মাসউদ আহমাদ

শুভর সূচনা করতে প্রত্যেকটি নতুন সকালই তোমার জন্য এক একটি সুযোগ।
গৌতম বুদ্ধ
ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টেবিলে চায়ের কাপ ঠান্ডা হতে থাকে। কম্পিউটার সে অন করেছে ঠিকই, একবারও মাউস ছুঁয়ে দেখেনি।
রাহাত আলম একটি জাতীয় দৈনিকের মফস্বল বিভাগে কাজ করে। নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে অফিসে তার সুনাম আছে। বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে সে কাজ সামলে নিতে জানে। সাত বছরে ওর কোনো প্রমোশন হয়নি, কাজের বিভাগও বদল হয়নি।
রাহাত আলম একজন কবি। এখনকার চালু সমাজে দেওয়ার মতো এটা কোনো পরিচয় নয়। তার স্ত্রী নুসরাত তো প্রকাশ্যেই বলে ফেলে, ‘কবি-সাহিত্যিক আমার পছন্দ নয়।’
বয়সে তরুণ, কবিতা ছাপাও হয় কম; তবু কবিখ্যাতি আছে রাহাত আলমের। বাংলাদেশের সব নামী কাগজে তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একটি-দুটি গল্প, গদ্য, কখনো গ্রন্থালোচনা। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায়ও তার কবিতা বেরিয়েছে। নিজস্ব রুচি ও চরিত্রের কারণে প্রচারের আলো থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রাখে। অফিসে তার বিভাগের লোকও অনেক দিন জানত না, সে কবিতা লেখে। একটা নামী পুরস্কার পাওয়ার পর পত্রিকায় খবর বেরোয়, ছবিসহ। অন্যদের সঙ্গে বিভাগের ইনচার্জও চোখ বড় করে তাকায়, আরেব্বাস। ভেতরে-ভেতরে তাহলে এই?
এরপর রাহাত আলমের খানিকটা উপকার হয়। সে যে নির্জন, মৃদু ও মগ্নচরিত্রের মানুষ, অনেকে দেখলেও ঠিক বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারে। ভাবে, লোকটা অন্য রকম। কাজের প্রেশার থাকলেও তাকে সমঝে চলে। এতে সে-ও খুশি।
রাহাত নিজে বড় দৈনিকে কাজ করে, কিন্তু যেচে কখনো সাহিত্য পাতার সম্পাদককে কবিতা দেয় না। এমনকি ক্যানটিনে তারা একসঙ্গে চা খায়, হাঁটে, তবু কবিতার কথা তোলে না।
অস্বস্তির শুরু ডেস্কে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ বোলানোর সময়।
বিকেলের মুখে অফিসে ঢোকে রাহাত আলম। কাঁধের ব্যাগ ও ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখে। কম্পিউটারের সুইচ অন করে। এরপর ধীরপায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফিরে এসে হাতমুখ মুছতে মুছতে পত্রিকায় চোখ বোলায়। ততক্ষণে চিনি ছাড়া লাল চা এসে যায়। যন্ত্রচালিতের মতো চা খেতে খেতে আয়েশি ভঙ্গিতে দরকারি খবরগুলো পড়তে থাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে সে একটা খবর খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। ভেতরে চারের পাতায় সিঙ্গেল কলামে সে খবরটা দেখে, পড়ে এবং বিরক্তি নিয়ে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। চায়ের কাপ ঠেলে সে চেয়ারে শরীর ছেড়ে দেয়।
গত রাতে রাহাত নিজে খবরটা রেডি করে দিয়ে যায়। পেজ মেকআপের সময় তার মনে হয়, খবরটা মফস্বল পাতায় না ছাপিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো উচিত। বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে সে কথাও বলেছিল। তিনি রাজি ছিলেন। পরে হাতবদল হয়ে খবরটা প্রায় নাই হয়ে গেল?
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে একটি এলাকার নাম বাঘের বাজার। এই পথে যাত্রীবাহী বাস ‘নীরব’ নিয়মিত চলাচল করে। ঈদের ছুটি শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরছিল সন্তানসহ এক দম্পতি। ঈদ কবেই চলে গেছে, তবু অতিরিক্ত ভাড়া কাটছিল সুপারভাইজার। ভাড়া কেন বেশি নেবে? প্রতিবাদ করলে যাত্রী ও বাসকর্মীর মধ্যে উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে জোর করে বাঘের বাজারে লোকটিকে নামিয়ে দেয়। বাসের ভেতর রয়ে যায় তার স্ত্রী-সন্তান। লোকটি বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত তুলে চিৎকার করে, প্রতিবাদ জানায়। ড্রাইভার কড়া চোখে দেখে লোকটিকে এবং মুহূর্তেই তাকে পিষে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। তার বউ ও বাচ্চাকে নামিয়ে দেয় পরের স্টপেজে।
স্থানীয় প্রতিনিধি টেলিফোনে যখন ঘটনার বিবরণ দেয়, চোখ ভিজে আসে রাহাত আলমের।
দুর্ঘটনার খবরটি ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়; বড়লোকের বাড়িতে ফকির-মিসকিনকে যেভাবে লাইনে বসিয়ে খাওয়ানো হয়, সেভাবে। ভালো করে না দেখলে চোখেও পড়বে না। অথচ ড্রাগন ফলের উপকার নিয়ে ফিচার ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়।
হতাশা ও অন্তর্গত ক্ষোভে সে ফেটে পড়ে। চেয়ার ছেড়ে ইনচার্জের ঘরে যায়। টেবিলে শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
বস, এটা কী হলো?
কোনটা কী হলো?
রাহাত পুরো ব্যাপারটা পূর্বাপর মনে করিয়ে দেয়।
রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মফস্বলের বিভাগীয় প্রধান হা হা করে হাসতে থাকেন।
রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি হাসছেন কেন?
বিভাগীয় প্রধান শরীর দুলিয়ে আবারও হাসতে থাকেন। হাসি থামতেই চায় না। তাঁর চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। একসময় হাসি থামিয়ে বলেন, রাহাত সাহেব, আপনি খুবই ইমম্যাচিউরড কথা বলছেন।
রাহাত নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
খবর কোনটা কোথায় ছাপা হবে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথার তো কোনো কারণ নেই। না?
কী বলছেন? সাংবাদিকেরা কেবল খবরপ্রচারক নন, জাতির বিবেকও। স্বার্থ ও পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের কাজ করতে হয়।
বিভাগীয় প্রধান আবারও হাসতে থাকেন। কিন্তু এবার হাসতে হাসতেই ব্রেক কষেন; দেখুন রাহাত, করপোরেট লাইফ সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। শহুরে জীবনে আপনার মতো মানুষেরা অযোগ্য। মূল্যহীন।
কী বলছেন আপনি?
