Ajker Patrika

নীরার চিঠি

নাজমুল ইসলাম 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাস্টার সাহেব..

চোখ মেলে দেখি সাদা পরী আকাশি রঙের খাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। সমুদ্র পাড়ের বেঞ্চে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছি। হাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “সাঁতারু ও জলকন্যা”। সমুদ্রের ঢেউ এর আছড়ে পড়ার শব্দ আর ঝিরি ঝিরি বাতাসে খুব বেশিক্ষণ বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনি। কয়েক পাতা পড়তেই চোখের পাতা জোড়া এক হয়ে এসেছে। মাস্টার সাহেব ডাকটা শুনেই তন্দ্রা ভাব কেটে গেল। আমার এক ছাত্রী আমাকে এই নামে ডাকত।

নীরা। নদীর মতো শান্ত। যতটা বিনয়ী হলে একজন অপরিচিত মানুষ কাউকে সম্মান করে, ততটাই সে বিনয়ী। নীরার ধারণা আমি নীরাকে এড়িয়ে চলতাম। পৃথিবীতে অনেক রকমের মানুষ আছে। তার মধ্যে এক রকম আছে যারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বা ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। আমি আপাদমস্তক সেই দলের সক্রিয় সদস্য। যার কারণে নীরা কখনো জানেইনি, তাঁর চলাফেরা, আনাগোনা, উপস্থিতি আমার হৃৎস্পন্দনকে অস্বাভাবিক করে তুলত। আমার ভাবনার বড় একটা জায়গা জুড়ে ছিল নীরা। ভাবাত ওর ছোট ছোট করে কথা বলা কিংবা নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়া। ও কখন জানেওনি আমি দূর থেকে ওর ফিরে যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকেছি।

পরীর চুলগুলো সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। সাদা ফ্রক পরনে। বয়স কত হবে। ৭ বা ৮ বছর। পরী আমার হাতে খামটা দিয়ে, আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। দৌড়ে চলে গেল। এই খাম আমার খুবই পরিচিত। বছরের একটা নির্দিষ্ট মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই নীরা আমাকে এই খাম দিত। ভেতরে কয়েকটা চকলেট। খামের ওপর লেখা থাকত, হ্যাপি বার্থডে। নীরার বিয়ের পর আমি আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। এমন না যে আগেও বেশ যোগাযোগ ছিল। ওর বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর আমার অফিসের ঠিকানায় প্রেরকবিহীন এই খাম এসেছে। তবে এই খামের মুখটা আটকানো না। ভেতরে চকলেট ছাড়াও একটা চিঠির অস্তিত্ব বুঝতে পারলাম। কেন জানি পরীর ফিরে যাওয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হল না। মন বলছিল নীরা হয়তো কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। কি মনে হলো, নীরা দেখে যাক আমি তাঁর চিঠি পড়ছি। চিঠিটা বের করলাম। গোটা গোটা হাতের লেখা। পরিচিত। বেশ পরিচিত।

মাস্টার সাহেব,

আমি কে এটা এতক্ষণে আপনার বুঝে যাওয়ার কথা। আপনাকে আমি যত দূর চিনি তাতে করে, আমি কে এটা জানার জন্য আপনার নিউরনগুলো হয়তো খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি করবে না। সকালে আপনি যখন হোটেলের কাউন্টারে কথা বলছিলেন, কথার শব্দ শুনে আমার মনে হয়েছিল, এই শব্দ আমার চেনা। তারপর চাবি নিয়ে যখন লিফটের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই নিশ্চিত হয়েছি এটা আপনি। বেশ মোটা হয়ে গেছেন। আগের চেয়ে বেশ ধীর। মোটা ফ্রেমের চশমা নিয়েছেন। আপনার চুল বড় রাখার অভ্যাসটা যায়নি এখন। আমরা সপরিবারে ঘুরতে এসেছি। আজকে আপনার জন্মদিন আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখে মনে পড়ল। ২০ বছর আগে আপনাকে যে চকলেট দিতাম সেটা এখানে খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। খামটা আমার নিজের বানানো।

