অদিতি ফাল্গুনী

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।
অদিতি ফাল্গুনী

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়। সূত্রাপুর-২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় বস্তি এলাকায় হরিদাসীর নিজেরই একটি ছোট চায়ের দোকানের মতো আছে। দোকান চালানো ছাড়াও সাদা থান পরা হরিদাসী অবসর সময়ে মাঝে মাঝেই মাটির ছোট ছোট চাড়া আগুনে পুড়িয়ে টুকরো ইটের মতো বানিয়ে, একটু দূরের কয়েক ঘর চামার বসতি থেকে মোটা সুই এনে সদ্য আগুনে পোড়া সেই চাড়াগুলো মালার মতো গাঁথে। কখনো সেই মালায় সে আরও যুক্ত করত নারকেলের আইচার টুকরা বা খেজুরের কাঁটা। ‘এই মালা—বুঝলি ছেমড়ি—অপজিশন, মানে বিরোধী পক্ষের গলায় ছুড়লে অপজিশন ঠান্ডা!’
এভাবে হরিদাসীর কাছ থেকেই শিখা মার্গারেট কস্টা প্রথম গুলতির মালা বানাতে শেখে। সূত্রাপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বলতে গেলে শিখারা মাত্র কয়েক ঘর খ্রিষ্টান আছে। খ্রিষ্টানও হয়েছে মাত্র তারা এক-দুই পুরুষ। বাকিটা তারাই সংখ্যায় ভারী, যারা শিখাদের পূর্বপুরুষ ছিল। সূত্রাপুর ছাড়ালে অবশ্য আবার মুসলমান বসতি শুরু।
‘শিখা! ঘুম দিয়া ওঠ। আইজ ফ্যাক্টরিত যাবি না?’
শিখা হাই তুলে ওঠে। মা গ্লাসে চা আর টোস্ট এনেছে। শিখার বয়স প্রায় কুড়ি। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েটরে একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে সে। এক গার্মেন্টসে ছিল দুই বছর, তারপর ব্যাটারি তৈরির একটি কারখানায় আরও দেড় বছর, লজেন্সের একটি কারখানায় দুই বছর, আবার এখন এই বিস্কুট তৈরির কারখানায় প্রায় এক বছর হতে চলল। বাবা-মাকে সবাই যদিও বলে যে শিখার বিয়ের কত দূর, তবু শিখা একের পর এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে বলে বিয়ের চাপ পাড়ায় উঠে উঠেও ওঠে না। যদিও শিখার বয়সী অধিকাংশ মেয়েই এই সূত্রাপুর, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, ওয়ারীসহ এন্তার পুরান ঢাকায় বিয়ে করে কমসে কম এক-দুটো বাচ্চার মা, শিখা দিব্যি একের পর এক কারখানায় কাজ নেয়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, তখন দু-তিন মাস বিয়ের কথা ওঠে, তারপর আবার কাজ পেলে বিয়ের কথা থিতিয়ে যায়। আর এ ছাড়া সবাই জানে যে শিখা একটু ‘ছিটেল’। ‘ছিটেল’ কেমন? যে মেয়ের নিজেরই বিয়ে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, তাকে আলাদাভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে-ফিরতে বা হুট করে কোনো বাজে অবস্থায় কোনো ছেলের সঙ্গেই কারোর চোখে তেমন পড়েছে বলে তল্লাটের কেউই কিছু বলতে পারবে না, কিন্তু আবার শিখার কিছু বদনামও আছে। শিখাকে প্রায়ই দেখা যায় শুধু এই কয়েক ঘর খ্রিষ্টানপাড়ার খ্রিষ্টান ছেলেই না, শাঁখারীবাজারের ছেলে থেকে শুরু করে মুসলমান বসতি যেখানে শুরু হয়েছে—সব তল্লাটের ছেলেদের সঙ্গেই তাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিড়ের ভেতর হইচই করতে দেখা যায় এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই সমবয়সী ছেলেদের সাথে তাকে ঝগড়া করতে বা মারামারি কি হাতাহাতি করতেও দেখা যায়।
‘এই মেয়েটার মাথায় কি ছিট আছে? অর বয়সী মেয়েরা যখন লুকায়া একটা পোলার লগে সিনেমা দেখতে যায়, ও দেখি পোলাগো লগে রাস্তায় দাঁড়ায়া ঝগড়া করে, মাইরপিট করে। চেহারাও কিন্তু খারাপ না! অর মায়ে-বাপে কিছু দ্যাখে না?’