আপনি গ্রামের বাড়িতে হালচাষ করলে ভালো করতেন। করপোরেট দুনিয়ায় আপনারা বেমানান। অপটু। উটকো।
ইনচার্জের শেষ কথার পর আর দাঁড়ায় না রাহাত আলম। মৃদুপায়ে সে ডেস্কে ফিরে আসে। কিছু একটা করা দরকার। তীব্র তর্ক। প্রতিবাদ। অথবা কেবলই কথা। বসের কথার একটা দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া দরকার; সে মনে মনে ভাবে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! একটা শব্দও মাথায় আসে না রাহাতের। অথচ শব্দের ভেতর-বাইরের রূপ-রস-গন্ধ নিয়েই সে কারবার করে। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে কাকের যেমন বিব্রত ও ল্যাদল্যাদে অবস্থা হয়, তার শব্দেরা আজ তেমন এলোমেলো, দিশাহীন।
জগতের কোনো চাকরিই বিশুদ্ধ নয়। চাকরি মানেই একধরনের পরাধীনতা। সংবাদপত্রের কাজটা রাহাত পছন্দ করে। মাস শেষ হলেই বেতন মেলে, তা-ও নয়। কাজের ফাঁকে এখানে ভাববার অবকাশ আছে, চারপাশের মানুষ ও ছবি দেখার খোলা আকাশ আছে। প্রান্তরের মতো মুক্তির সাধ আছে। অন্য অনেক চাকরিতে যা নেই। সে কারণেই চাকরিটা সে বেছে নিয়েছিল।
আজ কী যে হলো, অফিসের সবকিছু অচেনা আর অর্থহীন লাগছে।
পিয়নকে ইশারা করতেই ডেস্ক থেকে পত্রিকা ও চায়ের কাপ সরিয়ে নিয়ে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
রাহাত মৃদুপায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। রাহাতের কোনো চাপ নেই। তবু সে বাথরুমে বসে থাকে। বেশ কিছু সময় কেটে যায়। তার শিশ্নে একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হয়। তবু সে বেরোয় না। নানা কথা মনে আসে। একবার মনে হয়, জায়গাটার নাম কেন বাঘের বাজার হলো?
অনেক দিন আগে, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বাঘের বাজার হয়ে রাহাত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। কী চমৎকার আয়োজন। খালি চোখে না দেখলে অনুমান করা শক্ত, দেশীয় একটা পার্কে এত পশুপাখি আর চোখজুড়ানো সমাহার থাকতে পারে।
কিন্তু জায়গাটার নামের রহস্য খোঁজ করেও সে পায়নি।
কোনো এক সময় এখানে বাঘের রাজ্য ছিল; এমনটা হতে পারে। মানুষ যখন নিজেই বাঘরূপে আবির্ভূত হয়, সত্যিকারের বাঘের পলায়ন ছাড়া গতি থাকে না। এখন অবশ্য সাফারি পার্কের ভেতরে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়ায়। দেখে মায়া ও বিভ্রম হয়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে সে নিজের ডেস্কে আসে। কম্পিউটারে দ্রুতগতিতে কিছু একটা টাইপ করে। একবার আড়চোখে লেখাটা পড়ে। প্রিন্ট করে। কাগজের নিচের দিকে খসখস করে একটা সিগনেচার ও তারিখ দেয়। বিভাগীয় প্রধানের ঘরে যায়। ইনচার্জের চোখে সে তাকায় না, কথাও বলে না। কাগজটা টেবিলে রেখে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। কাগজ হাতে নিয়ে ইনচার্জ বিস্ফারিত চোখে তাকান। তাঁকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে রাহাত সরে যায়। ডেস্ক থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় রাহাত আলমের। হাতমুখ ধুয়ে সে বসার ঘরে যায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি ছাড়বে, তখনই কানে আসে, মেয়ে গভীর গলায় কবিতা পড়ছে।
স্ত্রী বলেছিল, মেয়েটা টেলিভিশনে খবর পাঠের স্বপ্ন দেখে। কবিতা আবৃত্তির কোর্সে ভর্তি হতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কম পয়সায় ভালো আবৃত্তি শেখায়। রাহাত সময় করে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে বউই নিয়ে গিয়েছিল মেয়েকে।
এক মাসেই মেয়ে এমন চমৎকার কবিতাপাঠ শিখে ফেলেছে! রাহাত খুব অবাক ও মুগ্ধ হয়।
এমনভাবে মেয়েটা কবিতা পড়ছে যেন তার নিজেরই কথা। উচ্চারণ ও ভঙ্গি এতটা নিবিড়; আত্মবিশ্বাসে ভরা। রাহাত এত দিনেও কবিতাটির মর্মার্থটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি, এতটুকুন মেয়ে টের পেয়ে গেল?
রিমোট পাশে সরিয়ে রাহাত সোফায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা এপাশ-ওপাশ ফেরায়। মেয়েটা গলায় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পড়তে থাকে:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।...
কী চমৎকার! নিজের মনেই কথাগুলো বলে রাহাত।
রাবেয়া এসে পাশে দাঁড়ায়; কখন এলে? যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।
রাবেয়ার চোখে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকায়; নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে কবিতা পড়ে, জানতই না রাহাত। পড়ার ধরন উপলব্ধি করে মনে হয়, কবিতার ভেতরগত ভাবার্থ সে নিখুঁতভাবে রপ্তও করে নিয়েছে।
স্বামীকে এভাবে তাকাতে দেখে রাবেয়া বলে, কী হয়েছে তোমার?
রাহাত মাথা ঝাঁকায়; কিছু না। তুমি যাও, খাবারটা গরম করো।
একসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুব পড়েছে রাহাত। সে এক অদ্ভুত জিনিস; বিভোর করে ফেলে। এখন খুব একটা পড়া হয় না। অসামান্য কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ। পড়তে পড়তে মুগ্ধ করে। বুঁদ করে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল; কিন্তু তাঁর কবিতা ক্রমশ করাপ্ট করে ফেলে।
মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটা ঢের পড়েছে। বারবার পড়েছে। কেমন আচ্ছন্ন করে রাখত।
কিন্তু মেয়ে যে কবিতাটি পড়ছে, আবার পড়ছে, আরও একবার পড়ছে, এ যেন রাহাতের জীবনের গোপন-প্রামাণ্য রেখাচিত্র।
এতটুকুন মেয়ে আমার, যে এখনো কোলে এসে বলে, বাবা, ঘোড়া হও; সেই মেয়ে চলমান সময়ের নার্ভটা ধরে ফেলল? অথচ সে বুড়ো দামড়া হয়েও সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারল না?
নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় আর বাতিল মানুষ বলে অনুভূত হতে থাকে রাহাতের। রাতে স্ত্রী ও মেয়ে শুয়ে পড়লে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাড়ে বারোটার মতোন বাজে। একটা সিগারেট ধরায়। পথে এখনো অজস্র গাড়ি ও মানুষের ভিড়। সবার মধ্যে তাড়া ঘরে ফেরার, কিংবা ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার। পিছু ফেরার কারও সময় নেই।
একসময় নিজেকে একটা বুনো এলাকায় আবিষ্কার করে রাহাত আলম।
বাতাসে ফুলের সুরভি ও পাখির কিচিরমিচির; দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। হিমেল হাওয়ায় জলের আভাস। সে অনুভব করে, এখানে স্ত্রী-কন্যা-চাকরির দায় ও দহন নেই। অপার্থিব আলো-হাওয়া-ঘ্রাণের ঢেউ তাকে উদাসী করে তোলে। একি ঘুম, না বিভ্রম; রাহাত বুঝতে পারে না। সে হাঁটতে থাকে। পথের দুপাশে বিচিত্র গাছ ও অচেনা লতাগুল্ম, মাঝরাস্তায় রাহাত; নিঃসঙ্গ ও একা।

শুভর সূচনা করতে প্রত্যেকটি নতুন সকালই তোমার জন্য এক একটি সুযোগ।
গৌতম বুদ্ধ
ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টেবিলে চায়ের কাপ ঠান্ডা হতে থাকে। কম্পিউটার সে অন করেছে ঠিকই, একবারও মাউস ছুঁয়ে দেখেনি।
রাহাত আলম একটি জাতীয় দৈনিকের মফস্বল বিভাগে কাজ করে। নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে অফিসে তার সুনাম আছে। বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে সে কাজ সামলে নিতে জানে। সাত বছরে ওর কোনো প্রমোশন হয়নি, কাজের বিভাগও বদল হয়নি।
রাহাত আলম একজন কবি। এখনকার চালু সমাজে দেওয়ার মতো এটা কোনো পরিচয় নয়। তার স্ত্রী নুসরাত তো প্রকাশ্যেই বলে ফেলে, ‘কবি-সাহিত্যিক আমার পছন্দ নয়।’
বয়সে তরুণ, কবিতা ছাপাও হয় কম; তবু কবিখ্যাতি আছে রাহাত আলমের। বাংলাদেশের সব নামী কাগজে তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একটি-দুটি গল্প, গদ্য, কখনো গ্রন্থালোচনা। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায়ও তার কবিতা বেরিয়েছে। নিজস্ব রুচি ও চরিত্রের কারণে প্রচারের আলো থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রাখে। অফিসে তার বিভাগের লোকও অনেক দিন জানত না, সে কবিতা লেখে। একটা নামী পুরস্কার পাওয়ার পর পত্রিকায় খবর বেরোয়, ছবিসহ। অন্যদের সঙ্গে বিভাগের ইনচার্জও চোখ বড় করে তাকায়, আরেব্বাস। ভেতরে-ভেতরে তাহলে এই?
এরপর রাহাত আলমের খানিকটা উপকার হয়। সে যে নির্জন, মৃদু ও মগ্নচরিত্রের মানুষ, অনেকে দেখলেও ঠিক বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারে। ভাবে, লোকটা অন্য রকম। কাজের প্রেশার থাকলেও তাকে সমঝে চলে। এতে সে-ও খুশি।
রাহাত নিজে বড় দৈনিকে কাজ করে, কিন্তু যেচে কখনো সাহিত্য পাতার সম্পাদককে কবিতা দেয় না। এমনকি ক্যানটিনে তারা একসঙ্গে চা খায়, হাঁটে, তবু কবিতার কথা তোলে না।
অস্বস্তির শুরু ডেস্কে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ বোলানোর সময়।
বিকেলের মুখে অফিসে ঢোকে রাহাত আলম। কাঁধের ব্যাগ ও ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখে। কম্পিউটারের সুইচ অন করে। এরপর ধীরপায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফিরে এসে হাতমুখ মুছতে মুছতে পত্রিকায় চোখ বোলায়। ততক্ষণে চিনি ছাড়া লাল চা এসে যায়। যন্ত্রচালিতের মতো চা খেতে খেতে আয়েশি ভঙ্গিতে দরকারি খবরগুলো পড়তে থাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে সে একটা খবর খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। ভেতরে চারের পাতায় সিঙ্গেল কলামে সে খবরটা দেখে, পড়ে এবং বিরক্তি নিয়ে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। চায়ের কাপ ঠেলে সে চেয়ারে শরীর ছেড়ে দেয়।
গত রাতে রাহাত নিজে খবরটা রেডি করে দিয়ে যায়। পেজ মেকআপের সময় তার মনে হয়, খবরটা মফস্বল পাতায় না ছাপিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো উচিত। বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে সে কথাও বলেছিল। তিনি রাজি ছিলেন। পরে হাতবদল হয়ে খবরটা প্রায় নাই হয়ে গেল?
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে একটি এলাকার নাম বাঘের বাজার। এই পথে যাত্রীবাহী বাস ‘নীরব’ নিয়মিত চলাচল করে। ঈদের ছুটি শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরছিল সন্তানসহ এক দম্পতি। ঈদ কবেই চলে গেছে, তবু অতিরিক্ত ভাড়া কাটছিল সুপারভাইজার। ভাড়া কেন বেশি নেবে? প্রতিবাদ করলে যাত্রী ও বাসকর্মীর মধ্যে উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে জোর করে বাঘের বাজারে লোকটিকে নামিয়ে দেয়। বাসের ভেতর রয়ে যায় তার স্ত্রী-সন্তান। লোকটি বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত তুলে চিৎকার করে, প্রতিবাদ জানায়। ড্রাইভার কড়া চোখে দেখে লোকটিকে এবং মুহূর্তেই তাকে পিষে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। তার বউ ও বাচ্চাকে নামিয়ে দেয় পরের স্টপেজে।
স্থানীয় প্রতিনিধি টেলিফোনে যখন ঘটনার বিবরণ দেয়, চোখ ভিজে আসে রাহাত আলমের।
দুর্ঘটনার খবরটি ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়; বড়লোকের বাড়িতে ফকির-মিসকিনকে যেভাবে লাইনে বসিয়ে খাওয়ানো হয়, সেভাবে। ভালো করে না দেখলে চোখেও পড়বে না। অথচ ড্রাগন ফলের উপকার নিয়ে ফিচার ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়।
হতাশা ও অন্তর্গত ক্ষোভে সে ফেটে পড়ে। চেয়ার ছেড়ে ইনচার্জের ঘরে যায়। টেবিলে শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
বস, এটা কী হলো?
কোনটা কী হলো?
রাহাত পুরো ব্যাপারটা পূর্বাপর মনে করিয়ে দেয়।
রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মফস্বলের বিভাগীয় প্রধান হা হা করে হাসতে থাকেন।
রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি হাসছেন কেন?
বিভাগীয় প্রধান শরীর দুলিয়ে আবারও হাসতে থাকেন। হাসি থামতেই চায় না। তাঁর চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। একসময় হাসি থামিয়ে বলেন, রাহাত সাহেব, আপনি খুবই ইমম্যাচিউরড কথা বলছেন।
রাহাত নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
খবর কোনটা কোথায় ছাপা হবে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথার তো কোনো কারণ নেই। না?
কী বলছেন? সাংবাদিকেরা কেবল খবরপ্রচারক নন, জাতির বিবেকও। স্বার্থ ও পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের কাজ করতে হয়।
বিভাগীয় প্রধান আবারও হাসতে থাকেন। কিন্তু এবার হাসতে হাসতেই ব্রেক কষেন; দেখুন রাহাত, করপোরেট লাইফ সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। শহুরে জীবনে আপনার মতো মানুষেরা অযোগ্য। মূল্যহীন।
কী বলছেন আপনি?