আপনি যখন এই চিঠি পড়ছেন, আমি বেশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখছি। জানি, আপনি পেছনে ফিরে তাকাবেন না। আর, অনেকটা সেই ভরসাই দাঁড়িয়ে আছি। পরী, আমার মেয়ে। আমার চেয়ে বেশি শান্ত। আপনার অনেক গল্পই পরীর জানা। প্রথম দিকে পরী ভাবত, মাস্টার হয়তো অন্য কোনো প্রজাতি। ওকে বোঝাতে বেশ সময় লেগেছে। ওর কথা, মাস্টার কেন? টিচার না হয় স্যার বলবা। ওকে বুঝিয়েছি আমার মাস্টার সাহেব একজনই। বাকিরা শিক্ষক।

আপনাকে শেষ দেখেছিলাম প্রায় ৮ বছর আগে। আপনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা খুব কষ্টে সংবরণ করেছি। আপনার মনে আছে, একবার আমি খুব জিদ করেছিলাম নৌকা করে ঘুরব বলে (যদিও এ ছাড়া আপনাকে কোথাও যেতে রাজি করাতে পারিনি।), আপনি নদীর পাড় পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছিলেন। খুব কান্না করেছিলাম। পরে আমার রুমমেটকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনাকে ছবি পাঠিয়েছিলাম। আপনি শুধু বলেছিলেন, ভালো। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কেন আমাকে নৌকা করে ঘোরাননি। আপনি বলেছিলেন, স্মৃতি বাড়িয়ে লাভ কি। এগুলো বেশ কষ্ট দেবে। কি জানি আপনি আগেই জানতেন আজকে এই দিন আসবে হয়তো। আপনি যখন পড়াতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতাম। কতটা সহজ, সাবলীল। মাঝে মাঝে ভাবতাম আপনি বোধ হয় আমাকে এড়িয়ে যান, তাই পড়ানোর সময় আমার দিয়ে খেয়াল করতেন না। পরে বুঝতাম, ক্লাসে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিতেন। তাই সবার দিকে সমান ভাবে লক্ষ্য রাখতেন। আর সেজন্যই হয়তো ছাত্রদের মধ্যে আপনার এত জনপ্রিয়তা।

খুব ইচ্ছে হয় আপনাকে ফোন দিয়ে বলি, মাস্টার সাহেব, কেমন আছেন। পড়ানোর আগে সিগারেট খেয়ে চুইংগাম চিবাতেন, সেগুলো এখনো করেন কি না। এখন একা একা খুব সকালে নদীর পাড় ধরে হাঁটেন কি না। বিবেকের তাড়নায় সেটা আর হয়ে উঠে না। পেরে উঠি না। সেদিন নাকি আব্বার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল। আব্বা এসে গল্প করছিল। মা প্রায়ই আপনার কথা জিজ্ঞেস করে। ভালো লাগে এই ভেবে যে, এই মানুষগুলোর কাছে আপনাকে অসম্মানিত করি নি। সবাই আপনাকে এখন ছেলের মতোই জানে। অনেক কথা বলার ছিল। বলতে পারলাম না। কথা গুলো কেমন জানি সব অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দোয়া করি সুস্থ থাকেন ভালো থাকেন।

ইতি

নীরা

বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সামনে ছোট বড় সব বয়সের মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে। কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত। কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ছেলে মেয়েরা গলা মিলিয়ে গান গাইছে, “আবার এলো যে সন্ধ্যা”। আমি বসে আছি। হাতে নীরার চিঠি। “সাঁতারু ও জলকন্যার” মাঝে চিঠিখানা রেখা, বইটা দুই হাতে বুকে ধরে সমুদ্রের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি। নীরার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারলে ভালো লাগত, ভালো থেকো। অনেক অনেক ভালো থেকো।

২৪শে মাঘ, ১৪২৬।

নাজমুল ইসলাম সাদ্দাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত