দুজনের অকাল মৃত দুই বন্ধুর জন্য। যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছিল কিন্তু কেউ কারও হয়নি। আর তিন বছরের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দুজনেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। আহারে তুলি! আহারে পাভেল!
জীবন কেন সব সময় জয়ের বন্দরে ভেড়ে না!
খান মুহাম্মদ রুমেল
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে। তার পাখায় ঝিলিক দিচ্ছে নীলাভ আভা। বকটা উড়তে উড়তে একসময় নেমে আসে তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো—একেবারে চোখবরাবর। যেন সুচালো নখের আঁচড়ে তুলে নেবে চোখ জোড়া। অথবা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তখন। চাইলেও সরে যাওয়া যায় না। পা দুটো যেন জমে পাথর হয়ে যায়। অথবা মনে হয় মাঠের বয়সী জামগাছটার শক্ত শেকড়ের মতো মাটির অনেক গভীরে দেবে গেছে পা জোড়া। ধারালো নখের তীব্র আক্রমণের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বকটা নেমে আসছে…শো শো শব্দ বেড়েই চলেছে!
তুহিনের বালিশের পাশে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তুলে কাঁপছে তার সেলফোনটা। খ্যাপা লাল ষাঁড়কে আঁটোদড়িতে বেঁধে রাখলে বাঁধন ছেঁড়ার জন্য পাক খেয়ে যেমন ঘুরতে থাকে—চরম কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে সেই রকম করে ঘুরছে ফোনটা। কিন্তু বেশি দূর যেতেও পারছে না। ঘুম ভেঙে যায় তুহিনের। স্বপ্ন দেখছিল সে। সেই পুরোনো স্বপ্ন। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বপ্নটা দেখছে সে। বেশির ভাগ সময় ভোরের দিকে, না হয় সকালের দিকেই স্বপ্নটা দেখে সে। কিন্তু স্বপ্নের শেষটা আজ পর্যন্ত দেখা হলো না। কোনো না কোনো বাগড়া বাধেই। আজ যেমন ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনো দিন হয়তো পেপারওয়ালা এসে কলবেল বাজায়। কোনো দিন হয়তো নিচের রাস্তায় চেঁচিয়ে ওঠে তালাচাবিওয়ালা! কিংবা কোনো দিন দেখা যায় একটা মাইক নিয়ে নেমে পড়েছে কেউ। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প অথবা কোনো রাজনৈতিক সভার প্রচার চালাচ্ছে গলা ফাটিয়ে!
এদিকে অনেকক্ষণ কেঁপে কেঁপে থেমে গেছে ফোনটা। হাতে নিয়ে তুহিন দেখে সাতটা মিসড কল। তিনটা অফিস কলিগদের। অথচ আজকে ছুটির দিন। অফিস থেকে কেন ফোন আসবে? খুব বিরক্ত লাগে তার। বাকি চারটা ফোন আবিদের। আবিদ তার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খুব মাখামাখি বন্ধুত্ব ছিল। পরে ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। একই শহরে থেকেও যোগাযোগটা কেমন আলগা হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ বিরতিতে যখনই কথা হয়, পুরোনো সেই উচ্ছ্বাসটা ঠিকই ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আজকে এই ছুটির দিনের ভোরে আবিদ হঠাৎ কেন এতবার ফোন করল, ভেবে পায় না তুহিন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোর ঘরে! এত বেলা হয়ে গেছে? নিজের কাছেই কিছুটা লজ্জা লাগে তার। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না সে। যত রাত করেই ঘুমাক, ঠিকই সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে সে।
বিছানায় শুয়েই আবিদকে ফোন করে তুহিন। রিং হয়। একবার, দুবার, তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে আবিদ।
হ্যালো
কী রে! সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। তোর কোনো খবরই নাই।
ঘুমাচ্ছিলাম দোস্ত।
এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস? তোর না আগে ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল!
এত সকালে ফোন দিয়েছিলি কেন?
একটা খারাপ খবর আছে দোস্ত।
কতটা খারাপ? হয়েছে কী, বল তো?
দোস্ত, তুলি মারা গেছে!
তুলি? কোন তুলি? সমাজবিজ্ঞানের?
হুম।
হায় আল্লাহ, কী বলিস? কীভাবে মারা গেল?
আত্মহত্যা করেছে!
কী বলছিস এসব? তুলি কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? কী যা-তা বলছিস?