আপনি গ্রামের বাড়িতে হালচাষ করলে ভালো করতেন। করপোরেট দুনিয়ায় আপনারা বেমানান। অপটু। উটকো।
ইনচার্জের শেষ কথার পর আর দাঁড়ায় না রাহাত আলম। মৃদুপায়ে সে ডেস্কে ফিরে আসে। কিছু একটা করা দরকার। তীব্র তর্ক। প্রতিবাদ। অথবা কেবলই কথা। বসের কথার একটা দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া দরকার; সে মনে মনে ভাবে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! একটা শব্দও মাথায় আসে না রাহাতের। অথচ শব্দের ভেতর-বাইরের রূপ-রস-গন্ধ নিয়েই সে কারবার করে। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে কাকের যেমন বিব্রত ও ল্যাদল্যাদে অবস্থা হয়, তার শব্দেরা আজ তেমন এলোমেলো, দিশাহীন।
জগতের কোনো চাকরিই বিশুদ্ধ নয়। চাকরি মানেই একধরনের পরাধীনতা। সংবাদপত্রের কাজটা রাহাত পছন্দ করে। মাস শেষ হলেই বেতন মেলে, তা-ও নয়। কাজের ফাঁকে এখানে ভাববার অবকাশ আছে, চারপাশের মানুষ ও ছবি দেখার খোলা আকাশ আছে। প্রান্তরের মতো মুক্তির সাধ আছে। অন্য অনেক চাকরিতে যা নেই। সে কারণেই চাকরিটা সে বেছে নিয়েছিল।
আজ কী যে হলো, অফিসের সবকিছু অচেনা আর অর্থহীন লাগছে।
পিয়নকে ইশারা করতেই ডেস্ক থেকে পত্রিকা ও চায়ের কাপ সরিয়ে নিয়ে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
রাহাত মৃদুপায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। রাহাতের কোনো চাপ নেই। তবু সে বাথরুমে বসে থাকে। বেশ কিছু সময় কেটে যায়। তার শিশ্নে একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হয়। তবু সে বেরোয় না। নানা কথা মনে আসে। একবার মনে হয়, জায়গাটার নাম কেন বাঘের বাজার হলো?
অনেক দিন আগে, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বাঘের বাজার হয়ে রাহাত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। কী চমৎকার আয়োজন। খালি চোখে না দেখলে অনুমান করা শক্ত, দেশীয় একটা পার্কে এত পশুপাখি আর চোখজুড়ানো সমাহার থাকতে পারে।
কিন্তু জায়গাটার নামের রহস্য খোঁজ করেও সে পায়নি।
কোনো এক সময় এখানে বাঘের রাজ্য ছিল; এমনটা হতে পারে। মানুষ যখন নিজেই বাঘরূপে আবির্ভূত হয়, সত্যিকারের বাঘের পলায়ন ছাড়া গতি থাকে না। এখন অবশ্য সাফারি পার্কের ভেতরে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়ায়। দেখে মায়া ও বিভ্রম হয়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে সে নিজের ডেস্কে আসে। কম্পিউটারে দ্রুতগতিতে কিছু একটা টাইপ করে। একবার আড়চোখে লেখাটা পড়ে। প্রিন্ট করে। কাগজের নিচের দিকে খসখস করে একটা সিগনেচার ও তারিখ দেয়। বিভাগীয় প্রধানের ঘরে যায়। ইনচার্জের চোখে সে তাকায় না, কথাও বলে না। কাগজটা টেবিলে রেখে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। কাগজ হাতে নিয়ে ইনচার্জ বিস্ফারিত চোখে তাকান। তাঁকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে রাহাত সরে যায়। ডেস্ক থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় রাহাত আলমের। হাতমুখ ধুয়ে সে বসার ঘরে যায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি ছাড়বে, তখনই কানে আসে, মেয়ে গভীর গলায় কবিতা পড়ছে।
স্ত্রী বলেছিল, মেয়েটা টেলিভিশনে খবর পাঠের স্বপ্ন দেখে। কবিতা আবৃত্তির কোর্সে ভর্তি হতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কম পয়সায় ভালো আবৃত্তি শেখায়। রাহাত সময় করে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে বউই নিয়ে গিয়েছিল মেয়েকে।
এক মাসেই মেয়ে এমন চমৎকার কবিতাপাঠ শিখে ফেলেছে! রাহাত খুব অবাক ও মুগ্ধ হয়।
এমনভাবে মেয়েটা কবিতা পড়ছে যেন তার নিজেরই কথা। উচ্চারণ ও ভঙ্গি এতটা নিবিড়; আত্মবিশ্বাসে ভরা। রাহাত এত দিনেও কবিতাটির মর্মার্থটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি, এতটুকুন মেয়ে টের পেয়ে গেল?
রিমোট পাশে সরিয়ে রাহাত সোফায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা এপাশ-ওপাশ ফেরায়। মেয়েটা গলায় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পড়তে থাকে:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।...
কী চমৎকার! নিজের মনেই কথাগুলো বলে রাহাত।
রাবেয়া এসে পাশে দাঁড়ায়; কখন এলে? যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।
রাবেয়ার চোখে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকায়; নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে কবিতা পড়ে, জানতই না রাহাত। পড়ার ধরন উপলব্ধি করে মনে হয়, কবিতার ভেতরগত ভাবার্থ সে নিখুঁতভাবে রপ্তও করে নিয়েছে।
স্বামীকে এভাবে তাকাতে দেখে রাবেয়া বলে, কী হয়েছে তোমার?
রাহাত মাথা ঝাঁকায়; কিছু না। তুমি যাও, খাবারটা গরম করো।
একসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুব পড়েছে রাহাত। সে এক অদ্ভুত জিনিস; বিভোর করে ফেলে। এখন খুব একটা পড়া হয় না। অসামান্য কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ। পড়তে পড়তে মুগ্ধ করে। বুঁদ করে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল; কিন্তু তাঁর কবিতা ক্রমশ করাপ্ট করে ফেলে।
মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটা ঢের পড়েছে। বারবার পড়েছে। কেমন আচ্ছন্ন করে রাখত।
কিন্তু মেয়ে যে কবিতাটি পড়ছে, আবার পড়ছে, আরও একবার পড়ছে, এ যেন রাহাতের জীবনের গোপন-প্রামাণ্য রেখাচিত্র।
এতটুকুন মেয়ে আমার, যে এখনো কোলে এসে বলে, বাবা, ঘোড়া হও; সেই মেয়ে চলমান সময়ের নার্ভটা ধরে ফেলল? অথচ সে বুড়ো দামড়া হয়েও সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারল না?
নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় আর বাতিল মানুষ বলে অনুভূত হতে থাকে রাহাতের। রাতে স্ত্রী ও মেয়ে শুয়ে পড়লে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাড়ে বারোটার মতোন বাজে। একটা সিগারেট ধরায়। পথে এখনো অজস্র গাড়ি ও মানুষের ভিড়। সবার মধ্যে তাড়া ঘরে ফেরার, কিংবা ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার। পিছু ফেরার কারও সময় নেই।
একসময় নিজেকে একটা বুনো এলাকায় আবিষ্কার করে রাহাত আলম।
বাতাসে ফুলের সুরভি ও পাখির কিচিরমিচির; দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। হিমেল হাওয়ায় জলের আভাস। সে অনুভব করে, এখানে স্ত্রী-কন্যা-চাকরির দায় ও দহন নেই। অপার্থিব আলো-হাওয়া-ঘ্রাণের ঢেউ তাকে উদাসী করে তোলে। একি ঘুম, না বিভ্রম; রাহাত বুঝতে পারে না। সে হাঁটতে থাকে। পথের দুপাশে বিচিত্র গাছ ও অচেনা লতাগুল্ম, মাঝরাস্তায় রাহাত; নিঃসঙ্গ ও একা।
মাসউদ আহমাদ

শুভর সূচনা করতে প্রত্যেকটি নতুন সকালই তোমার জন্য এক একটি সুযোগ।
গৌতম বুদ্ধ
ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টেবিলে চায়ের কাপ ঠান্ডা হতে থাকে। কম্পিউটার সে অন করেছে ঠিকই, একবারও মাউস ছুঁয়ে দেখেনি।
রাহাত আলম একটি জাতীয় দৈনিকের মফস্বল বিভাগে কাজ করে। নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে অফিসে তার সুনাম আছে। বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে সে কাজ সামলে নিতে জানে। সাত বছরে ওর কোনো প্রমোশন হয়নি, কাজের বিভাগও বদল হয়নি।
রাহাত আলম একজন কবি। এখনকার চালু সমাজে দেওয়ার মতো এটা কোনো পরিচয় নয়। তার স্ত্রী নুসরাত তো প্রকাশ্যেই বলে ফেলে, ‘কবি-সাহিত্যিক আমার পছন্দ নয়।’
বয়সে তরুণ, কবিতা ছাপাও হয় কম; তবু কবিখ্যাতি আছে রাহাত আলমের। বাংলাদেশের সব নামী কাগজে তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একটি-দুটি গল্প, গদ্য, কখনো গ্রন্থালোচনা। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায়ও তার কবিতা বেরিয়েছে। নিজস্ব রুচি ও চরিত্রের কারণে প্রচারের আলো থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রাখে। অফিসে তার বিভাগের লোকও অনেক দিন জানত না, সে কবিতা লেখে। একটা নামী পুরস্কার পাওয়ার পর পত্রিকায় খবর বেরোয়, ছবিসহ। অন্যদের সঙ্গে বিভাগের ইনচার্জও চোখ বড় করে তাকায়, আরেব্বাস। ভেতরে-ভেতরে তাহলে এই?
এরপর রাহাত আলমের খানিকটা উপকার হয়। সে যে নির্জন, মৃদু ও মগ্নচরিত্রের মানুষ, অনেকে দেখলেও ঠিক বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারে। ভাবে, লোকটা অন্য রকম। কাজের প্রেশার থাকলেও তাকে সমঝে চলে। এতে সে-ও খুশি।
রাহাত নিজে বড় দৈনিকে কাজ করে, কিন্তু যেচে কখনো সাহিত্য পাতার সম্পাদককে কবিতা দেয় না। এমনকি ক্যানটিনে তারা একসঙ্গে চা খায়, হাঁটে, তবু কবিতার কথা তোলে না।
অস্বস্তির শুরু ডেস্কে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ বোলানোর সময়।
বিকেলের মুখে অফিসে ঢোকে রাহাত আলম। কাঁধের ব্যাগ ও ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখে। কম্পিউটারের সুইচ অন করে। এরপর ধীরপায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফিরে এসে হাতমুখ মুছতে মুছতে পত্রিকায় চোখ বোলায়। ততক্ষণে চিনি ছাড়া লাল চা এসে যায়। যন্ত্রচালিতের মতো চা খেতে খেতে আয়েশি ভঙ্গিতে দরকারি খবরগুলো পড়তে থাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে সে একটা খবর খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। ভেতরে চারের পাতায় সিঙ্গেল কলামে সে খবরটা দেখে, পড়ে এবং বিরক্তি নিয়ে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। চায়ের কাপ ঠেলে সে চেয়ারে শরীর ছেড়ে দেয়।
গত রাতে রাহাত নিজে খবরটা রেডি করে দিয়ে যায়। পেজ মেকআপের সময় তার মনে হয়, খবরটা মফস্বল পাতায় না ছাপিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো উচিত। বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে সে কথাও বলেছিল। তিনি রাজি ছিলেন। পরে হাতবদল হয়ে খবরটা প্রায় নাই হয়ে গেল?
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে একটি এলাকার নাম বাঘের বাজার। এই পথে যাত্রীবাহী বাস ‘নীরব’ নিয়মিত চলাচল করে। ঈদের ছুটি শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরছিল সন্তানসহ এক দম্পতি। ঈদ কবেই চলে গেছে, তবু অতিরিক্ত ভাড়া কাটছিল সুপারভাইজার। ভাড়া কেন বেশি নেবে? প্রতিবাদ করলে যাত্রী ও বাসকর্মীর মধ্যে উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে জোর করে বাঘের বাজারে লোকটিকে নামিয়ে দেয়। বাসের ভেতর রয়ে যায় তার স্ত্রী-সন্তান। লোকটি বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত তুলে চিৎকার করে, প্রতিবাদ জানায়। ড্রাইভার কড়া চোখে দেখে লোকটিকে এবং মুহূর্তেই তাকে পিষে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। তার বউ ও বাচ্চাকে নামিয়ে দেয় পরের স্টপেজে।
স্থানীয় প্রতিনিধি টেলিফোনে যখন ঘটনার বিবরণ দেয়, চোখ ভিজে আসে রাহাত আলমের।
দুর্ঘটনার খবরটি ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়; বড়লোকের বাড়িতে ফকির-মিসকিনকে যেভাবে লাইনে বসিয়ে খাওয়ানো হয়, সেভাবে। ভালো করে না দেখলে চোখেও পড়বে না। অথচ ড্রাগন ফলের উপকার নিয়ে ফিচার ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়।
হতাশা ও অন্তর্গত ক্ষোভে সে ফেটে পড়ে। চেয়ার ছেড়ে ইনচার্জের ঘরে যায়। টেবিলে শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
বস, এটা কী হলো?
কোনটা কী হলো?
রাহাত পুরো ব্যাপারটা পূর্বাপর মনে করিয়ে দেয়।
রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মফস্বলের বিভাগীয় প্রধান হা হা করে হাসতে থাকেন।
রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি হাসছেন কেন?
বিভাগীয় প্রধান শরীর দুলিয়ে আবারও হাসতে থাকেন। হাসি থামতেই চায় না। তাঁর চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। একসময় হাসি থামিয়ে বলেন, রাহাত সাহেব, আপনি খুবই ইমম্যাচিউরড কথা বলছেন।
রাহাত নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
খবর কোনটা কোথায় ছাপা হবে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথার তো কোনো কারণ নেই। না?
কী বলছেন? সাংবাদিকেরা কেবল খবরপ্রচারক নন, জাতির বিবেকও। স্বার্থ ও পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের কাজ করতে হয়।
বিভাগীয় প্রধান আবারও হাসতে থাকেন। কিন্তু এবার হাসতে হাসতেই ব্রেক কষেন; দেখুন রাহাত, করপোরেট লাইফ সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। শহুরে জীবনে আপনার মতো মানুষেরা অযোগ্য। মূল্যহীন।
কী বলছেন আপনি?
আপনি গ্রামের বাড়িতে হালচাষ করলে ভালো করতেন। করপোরেট দুনিয়ায় আপনারা বেমানান। অপটু। উটকো।
ইনচার্জের শেষ কথার পর আর দাঁড়ায় না রাহাত আলম। মৃদুপায়ে সে ডেস্কে ফিরে আসে। কিছু একটা করা দরকার। তীব্র তর্ক। প্রতিবাদ। অথবা কেবলই কথা। বসের কথার একটা দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া দরকার; সে মনে মনে ভাবে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! একটা শব্দও মাথায় আসে না রাহাতের। অথচ শব্দের ভেতর-বাইরের রূপ-রস-গন্ধ নিয়েই সে কারবার করে। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে কাকের যেমন বিব্রত ও ল্যাদল্যাদে অবস্থা হয়, তার শব্দেরা আজ তেমন এলোমেলো, দিশাহীন।
জগতের কোনো চাকরিই বিশুদ্ধ নয়। চাকরি মানেই একধরনের পরাধীনতা। সংবাদপত্রের কাজটা রাহাত পছন্দ করে। মাস শেষ হলেই বেতন মেলে, তা-ও নয়। কাজের ফাঁকে এখানে ভাববার অবকাশ আছে, চারপাশের মানুষ ও ছবি দেখার খোলা আকাশ আছে। প্রান্তরের মতো মুক্তির সাধ আছে। অন্য অনেক চাকরিতে যা নেই। সে কারণেই চাকরিটা সে বেছে নিয়েছিল।
আজ কী যে হলো, অফিসের সবকিছু অচেনা আর অর্থহীন লাগছে।
পিয়নকে ইশারা করতেই ডেস্ক থেকে পত্রিকা ও চায়ের কাপ সরিয়ে নিয়ে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
রাহাত মৃদুপায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। রাহাতের কোনো চাপ নেই। তবু সে বাথরুমে বসে থাকে। বেশ কিছু সময় কেটে যায়। তার শিশ্নে একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হয়। তবু সে বেরোয় না। নানা কথা মনে আসে। একবার মনে হয়, জায়গাটার নাম কেন বাঘের বাজার হলো?