‘অর মায়েই লাই দেয়। কিছু বললে বলে, পোলাগো সাথে ঝগড়া বা মাইরপিট করলেও তার মাইয়ারে একলা কোনো পোলার লগে কেউ খারাপভাবে কখনো চলতে-ফিরতে দ্যাখছে? তয় তার মেয়ের বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আবার বুদ্ধি কম হইলেও চাকরি তো করতেছে একের পর এক। বুঝি না বাবা!’
‘অর মায়েরই দোষ। সারা জীবন মাইয়া তো চাকরি করবে না। অনেক পোলার সাথে আড্ডা বা ঝগড়াঝাটি করার চাইতে একটা ছেলে ধইরা কয়েক দিন মিলামিশা কইরা বিয়া করলেও তো হয়। আইজকাল তো এইভাবেও কত বিয়া হইতেছে। অর মায়ে মেয়েরে কোথায় বুঝাইবে তা না।’
‘দ্যাখো, হয়তো মেয়ের ইনকাম খায়।’
২. ‘মই মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া!’
ওয়ার্ড কমিশনার পদে শিখাদের পাড়ায় শুক্রবারের মিছিলে সবার আগে আছে শিখা। ওমা! পাশের গলি থেকে আর একটি মিছিল আসছে দেখি।
‘আনারস মার্কা দেখিয়া/ভোট দেবেন হাসিয়া।’
শিখার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ‘মই’ মার্কায় দাঁড়ানো প্রার্থী গত বছর এলাকায় কিছু কাজ করেছে। তার পাল্টা এই ‘আনারস’ মার্কার প্রার্থী আবার কে? একটা এসপার-ওসপার তো করা লাগে দেখি!
৩. জোড়পুল পদ্মনিধি লেনের জুতার ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় শিখার মুখোমুখি হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় পিটার। রাগ হয় তার। প্রায় পাঁচ বছর আগে কী মনে করে শিখা নিজে থেকে একবার এসে খানিকক্ষণ তার সাথে কথা বলল। ওমা! তারপর পিটার যতবার কথা বলতে যায়, শিখা সরে যায়। কিন্তু শিখার যে কারো সাথে প্রেম আছে, সেটাও পিটার অনেক খুঁজে বার করতে পারছে না। শিখা ওই রকমই ফ্যাক্টরিতে যায়, মাঝে মাঝে বেকার হয়, আবার কাজে ঢোকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনের বিকালে কখনো বান্ধবীদের সাথে আবার কখনো মহল্লার ছেলেদের সাথেও কথা বলতে দেখা যায়। কখনো কখনো ছেলেদের সাথে ঝগড়া বা মারপিটও চলে। কিন্তু কারো সাথে একা রিকশায় বা সিনেমা হলে কি খাবারের দোকানে—কোথাও কি দেখেছে? না, তাহলে শিখা কেন পিটারের সাথে এক দিনই কথা বলে আশা জাগিয়ে আবার এমন হয়ে গেল? পিটার অপেক্ষা করে আছে তো করেই আছে।
হারামজাদি শিখা...। নাকি শাঁখারীবাজারের সোলেমান যে ওর পিছু কিছুদিন ঘুরছিল—না, সোলেমানের সাথেও আলাদাভাবে ওকে দেখা যায়নি। ইদানীং শুনছে হাসি-খুশি সোলেমান না, গম্ভীর মুখের সুলতানকে নাকি শিখা একটু পছন্দ করত। কিন্তু সুলতানের সাথেও তো শিখাকে দেখা যায়নি কোথাও। মেয়েরা একটু ঘুরলে-ফিরলে কি দেখা যায় না? তাহলে এই পিশাচি কেন পিটারের কাছে আসে না? পিটার আর কত দিন একা থাকবে?