এত কথা বলতে পারব না। আমি আছি তুলির বাসায়। তুই পারলে আয়।
ফোন কেটে দেয় আবিদ। নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ পাথরের মতো বসে থাকে তুহিন। এটা কেমন কথা। তুলি কেন মরে যাবে? কেন আত্মহত্যা করবে তুলির মতো একটা মেয়ে। খরস্রোতা নদীর মতো সারাক্ষণ কলকল করে বয়ে চলা তুলি, জোছনার নরম আলোর মতো মায়া হয়ে ছড়িয়ে থাকা তুলি, ঝরনাজলের মতো প্রবল বেগে আছড়ে পড়া তুলি কেন নিজেকে শেষ করে দেবে? কেন তার কাছে এই দুনিয়াটাকে নরক মনে হবে? কেন মনে হবে এখানে আর থাকা যাবে না? কেন সে জীবনের ছেদবিন্দু টেনে দেবে এই অসময়ে? মেলে না, কিছুতেই হিসাব মেলে না তুহিনের।
তুহিনরা পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তুলি সমাজবিজ্ঞানে। ফিলোসফির সাবসিডিয়ারি কোর্সে দেখা হতো তাদের। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব। পুরো ক্যাম্পাসজীবনের তুলিকে দেখেছে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হিসেবে। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। প্রায়ই হল থেকে তাদের জন্য এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে আসত তুলি। খুব ভালো রান্না করত মেয়েটা। তবে একদিন দুষ্টুমি করে রসি বলেছিল—কী সব রান্না করে আনিস, মুখে দেয়া যায় না! তখন তুলি কোনো কথা বলেনি। হেসেছে বরং। কিন্তু পরে তারা শুনেছে ইফফাতের কাছে—কমনরুমে গিয়ে নাকি কেঁদে ভাসিয়েছে তুলি। হল প্রভোস্টের চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমের হিটার জ্বালিয়ে বন্ধুদের জন্য শখ করে রান্না করে আনে সে—আর এটা নিয়ে বন্ধুরা এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল? না হয় তার রান্না খারাপই! তাই বলে মুখের ওপর এমন করে বলবে? তুলি ভেতরে ভেতরে অনেক অভিমানী ছিল। সেই অভিমানটা টের পেত না বেশির ভাগ মানুষ। আসলে এমনই হয়। আমরা সবাই বাইরের মানুষটাকে দেখি। একটা মানুষের ভেতরের আনন্দ, বেদনা, বিরহ, যাতনা—এসব আমরা খতিয়ে দেখি না বা দেখার চেষ্টা করি না। বোঝার-জানার চেষ্টা করি না।
দ্রুত রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তুহিন। রাই বাসায় নেই অনেক দিন হলো। সেই যে এক বিকেলে বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে আর আসার নাম নেই। এর আগেও এমন হয়েছে—রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে রাই। কিন্তু ফিরে এসেছে দুয়েক দিন পরই। এবার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে তবু ফেরার নাম নেই। রাই চলে যাওয়ার এক দিন পরই ফোন করে তাকে ফেরার অনুরোধ করেছে তুহিন। কিন্তু কিছুতেই কাজ না হলে এক সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিল রাইদের ধানমন্ডির বাসায়। রাই খুব হেসে হেসে কথা বলেছে তুহিনের সঙ্গে। আদর-যত্ন করে রাতের খাবার খাইয়েছে। কিন্তু যেই তুহিন বাসায় ফেরার কথা বলেছে—ওমনি বেঁকে বসেছে রাই। কিছুতেই ফিরবে না সে। রাইয়ের মাকে বলেছে তুহিন—ওকে আমার সঙ্গে আসতে বলেন আম্মা। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই বোঝো, আমি এখানে কী বলব, বলো?—এটুকু বলেই কথা সেরেছেন সাবেরা বেগম। ফলে আর কথা বাড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে নীরবে। শুধু ফেরার পথে কী মনে করে তাকিয়েছে পেছন ফিরে। চোখে পড়েছে দোতলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই। কেমন যেন ক্লান্ত-অলস লাগে রাইকে। একবার মনে হয়েছে ফিরে গিয়ে আবার অনুরোধ করে রাইকে। কিন্তু আর দাঁড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে দ্রুত পায়ে। এখন রাইয়ের অনুপস্থিতিতে কিছুই ঠিকঠাক মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। সকালের নাশতাও বাদ গেল মাসখানেক ধরে। আর আজকে তো নাশতা করে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই আসে না। ছুটির দিনের সকালের রাস্তা বেশ ফাঁকা। সহজেই একটা রিকশা পেয়ে যায়। মোবাইল ফোনে আবিদের এসএমএস। তুলির বাসার ঠিকানা লেখা। আদাবরে পৌঁছে বাসাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। একটা সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে মারা গেছে, আত্মহত্যা করেছে গত রাতের কোনো এক সময়—এটা এলাকার কারও জানতে বাকি নেই। ভাড়া দিয়ে ধীরপায়ে রিকশা থেকে নামে তুহিন। এগিয়ে আসে আবিদ। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকত তুলি। তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা এখন পুলিশের দখলে। মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে তারা। লাশের সুরতহাল করা হবে এখন। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তুলিকে। সাততলা বাড়িটার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। জটলা করে আছেন দুনিয়ার মানুষ। সেই ভিড়ের এক কোনায় বন্ধুদের দেখতে পায় তুহিন। একটা নিচু দেয়ালের ওপর স্থবির হয়ে বসে আছে সুতপা। তার ঠিক পাশে রাস্তার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রফিক। অন্য বন্ধুরা আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবিদকে দেখা যায় না কোথাও। ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় তুহিন। সুতপার চোখে জল। লাল হয়ে আছে রফিকের চোখ। তুহিনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুতপা। তার পাশে বসে আলতো করে হাত রাখে তুহিন বন্ধুর কাঁধে। সুতপার কান্না আরও বেড়ে যায়। পৃথিবীর সব জল যেন আজ নেমে আসবে সুতপার চোখ বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে সুতপা—গতকাল বিকেলেও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল তুলির সঙ্গে। আমাদের আজ সকালে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটি নিয়ে আলাপ করার জন্য রাতে আবার ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেনি তুলি। তারপর সকালবেলা ওর বাসায় এসে বারবার নক করার পরও দরজা খুলছিল না সে। তখন দারোয়ানকে ডেকে আনা হয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এরপর পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলে ঝুলতে দেখা যায় তুলিকে। ফ্যানের সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সুতপা। আমাদের তুলি, কেন এভাবে চলে যাবে? কী এমন কষ্ট ছিল রে তুলি তোর মনে? আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সুতপা। ওর কান্না দেখে চোখ মোছে অন্য বন্ধুরা। আশপাশে জড়ো হওয়া কারও কারও চোখেও দেখা যায় জল। তুহিনের কেবল কান্না পায় না। চোখে জল নামে না। তবে ভেঙে যেতে থাকে বুকের ভেতরটা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দশ বছর আগের এক ঝলমলে সকাল। না গরম, না শীতের সেই সকালটায় সূর্যিত-রাঙা হয়েছিল চারপাশ। শেষ রাতের শিশির পড়ে গাছের পাতাগুলো ছিল ভেজা ভেজা। তুহিনরা দাঁড়িয়ে ছিল কলাভবনের করিডরে। ফিলোসফি সাবসিডিয়ারি ক্লাসের জন্য অপেক্ষা। তুহিন, আবিদ এবং রসি দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিল। এমন সময় কলকল-ছলছল করতে করতে এসেছিল সুতপা আর তুলি। প্রথম দিনের ক্লাসে তুহিনদের সঙ্গে বসেছিল তারা দুজন। প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাদের। এরপর সেই বন্ধুত্বের গাছ বড় হয়েছে দিনে দিনে। ডালপালা মেলেছে ক্যাম্পাসজুড়ে। বন্ধুত্বের মালায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন নাম। এরপর কত অর্থহীন আড্ডায়, কত কাজে-অকাজে, কত জানা-অজানায়, কত রাগে-অনুরাগে, কত মান-অভিমানে, কত ঝগড়া-বিষাদে, কত আনন্দ-দুঃখে, কত ব্যথা-অনুভবে, কত হর্ষ-উল্লাসে কেটেছে তাদের একেকটি দিন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যাত্রা কত দিন মাঝরাত ছুঁয়েছে। কত দিন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে পুড়েছি, শীতে কেঁপেছি। আজ আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল তুলি! কেন চলে যেতে হলো তাকে—ভাবনার ঝড় চলে তুহিনের মনের ভেতর।
আবিদ কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, টের পায় না তুহিন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সুতপাকে রুহীর কাছে রেখে তারা দুজন একটু দূরে গিয়ে বসে। কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। একপর্যায়ে কথা বলে তুহিন—তুলির বাসায় আর কে কে থাকে?
তুলি একাই! ছোট্ট উত্তর আবিদের।
তবে আমরা জানি, তুলির সঙ্গে তার বরের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল চার বছর আগে। এরপর থেকে তুলি একাই থাকত বাসায়। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটা এসে থাকত তার সঙ্গে। তুলি একটা ভালো চাকরি করত। একার জীবনে টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হতো না তার। কিন্তু করোনার সময় আচমকা তার চাকরিটা চলে যায়। তবে একবারে অথই সাগরে পড়েনি তুলি। জমানো টাকা দিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছিল সে। বন্ধুদের মধ্যে সুতপার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল তুলি। তুলির পেটের খবর সব ওর জানা। সুতপাও বলছে তুলিকে কখনো হতাশ, বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি তার। তবুও কেন এমন অসময়ে স্বেচ্ছায় চলে গেল সে? এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র দিতে পারত তুলিই। কিন্তু সে তো এখন শুয়ে আছে নিঃসাড় নিজের ঘরের মেঝেতে। একটি সাদা ব্যাগে মুড়ে একটু পর তাকে নামিয়ে আনা হবে নিচে। অন্ধকার হিমঘরে থাকবে হয়তো সারা রাত। অথচ তুলিটা অন্ধকার বড় ভয় পেত।
অনেক রাতের পরে তুলিকে হিমঘরে রেখে তারা সবাই বাড়ির দিকে যাত্রা করে। এর মধ্যে চলে এসেছে তুলির ছোট ভাইটা। এসেছে অন্য স্বজনেরাও। খবর পেয়ে যশোর থেকে রওনা দিয়েছেন তুলির বাবা-মা। সুতপাকে নিতে আসে তার বর। তাদের সঙ্গে যায় রুহী। বাকি বন্ধুরাও যে যার মতো চলে যায়, সকালে আবার আসবে বলে! কী মনে করে যেন তুহিন ফোন করে রাইকে। রিং হয় একবার, দুবার, তিনবার। ফোন রিসিভ করে না রাই। আবিদ কি কিছু বুঝতে পারে?