অনেক দিন আগে, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বাঘের বাজার হয়ে রাহাত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। কী চমৎকার আয়োজন। খালি চোখে না দেখলে অনুমান করা শক্ত, দেশীয় একটা পার্কে এত পশুপাখি আর চোখজুড়ানো সমাহার থাকতে পারে।
কিন্তু জায়গাটার নামের রহস্য খোঁজ করেও সে পায়নি।
কোনো এক সময় এখানে বাঘের রাজ্য ছিল; এমনটা হতে পারে। মানুষ যখন নিজেই বাঘরূপে আবির্ভূত হয়, সত্যিকারের বাঘের পলায়ন ছাড়া গতি থাকে না। এখন অবশ্য সাফারি পার্কের ভেতরে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়ায়। দেখে মায়া ও বিভ্রম হয়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে সে নিজের ডেস্কে আসে। কম্পিউটারে দ্রুতগতিতে কিছু একটা টাইপ করে। একবার আড়চোখে লেখাটা পড়ে। প্রিন্ট করে। কাগজের নিচের দিকে খসখস করে একটা সিগনেচার ও তারিখ দেয়। বিভাগীয় প্রধানের ঘরে যায়। ইনচার্জের চোখে সে তাকায় না, কথাও বলে না। কাগজটা টেবিলে রেখে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। কাগজ হাতে নিয়ে ইনচার্জ বিস্ফারিত চোখে তাকান। তাঁকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে রাহাত সরে যায়। ডেস্ক থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় রাহাত আলমের। হাতমুখ ধুয়ে সে বসার ঘরে যায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি ছাড়বে, তখনই কানে আসে, মেয়ে গভীর গলায় কবিতা পড়ছে।
স্ত্রী বলেছিল, মেয়েটা টেলিভিশনে খবর পাঠের স্বপ্ন দেখে। কবিতা আবৃত্তির কোর্সে ভর্তি হতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কম পয়সায় ভালো আবৃত্তি শেখায়। রাহাত সময় করে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে বউই নিয়ে গিয়েছিল মেয়েকে।
এক মাসেই মেয়ে এমন চমৎকার কবিতাপাঠ শিখে ফেলেছে! রাহাত খুব অবাক ও মুগ্ধ হয়।
এমনভাবে মেয়েটা কবিতা পড়ছে যেন তার নিজেরই কথা। উচ্চারণ ও ভঙ্গি এতটা নিবিড়; আত্মবিশ্বাসে ভরা। রাহাত এত দিনেও কবিতাটির মর্মার্থটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি, এতটুকুন মেয়ে টের পেয়ে গেল?
রিমোট পাশে সরিয়ে রাহাত সোফায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা এপাশ-ওপাশ ফেরায়। মেয়েটা গলায় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পড়তে থাকে:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।...
কী চমৎকার! নিজের মনেই কথাগুলো বলে রাহাত।
রাবেয়া এসে পাশে দাঁড়ায়; কখন এলে? যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।
রাবেয়ার চোখে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকায়; নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে কবিতা পড়ে, জানতই না রাহাত। পড়ার ধরন উপলব্ধি করে মনে হয়, কবিতার ভেতরগত ভাবার্থ সে নিখুঁতভাবে রপ্তও করে নিয়েছে।
স্বামীকে এভাবে তাকাতে দেখে রাবেয়া বলে, কী হয়েছে তোমার?
রাহাত মাথা ঝাঁকায়; কিছু না। তুমি যাও, খাবারটা গরম করো।
একসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুব পড়েছে রাহাত। সে এক অদ্ভুত জিনিস; বিভোর করে ফেলে। এখন খুব একটা পড়া হয় না। অসামান্য কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ। পড়তে পড়তে মুগ্ধ করে। বুঁদ করে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল; কিন্তু তাঁর কবিতা ক্রমশ করাপ্ট করে ফেলে।
মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটা ঢের পড়েছে। বারবার পড়েছে। কেমন আচ্ছন্ন করে রাখত।
কিন্তু মেয়ে যে কবিতাটি পড়ছে, আবার পড়ছে, আরও একবার পড়ছে, এ যেন রাহাতের জীবনের গোপন-প্রামাণ্য রেখাচিত্র।
এতটুকুন মেয়ে আমার, যে এখনো কোলে এসে বলে, বাবা, ঘোড়া হও; সেই মেয়ে চলমান সময়ের নার্ভটা ধরে ফেলল? অথচ সে বুড়ো দামড়া হয়েও সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারল না?
নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় আর বাতিল মানুষ বলে অনুভূত হতে থাকে রাহাতের। রাতে স্ত্রী ও মেয়ে শুয়ে পড়লে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাড়ে বারোটার মতোন বাজে। একটা সিগারেট ধরায়। পথে এখনো অজস্র গাড়ি ও মানুষের ভিড়। সবার মধ্যে তাড়া ঘরে ফেরার, কিংবা ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার। পিছু ফেরার কারও সময় নেই।
একসময় নিজেকে একটা বুনো এলাকায় আবিষ্কার করে রাহাত আলম।
বাতাসে ফুলের সুরভি ও পাখির কিচিরমিচির; দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। হিমেল হাওয়ায় জলের আভাস। সে অনুভব করে, এখানে স্ত্রী-কন্যা-চাকরির দায় ও দহন নেই। অপার্থিব আলো-হাওয়া-ঘ্রাণের ঢেউ তাকে উদাসী করে তোলে। একি ঘুম, না বিভ্রম; রাহাত বুঝতে পারে না। সে হাঁটতে থাকে। পথের দুপাশে বিচিত্র গাছ ও অচেনা লতাগুল্ম, মাঝরাস্তায় রাহাত; নিঃসঙ্গ ও একা।

শুভর সূচনা করতে প্রত্যেকটি নতুন সকালই তোমার জন্য এক একটি সুযোগ।
গৌতম বুদ্ধ
ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টেবিলে চায়ের কাপ ঠান্ডা হতে থাকে। কম্পিউটার সে অন করেছে ঠিকই, একবারও মাউস ছুঁয়ে দেখেনি।
রাহাত আলম একটি জাতীয় দৈনিকের মফস্বল বিভাগে কাজ করে। নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে অফিসে তার সুনাম আছে। বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে সে কাজ সামলে নিতে জানে। সাত বছরে ওর কোনো প্রমোশন হয়নি, কাজের বিভাগও বদল হয়নি।
রাহাত আলম একজন কবি। এখনকার চালু সমাজে দেওয়ার মতো এটা কোনো পরিচয় নয়। তার স্ত্রী নুসরাত তো প্রকাশ্যেই বলে ফেলে, ‘কবি-সাহিত্যিক আমার পছন্দ নয়।’
বয়সে তরুণ, কবিতা ছাপাও হয় কম; তবু কবিখ্যাতি আছে রাহাত আলমের। বাংলাদেশের সব নামী কাগজে তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একটি-দুটি গল্প, গদ্য, কখনো গ্রন্থালোচনা। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায়ও তার কবিতা বেরিয়েছে। নিজস্ব রুচি ও চরিত্রের কারণে প্রচারের আলো থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সরিয়ে রাখে। অফিসে তার বিভাগের লোকও অনেক দিন জানত না, সে কবিতা লেখে। একটা নামী পুরস্কার পাওয়ার পর পত্রিকায় খবর বেরোয়, ছবিসহ। অন্যদের সঙ্গে বিভাগের ইনচার্জও চোখ বড় করে তাকায়, আরেব্বাস। ভেতরে-ভেতরে তাহলে এই?