৪. এক শুক্রবার গিয়ে আরেক শুক্রবার ছুটির দিন। বিকাল বেলা মহল্লার গলিতে ডালপুরি কিনতে গিয়ে শিখার চোখ ছানাবড়া। গলির দেয়ালে এই নতুন ছেলেটা কে পোস্টার মারছে? তা-ও আবার ‘আনারস’ মার্কার পোস্টার! বারে বাহ্, পোস্টার মারছে তো মারছেই। তা-ও কিনা শিখাদের পাড়ায়? দু-এক মিনিট চুপ থেকে অসহ্য লাগে শিখার।
‘এই যে, আপনি আনারস মার্কার পোস্টার দিতেছেন ক্যান?’
অবাক হয়ে আনারসের চিকা মারা ছেলেটা তার দিকে তাকায়।
‘আনারস মার্কার পোস্টার মারছি আমার ইচ্ছা!’
‘না, আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টারই থাকবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে শিখার দিকে তাকিয়ে আবার আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটতে থাকে। ভালো তো?
‘কথা শুনছেন? আমাদের পাড়ায় মই মার্কার পোস্টার ছাড়া কিছু চলবে না।’
‘তুমি কে?’
ছেলেটা খুবই বিরক্ত হয়ে শিখার দিকে তাকায়, ‘আমি আনারস মার্কার পোস্টারই সাঁটব।’
‘আমি কে মানে? আমি এই পাড়ারই মেয়ে, তুমি কে?’
‘আমি আনারস মার্কার প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের সূত্রাপুর থানার সম্পাদক।’
‘হুমম-সম্পাদক। ভাগো তো!’
‘তোমার কথায় ভাগব নাকি?’
আজব ছেলে তো! তাদের পাড়ায় কেন আনারস মার্কার পোস্টার চলবে? শিখা থাকতে এমন হতেই পারে না। তাদের পাড়ায় চলবে মই মার্কার পোস্টার। কাজেই শিখা তর্ক চালাতে থাকে। আর নতুন ছেলেটাও মুখে মুখে জবাব দিতে থাকে। হুট করে কী যেন হয় শিখার। পাগলি হরিদাসীর দিকে ফিরে বলে, ‘মাসি, তোমার দোকানে ওই ইটের টুকরা আর নারকেলের আইচার যে মালা রাখো, একটা দাও তো!’
‘কী করবি?’
‘অপজিশনরে দেব।’
‘পাঁচ টাকা লাগবে।
‘নেও।’
পাঁচ টাকায় একটা গুলতির মালা নিয়ে এসে শিখা হনহন করে নতুন ছেলেটা যেখানে নিজেই একটি মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দেয়ালে আনারস মার্কার পোস্টার সাঁটছে, সেদিকে এসে হুট করে ছেলেটার দিকে গুলতির মালা ছুড়ে মারল। পরবি তো পর গুলতির মালা, ছেলেটার গলায় ঢুকে গেল। ছেলেটি এক ঝলক বোকা বনে গিয়ে সে-ও হুড়মুড় করে মই থেকে নেমে—ওমা! সে-ও হরিদাসীর দোকানের দিকে ছুটছে। এক লহমায় তার হাতেও একটি গুলতির মালা এবং সেও গুলতির মালা শিখার দিকে ছুড়ল।
‘ঠাকুর, এই মেয়ে কী বেহায়া! একটা অচেনা ছেলের গলায় মালা দিয়া বসল!’
শিখা হুট করে একটি তির্যক মন্তব্যে পেছন ফিরে দেখে একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে এবং প্রথম মন্তব্যের পরেই আর একটি মন্তব্য ছিটকে এল—‘ভরত হারামজাদাও দেখি পাল্টা এই মেয়ের গলায় মালা দিল। আরে ভরত হারামজাদার বিয়া ঠিক, তবু...’