দোস্ত, চল, আজকে তোর সঙ্গে থাকব। অনেক দিন মন খুলে কথা বলি না আমরা।
আবিদের প্রস্তাবে রাজি হয় তুহিন। দুই বন্ধু হাঁটতে থাকে শহরের পথ ধরে। আদাবর থেকে হাতিরপুল অনেকটা পথ। তারা দুজন হাঁটছে ধীরপায়ে। আকাশে সেদিন চাঁদ ছিল না। একেবারে নিকষ কালো আকাশে ছিল না কোনো তারাও।
প্রায় শেষরাতের দিকে আবিদ আর তুহিনকে দেখা যায় বসে আছে বারান্দায়। বেতের চেয়ারটাতে বসে একটু একটু করে দুলছে আবিদ। তুহিন বসে আছে একটা মোড়ায়।
পাভেলের কথা মনে আছে তোর? আবিদের কথার উত্তরে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে তুহিন।
তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ। শেষ রাতের এই সময়টাতে আকাশের গুমোট কেটে গিয়ে বসেছে লক্ষ তারার মেলা। বাতাস বইছে ধীরে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে।
পাভেল যেদিন মারা গেল, সেদিনও আজকের মতোই ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিলি তুই। রাতের নীরবতা ভেঙে কথাটা বলে তুহিন। আবিদ কিছুই বলে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বহু দূরে তাকিয়ে থাকে শূন্য চোখে।
আমরা জানি, তাদের প্রিয় বন্ধু পাভেল অনার্স শেষের পরই চলে গিয়েছিল নিউইয়র্ক। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ভালো জমিয়ে তুলেছিল। কিন্তু কী করে যেন মার্কিন মুলুকে কিডনির রোগ বাঁধিয়ে ফেলে পাভেল। অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎসার পর কোনো এক গভীর রাতে নিউইয়র্কের কোনো এক হাসপাতালে নীরব-নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় তার।
আচ্ছা আবিদ তুই কি জানিস, পাভেল তুলিকে খুব ভালোবাসত? প্রেম ছিল তাদের দুজনের!
হুম জানি। এ-ও জানি, এক দুপুরে তারা ঠিক করেছিল—বিয়ে করে ফেলবে। এরপর সেই সারাটা দুপুর তারা পুরো নিউমার্কেট চষে ঘর-গৃহস্থালির জিনিস কিনেছিল। রাতুলের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকাও ধার নিয়েছিল পাভেল। বিয়ের সময় কিছু টাকাপয়সা হাতে রাখা দরকার। কিন্তু কী কারণে জানি পরে আর বিয়েটা হয়নি।
সমবয়সীকে বিয়ে করবে তুলি—এটা তার বাবা মা কিছুতেই চায়নি। আর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে কোনো মতেই রাজি হয়নি তুলি।
দুই বন্ধুর আলাপ এরপর আর এগোয় না। যেন তাদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে। অথবা কোনো অচেনা স্টেশনে বসে আছে দুজন অপরিচিত কোনো লোক। যেন তুহিন আর আবিদ কেউ কাউকে চেনে না। অথবা তারা দুজন মানুষ সম্পূর্ণ বোবা মানুষ। তাদের কোনো ভাষা নেই। এভাবে কাটে অনেকটা সময়। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। এরপর কাছের মসজিদগুলো থেকেও একের পর আসতে থাকে আজানের সুমধুর সুর।
এই সময় আমরা দেখি আজন্মের নীরবতা ভেঙে গলা ছেড়ে কাঁদছে আবিদ আর তুহিন। তুমুল তারুণ্যের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন দশ বছর আগেই পেছনে ফেলে এসেছে তারা। অথচ সেই সব দিনের স্মৃতি একের পর পর সতেজ-সজীব-জীবন্ত হয়ে ভাসছে তাদের চোখে। বুক ভেসে যায় দুজনের অকাল মৃত দুই বন্ধুর জন্য। যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছিল কিন্তু কেউ কারও হয়নি। আর তিন বছরের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দুজনেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। আহারে তুলি! আহারে পাভেল!
জীবন কেন সব সময় জয়ের বন্দরে ভেড়ে না!
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে। তার পাখায় ঝিলিক দিচ্ছে নীলাভ আভা। বকটা উড়তে উড়তে একসময় নেমে আসে তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো—একেবারে চোখবরাবর। যেন সুচালো নখের আঁচড়ে তুলে নেবে চোখ জোড়া। অথবা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তখন। চাইলেও সরে যাওয়া যায় না। পা দুটো যেন জমে পাথর হয়ে যায়। অথবা মনে হয় মাঠের বয়সী জামগাছটার শক্ত শেকড়ের মতো মাটির অনেক গভীরে দেবে গেছে পা জোড়া। ধারালো নখের তীব্র আক্রমণের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বকটা নেমে আসছে…শো শো শব্দ বেড়েই চলেছে!
তুহিনের বালিশের পাশে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তুলে কাঁপছে তার সেলফোনটা। খ্যাপা লাল ষাঁড়কে আঁটোদড়িতে বেঁধে রাখলে বাঁধন ছেঁড়ার জন্য পাক খেয়ে যেমন ঘুরতে থাকে—চরম কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে সেই রকম করে ঘুরছে ফোনটা। কিন্তু বেশি দূর যেতেও পারছে না। ঘুম ভেঙে যায় তুহিনের। স্বপ্ন দেখছিল সে। সেই পুরোনো স্বপ্ন। বেশ কিছুদিন ধরেই স্বপ্নটা দেখছে সে। বেশির ভাগ সময় ভোরের দিকে, না হয় সকালের দিকেই স্বপ্নটা দেখে সে। কিন্তু স্বপ্নের শেষটা আজ পর্যন্ত দেখা হলো না। কোনো না কোনো বাগড়া বাধেই। আজ যেমন ফোনের কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। কোনো দিন হয়তো পেপারওয়ালা এসে কলবেল বাজায়। কোনো দিন হয়তো নিচের রাস্তায় চেঁচিয়ে ওঠে তালাচাবিওয়ালা! কিংবা কোনো দিন দেখা যায় একটা মাইক নিয়ে নেমে পড়েছে কেউ। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প অথবা কোনো রাজনৈতিক সভার প্রচার চালাচ্ছে গলা ফাটিয়ে!
এদিকে অনেকক্ষণ কেঁপে কেঁপে থেমে গেছে ফোনটা। হাতে নিয়ে তুহিন দেখে সাতটা মিসড কল। তিনটা অফিস কলিগদের। অথচ আজকে ছুটির দিন। অফিস থেকে কেন ফোন আসবে? খুব বিরক্ত লাগে তার। বাকি চারটা ফোন আবিদের। আবিদ তার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় খুব মাখামাখি বন্ধুত্ব ছিল। পরে ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। একই শহরে থেকেও যোগাযোগটা কেমন আলগা হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘ বিরতিতে যখনই কথা হয়, পুরোনো সেই উচ্ছ্বাসটা ঠিকই ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আজকে এই ছুটির দিনের ভোরে আবিদ হঠাৎ কেন এতবার ফোন করল, ভেবে পায় না তুহিন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোর ঘরে! এত বেলা হয়ে গেছে? নিজের কাছেই কিছুটা লজ্জা লাগে তার। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাধারণত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না সে। যত রাত করেই ঘুমাক, ঠিকই সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে সে।
বিছানায় শুয়েই আবিদকে ফোন করে তুহিন। রিং হয়। একবার, দুবার, তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে আবিদ।
হ্যালো
কী রে! সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। তোর কোনো খবরই নাই।
ঘুমাচ্ছিলাম দোস্ত।
এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস? তোর না আগে ভোরে ওঠার অভ্যাস ছিল!
এত সকালে ফোন দিয়েছিলি কেন?
একটা খারাপ খবর আছে দোস্ত।
কতটা খারাপ? হয়েছে কী, বল তো?
দোস্ত, তুলি মারা গেছে!
তুলি? কোন তুলি? সমাজবিজ্ঞানের?
হুম।
হায় আল্লাহ, কী বলিস? কীভাবে মারা গেল?
আত্মহত্যা করেছে!
কী বলছিস এসব? তুলি কেন আত্মহত্যা করতে যাবে? কী যা-তা বলছিস?