এরপর রাহাত আলমের খানিকটা উপকার হয়। সে যে নির্জন, মৃদু ও মগ্নচরিত্রের মানুষ, অনেকে দেখলেও ঠিক বুঝতে পারত না। এখন বুঝতে পারে। ভাবে, লোকটা অন্য রকম। কাজের প্রেশার থাকলেও তাকে সমঝে চলে। এতে সে-ও খুশি।
রাহাত নিজে বড় দৈনিকে কাজ করে, কিন্তু যেচে কখনো সাহিত্য পাতার সম্পাদককে কবিতা দেয় না। এমনকি ক্যানটিনে তারা একসঙ্গে চা খায়, হাঁটে, তবু কবিতার কথা তোলে না।
অস্বস্তির শুরু ডেস্কে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকায় চোখ বোলানোর সময়।
বিকেলের মুখে অফিসে ঢোকে রাহাত আলম। কাঁধের ব্যাগ ও ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখে। কম্পিউটারের সুইচ অন করে। এরপর ধীরপায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফিরে এসে হাতমুখ মুছতে মুছতে পত্রিকায় চোখ বোলায়। ততক্ষণে চিনি ছাড়া লাল চা এসে যায়। যন্ত্রচালিতের মতো চা খেতে খেতে আয়েশি ভঙ্গিতে দরকারি খবরগুলো পড়তে থাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে সে একটা খবর খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। ভেতরে চারের পাতায় সিঙ্গেল কলামে সে খবরটা দেখে, পড়ে এবং বিরক্তি নিয়ে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। চায়ের কাপ ঠেলে সে চেয়ারে শরীর ছেড়ে দেয়।
গত রাতে রাহাত নিজে খবরটা রেডি করে দিয়ে যায়। পেজ মেকআপের সময় তার মনে হয়, খবরটা মফস্বল পাতায় না ছাপিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো উচিত। বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে সে কথাও বলেছিল। তিনি রাজি ছিলেন। পরে হাতবদল হয়ে খবরটা প্রায় নাই হয়ে গেল?
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে একটি এলাকার নাম বাঘের বাজার। এই পথে যাত্রীবাহী বাস ‘নীরব’ নিয়মিত চলাচল করে। ঈদের ছুটি শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরছিল সন্তানসহ এক দম্পতি। ঈদ কবেই চলে গেছে, তবু অতিরিক্ত ভাড়া কাটছিল সুপারভাইজার। ভাড়া কেন বেশি নেবে? প্রতিবাদ করলে যাত্রী ও বাসকর্মীর মধ্যে উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে জোর করে বাঘের বাজারে লোকটিকে নামিয়ে দেয়। বাসের ভেতর রয়ে যায় তার স্ত্রী-সন্তান। লোকটি বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত তুলে চিৎকার করে, প্রতিবাদ জানায়। ড্রাইভার কড়া চোখে দেখে লোকটিকে এবং মুহূর্তেই তাকে পিষে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। তার বউ ও বাচ্চাকে নামিয়ে দেয় পরের স্টপেজে।
স্থানীয় প্রতিনিধি টেলিফোনে যখন ঘটনার বিবরণ দেয়, চোখ ভিজে আসে রাহাত আলমের।
দুর্ঘটনার খবরটি ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়; বড়লোকের বাড়িতে ফকির-মিসকিনকে যেভাবে লাইনে বসিয়ে খাওয়ানো হয়, সেভাবে। ভালো করে না দেখলে চোখেও পড়বে না। অথচ ড্রাগন ফলের উপকার নিয়ে ফিচার ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়।
হতাশা ও অন্তর্গত ক্ষোভে সে ফেটে পড়ে। চেয়ার ছেড়ে ইনচার্জের ঘরে যায়। টেবিলে শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
বস, এটা কী হলো?
কোনটা কী হলো?
রাহাত পুরো ব্যাপারটা পূর্বাপর মনে করিয়ে দেয়।
রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মফস্বলের বিভাগীয় প্রধান হা হা করে হাসতে থাকেন।
রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি হাসছেন কেন?
বিভাগীয় প্রধান শরীর দুলিয়ে আবারও হাসতে থাকেন। হাসি থামতেই চায় না। তাঁর চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের ভাব। একসময় হাসি থামিয়ে বলেন, রাহাত সাহেব, আপনি খুবই ইমম্যাচিউরড কথা বলছেন।
রাহাত নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
খবর কোনটা কোথায় ছাপা হবে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথার তো কোনো কারণ নেই। না?
কী বলছেন? সাংবাদিকেরা কেবল খবরপ্রচারক নন, জাতির বিবেকও। স্বার্থ ও পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের কাজ করতে হয়।
বিভাগীয় প্রধান আবারও হাসতে থাকেন। কিন্তু এবার হাসতে হাসতেই ব্রেক কষেন; দেখুন রাহাত, করপোরেট লাইফ সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। শহুরে জীবনে আপনার মতো মানুষেরা অযোগ্য। মূল্যহীন।
কী বলছেন আপনি?
আপনি গ্রামের বাড়িতে হালচাষ করলে ভালো করতেন। করপোরেট দুনিয়ায় আপনারা বেমানান। অপটু। উটকো।
ইনচার্জের শেষ কথার পর আর দাঁড়ায় না রাহাত আলম। মৃদুপায়ে সে ডেস্কে ফিরে আসে। কিছু একটা করা দরকার। তীব্র তর্ক। প্রতিবাদ। অথবা কেবলই কথা। বসের কথার একটা দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া দরকার; সে মনে মনে ভাবে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! একটা শব্দও মাথায় আসে না রাহাতের। অথচ শব্দের ভেতর-বাইরের রূপ-রস-গন্ধ নিয়েই সে কারবার করে। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে কাকের যেমন বিব্রত ও ল্যাদল্যাদে অবস্থা হয়, তার শব্দেরা আজ তেমন এলোমেলো, দিশাহীন।
জগতের কোনো চাকরিই বিশুদ্ধ নয়। চাকরি মানেই একধরনের পরাধীনতা। সংবাদপত্রের কাজটা রাহাত পছন্দ করে। মাস শেষ হলেই বেতন মেলে, তা-ও নয়। কাজের ফাঁকে এখানে ভাববার অবকাশ আছে, চারপাশের মানুষ ও ছবি দেখার খোলা আকাশ আছে। প্রান্তরের মতো মুক্তির সাধ আছে। অন্য অনেক চাকরিতে যা নেই। সে কারণেই চাকরিটা সে বেছে নিয়েছিল।
আজ কী যে হলো, অফিসের সবকিছু অচেনা আর অর্থহীন লাগছে।
পিয়নকে ইশারা করতেই ডেস্ক থেকে পত্রিকা ও চায়ের কাপ সরিয়ে নিয়ে যায়। রাহাত কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
রাহাত মৃদুপায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে থাকে।
বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। রাহাতের কোনো চাপ নেই। তবু সে বাথরুমে বসে থাকে। বেশ কিছু সময় কেটে যায়। তার শিশ্নে একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হয়। তবু সে বেরোয় না। নানা কথা মনে আসে। একবার মনে হয়, জায়গাটার নাম কেন বাঘের বাজার হলো?