অবাক শিখা পাল্টা প্রতিবাদ করে যেই না বলতে গেল, ‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা কি কোনো ফুলের মালা? এইটা তো গুলতির মালা, অপজিশনরে দ্যায়!’
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই শিখা দ্যাখে তার মা ছুটে আসছে এবং শিখার ভয়ানক শান্ত, নরম মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিখার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে চড় কষিয়ে বলতে থাকে, ‘কলঙ্কিনী, বেজাতের ছেলের গলায় মালা দিলি? তা-ও যে ছেলের বিয়া ঠিক?’
এই ভরত কে? সে নাকি পাশের পাড়ায় দুই বছর অন্য শহরে কাজ করে ফিরেছে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিও ছুটে আসে।
‘এই রাক্ষসী, তুই আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলের গলায় মালা দিলি ক্যান?’
‘আপনারা ভুল করতেছেন। এইটা গুলতির মালা।’
কিন্তু পুরো কথা শিখার আর বলা হয় না। আশপাশের তিন-চার পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে ভরত ও শিখা যে দুই পাপী এবং তারা এত দিন লুকিয়ে এবং এখন প্রকাশ্যে বেলেল্লাপনা শুরু করেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত মন্তব্য করতে থাকে। দুজনকেই নিজের নিজের মানুষেরা রাস্তার ওপরেই প্রচণ্ড পেটানো শুরু করে। অনেকটা সাপ পেটানোর মতো। পেটাতে পেটাতে এবং গালি দিতে দিতে তাদের যে যার পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৫. ‘এই পাড়ায় লুকায়া লুকায়া কত মেয়ে কত কী করে! বিয়ার আগে পেটে বাচ্চা আসছে এমন মেয়েও লুকায়া গর্ভ নষ্ট করার পর আবার বিয়া হয়। আর তুই কিনা বলদের মতো এক গুলতির মালা দিয়া এত কলঙ্কিনী হইলি? কবে তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে? মেয়েমানুষের ছেলেদের মতো নির্বাচনের প্রচারে নামা, কে ওয়ার্ড কমিশনার হবে কি না, মই না আনারসের পোস্টার—এসব ভাবার দরকারই নাই। সমাজ এতে মেয়েদের খারাপ মনে করে’—শিখার বিধবা পিসি মায়ের হাত থেকে শিখাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর দিয়ে শিখাকে আড়াল করতে করতে বলেন।
৬. ভরতের সাথে দেখা হলো মাসখানেক পরে। আশপাশের কয়েকটা মহল্লায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। কয়েক দফা মার খেয়ে তাদের দুজনেরই হাতে-পায়ে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। শিখার ফ্যাক্টরি এক মাস করোনায় বন্ধ ছিল। আজ খুলেছে। আজ বের হতেই হবে। যতই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ুক। কিন্তু আসলে ভরতের সাথে সে কী করেছে? ওই মালাটা তো কোনো ফুলের মালা ছিল না, ছিল কিনা একটা গুলতির মালা, যা অপজিশনকে দেয়।
ওমা! পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে—গলির মোড়েই ভরত। একী! ওর হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? খানিকটা মন খারাপও লাগে তার। তারা না হয় মই আর আনারস মার্কা নিয়ে ঝগড়া করেছে, কিন্তু লোকজন তাদের পেটালই বা কেন, আর এত নোংরা কথাই বা বলছে কেন?
‘অনেক পিটান খাইছিস?’
শক্ত মুখে বলে শিখা।
ভরত ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ব্যান্ডেজ লাগছে? এত পিটান কে পিটাইল?’
‘লক্ষ্মীর বাপের বাড়ির লোকেরা।’
‘মানে, তোর হবু বউয়ের বাড়ির লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে কী করতে হবে? তোর হবু বউ বা তার বাড়ির লোকজনরে বুঝাব?’