এত কথা বলতে পারব না। আমি আছি তুলির বাসায়। তুই পারলে আয়।
ফোন কেটে দেয় আবিদ। নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ পাথরের মতো বসে থাকে তুহিন। এটা কেমন কথা। তুলি কেন মরে যাবে? কেন আত্মহত্যা করবে তুলির মতো একটা মেয়ে। খরস্রোতা নদীর মতো সারাক্ষণ কলকল করে বয়ে চলা তুলি, জোছনার নরম আলোর মতো মায়া হয়ে ছড়িয়ে থাকা তুলি, ঝরনাজলের মতো প্রবল বেগে আছড়ে পড়া তুলি কেন নিজেকে শেষ করে দেবে? কেন তার কাছে এই দুনিয়াটাকে নরক মনে হবে? কেন মনে হবে এখানে আর থাকা যাবে না? কেন সে জীবনের ছেদবিন্দু টেনে দেবে এই অসময়ে? মেলে না, কিছুতেই হিসাব মেলে না তুহিনের।
তুহিনরা পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তুলি সমাজবিজ্ঞানে। ফিলোসফির সাবসিডিয়ারি কোর্সে দেখা হতো তাদের। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। গভীর বন্ধুত্ব। পুরো ক্যাম্পাসজীবনের তুলিকে দেখেছে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হিসেবে। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। প্রায়ই হল থেকে তাদের জন্য এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে আসত তুলি। খুব ভালো রান্না করত মেয়েটা। তবে একদিন দুষ্টুমি করে রসি বলেছিল—কী সব রান্না করে আনিস, মুখে দেয়া যায় না! তখন তুলি কোনো কথা বলেনি। হেসেছে বরং। কিন্তু পরে তারা শুনেছে ইফফাতের কাছে—কমনরুমে গিয়ে নাকি কেঁদে ভাসিয়েছে তুলি। হল প্রভোস্টের চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমের হিটার জ্বালিয়ে বন্ধুদের জন্য শখ করে রান্না করে আনে সে—আর এটা নিয়ে বন্ধুরা এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল? না হয় তার রান্না খারাপই! তাই বলে মুখের ওপর এমন করে বলবে? তুলি ভেতরে ভেতরে অনেক অভিমানী ছিল। সেই অভিমানটা টের পেত না বেশির ভাগ মানুষ। আসলে এমনই হয়। আমরা সবাই বাইরের মানুষটাকে দেখি। একটা মানুষের ভেতরের আনন্দ, বেদনা, বিরহ, যাতনা—এসব আমরা খতিয়ে দেখি না বা দেখার চেষ্টা করি না। বোঝার-জানার চেষ্টা করি না।
দ্রুত রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে তুহিন। রাই বাসায় নেই অনেক দিন হলো। সেই যে এক বিকেলে বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে আর আসার নাম নেই। এর আগেও এমন হয়েছে—রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে রাই। কিন্তু ফিরে এসেছে দুয়েক দিন পরই। এবার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে তবু ফেরার নাম নেই। রাই চলে যাওয়ার এক দিন পরই ফোন করে তাকে ফেরার অনুরোধ করেছে তুহিন। কিন্তু কিছুতেই কাজ না হলে এক সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিল রাইদের ধানমন্ডির বাসায়। রাই খুব হেসে হেসে কথা বলেছে তুহিনের সঙ্গে। আদর-যত্ন করে রাতের খাবার খাইয়েছে। কিন্তু যেই তুহিন বাসায় ফেরার কথা বলেছে—ওমনি বেঁকে বসেছে রাই। কিছুতেই ফিরবে না সে। রাইয়ের মাকে বলেছে তুহিন—ওকে আমার সঙ্গে আসতে বলেন আম্মা। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই বোঝো, আমি এখানে কী বলব, বলো?—এটুকু বলেই কথা সেরেছেন সাবেরা বেগম। ফলে আর কথা বাড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে নীরবে। শুধু ফেরার পথে কী মনে করে তাকিয়েছে পেছন ফিরে। চোখে পড়েছে দোতলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই। কেমন যেন ক্লান্ত-অলস লাগে রাইকে। একবার মনে হয়েছে ফিরে গিয়ে আবার অনুরোধ করে রাইকে। কিন্তু আর দাঁড়ায়নি তুহিন। চলে এসেছে দ্রুত পায়ে। এখন রাইয়ের অনুপস্থিতিতে কিছুই ঠিকঠাক মতো খুঁজে পাচ্ছে না সে। সকালের নাশতাও বাদ গেল মাসখানেক ধরে। আর আজকে তো নাশতা করে সময় নষ্ট করার প্রশ্নই আসে না। ছুটির দিনের সকালের রাস্তা বেশ ফাঁকা। সহজেই একটা রিকশা পেয়ে যায়। মোবাইল ফোনে আবিদের এসএমএস। তুলির বাসার ঠিকানা লেখা। আদাবরে পৌঁছে বাসাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। একটা সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে মারা গেছে, আত্মহত্যা করেছে গত রাতের কোনো এক সময়—এটা এলাকার কারও জানতে বাকি নেই। ভাড়া দিয়ে ধীরপায়ে রিকশা থেকে নামে তুহিন। এগিয়ে আসে আবিদ। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকত তুলি। তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা এখন পুলিশের দখলে। মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে তারা। লাশের সুরতহাল করা হবে এখন। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তুলিকে। সাততলা বাড়িটার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। জটলা করে আছেন দুনিয়ার মানুষ। সেই ভিড়ের এক কোনায় বন্ধুদের দেখতে পায় তুহিন। একটা নিচু দেয়ালের ওপর স্থবির হয়ে বসে আছে সুতপা। তার ঠিক পাশে রাস্তার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রফিক। অন্য বন্ধুরা আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবিদকে দেখা যায় না কোথাও। ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় তুহিন। সুতপার চোখে জল। লাল হয়ে আছে রফিকের চোখ। তুহিনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুতপা। তার পাশে বসে আলতো করে হাত রাখে তুহিন বন্ধুর কাঁধে। সুতপার কান্না আরও বেড়ে যায়। পৃথিবীর সব জল যেন আজ নেমে আসবে সুতপার চোখ বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে সুতপা—গতকাল বিকেলেও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল তুলির সঙ্গে। আমাদের আজ সকালে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটি নিয়ে আলাপ করার জন্য রাতে আবার ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেনি তুলি। তারপর সকালবেলা ওর বাসায় এসে বারবার নক করার পরও দরজা খুলছিল না সে। তখন দারোয়ানকে ডেকে আনা হয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এরপর পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলে ঝুলতে দেখা যায় তুলিকে। ফ্যানের সঙ্গে। মাথা ঘুরে পড়ে যায় সুতপা। আমাদের তুলি, কেন এভাবে চলে যাবে? কী এমন কষ্ট ছিল রে তুলি তোর মনে? আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে সুতপা। ওর কান্না দেখে চোখ মোছে অন্য বন্ধুরা। আশপাশে জড়ো হওয়া কারও কারও চোখেও দেখা যায় জল। তুহিনের কেবল কান্না পায় না। চোখে জল নামে না। তবে ভেঙে যেতে থাকে বুকের ভেতরটা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দশ বছর আগের এক ঝলমলে সকাল। না গরম, না শীতের সেই সকালটায় সূর্যিত-রাঙা হয়েছিল চারপাশ। শেষ রাতের শিশির পড়ে গাছের পাতাগুলো ছিল ভেজা ভেজা। তুহিনরা দাঁড়িয়ে ছিল কলাভবনের করিডরে। ফিলোসফি সাবসিডিয়ারি ক্লাসের জন্য অপেক্ষা। তুহিন, আবিদ এবং রসি দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিল। এমন সময় কলকল-ছলছল করতে করতে এসেছিল সুতপা আর তুলি। প্রথম দিনের ক্লাসে তুহিনদের সঙ্গে বসেছিল তারা দুজন। প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাদের। এরপর সেই বন্ধুত্বের গাছ বড় হয়েছে দিনে দিনে। ডালপালা মেলেছে ক্যাম্পাসজুড়ে। বন্ধুত্বের মালায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন নাম। এরপর কত অর্থহীন আড্ডায়, কত কাজে-অকাজে, কত জানা-অজানায়, কত রাগে-অনুরাগে, কত মান-অভিমানে, কত ঝগড়া-বিষাদে, কত আনন্দ-দুঃখে, কত ব্যথা-অনুভবে, কত হর্ষ-উল্লাসে কেটেছে তাদের একেকটি দিন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যাত্রা কত দিন মাঝরাত ছুঁয়েছে। কত দিন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে পুড়েছি, শীতে কেঁপেছি। আজ আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল তুলি! কেন চলে যেতে হলো তাকে—ভাবনার ঝড় চলে তুহিনের মনের ভেতর।
আবিদ কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, টের পায় না তুহিন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সুতপাকে রুহীর কাছে রেখে তারা দুজন একটু দূরে গিয়ে বসে। কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। একপর্যায়ে কথা বলে তুহিন—তুলির বাসায় আর কে কে থাকে?
তুলি একাই! ছোট্ট উত্তর আবিদের।
তবে আমরা জানি, তুলির সঙ্গে তার বরের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল চার বছর আগে। এরপর থেকে তুলি একাই থাকত বাসায়। মাঝে মাঝে ছোট ভাইটা এসে থাকত তার সঙ্গে। তুলি একটা ভালো চাকরি করত। একার জীবনে টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হতো না তার। কিন্তু করোনার সময় আচমকা তার চাকরিটা চলে যায়। তবে একবারে অথই সাগরে পড়েনি তুলি। জমানো টাকা দিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছিল সে। বন্ধুদের মধ্যে সুতপার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল তুলি। তুলির পেটের খবর সব ওর জানা। সুতপাও বলছে তুলিকে কখনো হতাশ, বিষাদগ্রস্ত মনে হয়নি তার। তবুও কেন এমন অসময়ে স্বেচ্ছায় চলে গেল সে? এই প্রশ্নের উত্তর তো একমাত্র দিতে পারত তুলিই। কিন্তু সে তো এখন শুয়ে আছে নিঃসাড় নিজের ঘরের মেঝেতে। একটি সাদা ব্যাগে মুড়ে একটু পর তাকে নামিয়ে আনা হবে নিচে। অন্ধকার হিমঘরে থাকবে হয়তো সারা রাত। অথচ তুলিটা অন্ধকার বড় ভয় পেত।
অনেক রাতের পরে তুলিকে হিমঘরে রেখে তারা সবাই বাড়ির দিকে যাত্রা করে। এর মধ্যে চলে এসেছে তুলির ছোট ভাইটা। এসেছে অন্য স্বজনেরাও। খবর পেয়ে যশোর থেকে রওনা দিয়েছেন তুলির বাবা-মা। সুতপাকে নিতে আসে তার বর। তাদের সঙ্গে যায় রুহী। বাকি বন্ধুরাও যে যার মতো চলে যায়, সকালে আবার আসবে বলে! কী মনে করে যেন তুহিন ফোন করে রাইকে। রিং হয় একবার, দুবার, তিনবার। ফোন রিসিভ করে না রাই। আবিদ কি কিছু বুঝতে পারে?