অনেক দিন আগে, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বাঘের বাজার হয়ে রাহাত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। কী চমৎকার আয়োজন। খালি চোখে না দেখলে অনুমান করা শক্ত, দেশীয় একটা পার্কে এত পশুপাখি আর চোখজুড়ানো সমাহার থাকতে পারে।
কিন্তু জায়গাটার নামের রহস্য খোঁজ করেও সে পায়নি।
কোনো এক সময় এখানে বাঘের রাজ্য ছিল; এমনটা হতে পারে। মানুষ যখন নিজেই বাঘরূপে আবির্ভূত হয়, সত্যিকারের বাঘের পলায়ন ছাড়া গতি থাকে না। এখন অবশ্য সাফারি পার্কের ভেতরে জ্যান্ত বাঘ ঘুরে বেড়ায়। দেখে মায়া ও বিভ্রম হয়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে সে নিজের ডেস্কে আসে। কম্পিউটারে দ্রুতগতিতে কিছু একটা টাইপ করে। একবার আড়চোখে লেখাটা পড়ে। প্রিন্ট করে। কাগজের নিচের দিকে খসখস করে একটা সিগনেচার ও তারিখ দেয়। বিভাগীয় প্রধানের ঘরে যায়। ইনচার্জের চোখে সে তাকায় না, কথাও বলে না। কাগজটা টেবিলে রেখে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। কাগজ হাতে নিয়ে ইনচার্জ বিস্ফারিত চোখে তাকান। তাঁকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে রাহাত সরে যায়। ডেস্ক থেকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায় রাহাত আলমের। হাতমুখ ধুয়ে সে বসার ঘরে যায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি ছাড়বে, তখনই কানে আসে, মেয়ে গভীর গলায় কবিতা পড়ছে।
স্ত্রী বলেছিল, মেয়েটা টেলিভিশনে খবর পাঠের স্বপ্ন দেখে। কবিতা আবৃত্তির কোর্সে ভর্তি হতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কম পয়সায় ভালো আবৃত্তি শেখায়। রাহাত সময় করে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে বউই নিয়ে গিয়েছিল মেয়েকে।
এক মাসেই মেয়ে এমন চমৎকার কবিতাপাঠ শিখে ফেলেছে! রাহাত খুব অবাক ও মুগ্ধ হয়।
এমনভাবে মেয়েটা কবিতা পড়ছে যেন তার নিজেরই কথা। উচ্চারণ ও ভঙ্গি এতটা নিবিড়; আত্মবিশ্বাসে ভরা। রাহাত এত দিনেও কবিতাটির মর্মার্থটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি, এতটুকুন মেয়ে টের পেয়ে গেল?
রিমোট পাশে সরিয়ে রাহাত সোফায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড়টা এপাশ-ওপাশ ফেরায়। মেয়েটা গলায় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পড়তে থাকে:
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।...
কী চমৎকার! নিজের মনেই কথাগুলো বলে রাহাত।
রাবেয়া এসে পাশে দাঁড়ায়; কখন এলে? যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।
রাবেয়ার চোখে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকায়; নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে কবিতা পড়ে, জানতই না রাহাত। পড়ার ধরন উপলব্ধি করে মনে হয়, কবিতার ভেতরগত ভাবার্থ সে নিখুঁতভাবে রপ্তও করে নিয়েছে।
স্বামীকে এভাবে তাকাতে দেখে রাবেয়া বলে, কী হয়েছে তোমার?
রাহাত মাথা ঝাঁকায়; কিছু না। তুমি যাও, খাবারটা গরম করো।
একসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুব পড়েছে রাহাত। সে এক অদ্ভুত জিনিস; বিভোর করে ফেলে। এখন খুব একটা পড়া হয় না। অসামান্য কবিতা লিখে গেছেন জীবনানন্দ। পড়তে পড়তে মুগ্ধ করে। বুঁদ করে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল; কিন্তু তাঁর কবিতা ক্রমশ করাপ্ট করে ফেলে।
মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটা ঢের পড়েছে। বারবার পড়েছে। কেমন আচ্ছন্ন করে রাখত।
কিন্তু মেয়ে যে কবিতাটি পড়ছে, আবার পড়ছে, আরও একবার পড়ছে, এ যেন রাহাতের জীবনের গোপন-প্রামাণ্য রেখাচিত্র।
এতটুকুন মেয়ে আমার, যে এখনো কোলে এসে বলে, বাবা, ঘোড়া হও; সেই মেয়ে চলমান সময়ের নার্ভটা ধরে ফেলল? অথচ সে বুড়ো দামড়া হয়েও সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারল না?
নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় আর বাতিল মানুষ বলে অনুভূত হতে থাকে রাহাতের। রাতে স্ত্রী ও মেয়ে শুয়ে পড়লে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাড়ে বারোটার মতোন বাজে। একটা সিগারেট ধরায়। পথে এখনো অজস্র গাড়ি ও মানুষের ভিড়। সবার মধ্যে তাড়া ঘরে ফেরার, কিংবা ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার। পিছু ফেরার কারও সময় নেই।
একসময় নিজেকে একটা বুনো এলাকায় আবিষ্কার করে রাহাত আলম।
বাতাসে ফুলের সুরভি ও পাখির কিচিরমিচির; দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। হিমেল হাওয়ায় জলের আভাস। সে অনুভব করে, এখানে স্ত্রী-কন্যা-চাকরির দায় ও দহন নেই। অপার্থিব আলো-হাওয়া-ঘ্রাণের ঢেউ তাকে উদাসী করে তোলে। একি ঘুম, না বিভ্রম; রাহাত বুঝতে পারে না। সে হাঁটতে থাকে। পথের দুপাশে বিচিত্র গাছ ও অচেনা লতাগুল্ম, মাঝরাস্তায় রাহাত; নিঃসঙ্গ ও একা।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টে
১৪ অক্টোবর ২০২৩
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টে
১৪ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টে
১৪ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৬ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

ডিসিপ্লিন জিনিসটা তার বড় পছন্দের; তবু কোনো এক অলৌকিক ইশারায়, জুন মাসের এক সন্ধ্যায় সাংবাদিকতার চাকরিটা ছেড়ে দেয় রাহাত আলম। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিসে এসি চলছে, সহকর্মীরা ডেস্কে নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে, বাইরে বৃষ্টি; তবু কোথাও একটা অস্বস্তিকর গুমোট হাওয়া সে টের পায়। কাজে কোনোভাবেই মনটা থিতু হয় না। টে
১৪ অক্টোবর ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৫ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১০ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৬ দিন আগে