‘তারা তো বুঝতেছে না। ইয়ে...মানে, তোমার চোখ-মুখ ফোলা কেন?’
‘মাইর খাইছি।’ শুকনো মুখে বলে ফ্যাক্টরির দিকে পা বাড়ায় শিখা।
কিন্তু জোসেফের কী হবে? নতুন ঢাকায় একটা রেস্তোরাঁয় শেফের কাজ করা জোসেফের সাথে পরিচয় হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। ছোট মাসির বাসায়। মাসতুতো দাদার বন্ধু। শিখার ফোন নম্বর নিয়ে প্রায়ই ফোন করত।
‘কাউকে ভালো লাগেনি তোমার কখনো?’
‘পিটারকে ভালো লাগছিল, কিন্তু...’
‘তয় লজ্জাও লাগত, তাই এড়ায়া যাইতাম!’
‘আমি কিন্তু খোঁজ-খবর নিছি। সোলেমান পোলাডা একবার সাকরাইনের ঘুড়ি ওড়ানোয় তোমার মুখ ঘুড়িতে আঁকছিল, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে ভালো লাগে নাই?’
‘হ্যাঁ, ঘুড়িতে আমার মুখ আঁকার পরে কিছুদিন খুব ঢি ঢি পড়ছিল। কিন্তু ও তো অন্য সম্প্রদায়ের পোলা। আমি তাই দূরে দূরে থাকতাম। এ ছাড়া সুলতান...’
‘সুলতান কে?’
‘সোলেমানের আগেই পরিচয়। ভারি জিদ্দি পোলা। মুখ ফুইটা কোনো দিন কিছু বলেও নাই। কিন্তু শুধু এক জিদ। আমার গায়ে মাছিটাও বসতে পারব না। তাইলেই আমারে খুন করবে। ভয়ে আমিও আগাইতে পারি নাই। তবে মন টানছিল এটা ঠিক। কিন্তু ওরে আমার সব সময়ই ভয় করত।’
‘ও বিয়া করছে?’
‘এই সেদিন। সোলেমান অনেক আগেই বিয়া করছে। পিটার কিন্তু একা। কাল সকালে আবার ফ্যাক্টরি আছে।’
‘তুমি ঘুমাবে, না?’
অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে যেত শিখা। জোসেফের মতো সারা রাত জেগে মোবাইলে কথা সে বলতে পারে না। তার ঘুম পেয়ে যায়। আর জোসেফ মন খারাপ করে। তবে জোসেফ ভালো। কোনো দিন কোনো খারাপ কথা বলে নাই। কিন্তু সবাইকে সরিয়ে কোথাকার কোন ভরত—কেন যে সে আনারস মার্কা আর সে মই মার্কার পোস্টার দিতে গিয়ে কথা-কাটাকাটি থেকে গুলতির মালা ছুড়তে গিয়ে এত ঝামেলা হলো? না পিটার, না জোসেফ আর কেউ তাকে কোনো দিন মনে করবে? ভরতের সাথে লক্ষ্মীর সবকিছু জোড়া লাগুক...কিন্তু লক্ষ্মী তাকে অনেক গালি দিয়েছে...লক্ষ্মীর বন্ধু-পরিবারও...আর ভরত পোলাডাও এত মাইর খাইল শুধু শুধু।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৮ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৩ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়।
২৮ আগস্ট ২০২২
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৩ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়।
২৮ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৮ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়।
২৮ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৮ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৩ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

নানা কিছুর মালা হয় পৃথিবীতে। ফুলের মালা, পুঁতির মালা থেকে বিয়েবাড়িতে কনের গলায় সোনার হার—কী না? শিখা গুলতির মালা বানানো প্রথম শেখে হরিদাসী পাগলির কাছ থেকে। হরিদাসী বুড়িকে সবাই ‘পাগলি ‘ডাকে কেন কে জানে! মোটেই সে পাগলি নয়।
২৮ আগস্ট ২০২২
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৮ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৩ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৯ দিন আগে