দোস্ত, চল, আজকে তোর সঙ্গে থাকব। অনেক দিন মন খুলে কথা বলি না আমরা।
আবিদের প্রস্তাবে রাজি হয় তুহিন। দুই বন্ধু হাঁটতে থাকে শহরের পথ ধরে। আদাবর থেকে হাতিরপুল অনেকটা পথ। তারা দুজন হাঁটছে ধীরপায়ে। আকাশে সেদিন চাঁদ ছিল না। একেবারে নিকষ কালো আকাশে ছিল না কোনো তারাও।
প্রায় শেষরাতের দিকে আবিদ আর তুহিনকে দেখা যায় বসে আছে বারান্দায়। বেতের চেয়ারটাতে বসে একটু একটু করে দুলছে আবিদ। তুহিন বসে আছে একটা মোড়ায়।
পাভেলের কথা মনে আছে তোর? আবিদের কথার উত্তরে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে তুহিন।
তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ। শেষ রাতের এই সময়টাতে আকাশের গুমোট কেটে গিয়ে বসেছে লক্ষ তারার মেলা। বাতাস বইছে ধীরে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে।
পাভেল যেদিন মারা গেল, সেদিনও আজকের মতোই ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিলি তুই। রাতের নীরবতা ভেঙে কথাটা বলে তুহিন। আবিদ কিছুই বলে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বহু দূরে তাকিয়ে থাকে শূন্য চোখে।
আমরা জানি, তাদের প্রিয় বন্ধু পাভেল অনার্স শেষের পরই চলে গিয়েছিল নিউইয়র্ক। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ভালো জমিয়ে তুলেছিল। কিন্তু কী করে যেন মার্কিন মুলুকে কিডনির রোগ বাঁধিয়ে ফেলে পাভেল। অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎসার পর কোনো এক গভীর রাতে নিউইয়র্কের কোনো এক হাসপাতালে নীরব-নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয় তার।
আচ্ছা আবিদ তুই কি জানিস, পাভেল তুলিকে খুব ভালোবাসত? প্রেম ছিল তাদের দুজনের!
হুম জানি। এ-ও জানি, এক দুপুরে তারা ঠিক করেছিল—বিয়ে করে ফেলবে। এরপর সেই সারাটা দুপুর তারা পুরো নিউমার্কেট চষে ঘর-গৃহস্থালির জিনিস কিনেছিল। রাতুলের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকাও ধার নিয়েছিল পাভেল। বিয়ের সময় কিছু টাকাপয়সা হাতে রাখা দরকার। কিন্তু কী কারণে জানি পরে আর বিয়েটা হয়নি।
সমবয়সীকে বিয়ে করবে তুলি—এটা তার বাবা মা কিছুতেই চায়নি। আর বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে কোনো মতেই রাজি হয়নি তুলি।
দুই বন্ধুর আলাপ এরপর আর এগোয় না। যেন তাদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে। অথবা কোনো অচেনা স্টেশনে বসে আছে দুজন অপরিচিত কোনো লোক। যেন তুহিন আর আবিদ কেউ কাউকে চেনে না। অথবা তারা দুজন মানুষ সম্পূর্ণ বোবা মানুষ। তাদের কোনো ভাষা নেই। এভাবে কাটে অনেকটা সময়। দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। এরপর কাছের মসজিদগুলো থেকেও একের পর আসতে থাকে আজানের সুমধুর সুর।
এই সময় আমরা দেখি আজন্মের নীরবতা ভেঙে গলা ছেড়ে কাঁদছে আবিদ আর তুহিন। তুমুল তারুণ্যের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন দশ বছর আগেই পেছনে ফেলে এসেছে তারা। অথচ সেই সব দিনের স্মৃতি একের পর পর সতেজ-সজীব-জীবন্ত হয়ে ভাসছে তাদের চোখে। বুক ভেসে যায় দুজনের অকাল মৃত দুই বন্ধুর জন্য। যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছিল কিন্তু কেউ কারও হয়নি। আর তিন বছরের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দুজনেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। আহারে তুলি! আহারে পাভেল!
জীবন কেন সব সময় জয়ের বন্দরে ভেড়ে না!
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১৪ ঘণ্টা আগেজনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৬ দিন আগেহাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১১ দিন আগেহাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’
এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’
এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে।
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৬ দিন আগেহাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১১ দিন আগেহাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১২ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।
সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।
সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে।
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১৪ ঘণ্টা আগেহাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১১ দিন আগেহাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে।
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১৪ ঘণ্টা আগেজনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৬ দিন আগেহাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।
আসমানে উড়ছে একটা নীল বক। আর আসমানটা একেবারে ধবধবে সাদা—যেন এইমাত্র লন্ড্রি থেকে ধুয়ে এনে একটি সাদা চাদর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরাচরজুড়ে। নীল বকটা নিঃশব্দ নয়। উড়ছে তীব্র শো শো শব্দে।
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
১৪ ঘণ্টা আগেজনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৬ দিন আগেহাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১১ দিন আগে