Ajker Patrika

নোয়া হারারির নেক্সাস: তথ্যের বদৌলতে ‘ডিস্টোপিয়ান’ সমাজের ভবিষ্যদ্বাণী

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
আগামী দিনে এআই মানব সমাজের নিয়ন্ত্রক অবস্থানে চলে যেতে পারে। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ব্রিটিশ দার্শনিক জন মিলটন ১৬৪৪ সালে প্রকাশিত তাঁর পুস্তিকা ‘অ্যারিওপ্যাজেটিকাতে’ বলেছিলেন, ‘সত্য আর মিথ্যার লড়াই হোক।’ মূলত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে যুক্তি দিয়ে লেখাটি লিখেছিলেন মিলটন। তিনি বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা ভুল বা বিভ্রান্তিকর কাজকেও সামনে আসার সুযোগ দেবে। তবে এসব ভুল-ভ্রান্তি মুদ্রণের বাইরে থাকলে আরও খারাপ ধারণা ছড়াবে। তাই সবকিছুকেই প্রকাশের সুযোগ দেওয়া ভালো এবং পরস্পরবিরোধী মতাদর্শগুলোকে যুক্তির ময়দানে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়া উচিত। মিলটন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, সঠিক তথ্য অপতথ্যকে পরাস্ত করবে এবং মিথ্যার ‘ধুলো ও ছাই’ সত্যের অস্ত্রাগারকে পালিশ করে চকচকে হতে সাহায্য করবে।

ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ নোয়া হারারি তাঁর বই ‘নেক্সাসে’ এই অবস্থানকে তথ্যের প্রতি ‘অতি সরল দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, বেশি তথ্য সব সময় ভালো এবং সত্য উদ্‌ঘাটনে সহায়ক—এই বিষয়টি ভ্রান্ত। কারণ, ইন্টারনেট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়নি এবং বর্ণবৈষম্যকেও তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দূর করা যায় না। তবে বস্তুগত সত্য বলে কিছু নেই এবং তথ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত—এমন জনতুষ্টিবাদী ধারণার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছেন হারারি। (তিনি উল্লেখ করেছেন, সত্যকে ভ্রান্তি হিসেবে দেখার ধারণা—যা ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা গ্রহণ করেছেন—আসলে কার্ল মার্ক্স ও মিশেল ফুকোর মতো বামপন্থী চিন্তাবিদদের কাছ থেকে এসেছে।)

নোয়া হারারির একজন টেকনো-ফিউচারিস্ট (যারা ভাবেন যে, প্রযুক্তি মানুষকে একটি আরও উন্নত ভবিষ্যৎ দেবে) হিসেবে তিনি ভবিষ্যতের ভয়াবহ দৃশ্যপট নিয়ে ভাবেন এবং তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। ‘নেক্সাসে’ নোয়া হারারি প্রস্তর যুগ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশের যুগ পর্যন্ত তথ্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। হারারি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘তথ্য কী, এটি কীভাবে মানব নেটওয়ার্ক গঠনে সাহায্য করে এবং এটি সত্য ও ক্ষমতার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত।’ তিনি বলেন, তথ্যের বিকাশের ইতিহাসে পাঠ বর্তমানের বড় বড় তথ্য সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এআই-এর রাজনৈতিক প্রভাব এবং গণতন্ত্রের প্রতি বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ঝুঁকি।

নেক্সাসে নোয়া হারারি তাঁর বিশ্লেষণ শুরু করেছেন তথ্যের একটি নতুন সংজ্ঞা দিয়ে। তার মতে, বেশিরভাগ তথ্য কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে না এবং সত্যের সঙ্গে এর কোনো মৌলিক সম্পর্ক নেই। তথ্যের সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিনিধিত্ব নয় বরং সংযোগ। তথ্য বাস্তবতাকে ধারণ করার কোনো পদ্ধতি নয় বরং ‘ধারণা’ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষকে সংযুক্ত ও সংগঠিত করার একটি উপায়। (তিনি একে ‘সামাজিক নেক্সাস বা সংযোগস্থল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।) প্রাথমিক তথ্যপ্রযুক্তি—যেমন: গল্প, মাটির ফলক বা ধর্মীয় গ্রন্থ এবং পরে পত্রিকা ও রেডিও সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

নোয়া হারারি তাঁর আগের বইগুলোর (সেপিয়েন্স ও হোমো ডিউস) একটি তর্কের ওপর ভিত্তি করে এগিয়েছেন। এই তর্ক হলো—মানুষ অন্যান্য প্রজাতির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে কারণ, তারা বড় সংখ্যায় নমনীয়ভাবে সহযোগিতা করতে পারে। এই ধরনের যোগাযোগকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রত্যক্ষ ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তি সংযোগ ছাড়াও, মানুষ নিজেদের মধ্যে গল্প ও মিথ গড়ে তুলেছে। আইন, দেবতা, মুদ্রা এবং জাতীয়তাগুলো হলো সেই সব অদৃশ্য বিষয়, যা শেয়ার করা বর্ণনার মাধ্যমেই মানুষের অস্তিত্বে ওঠে আসে। এই গল্পগুলো পুরোপুরি সঠিক হওয়ার প্রয়োজন নেই; কল্পকাহিনীর সুবিধা হলো এটি সরলীকৃত হতে পারে এবং অস্বস্তিদায়ক বা কষ্টদায়ক সত্যগুলো এড়িয়ে যেতে পারে।

মিথের বিপরীত হলো তালিকা। যা আকর্ষণীয় না হলেও বাস্তবতাকে ধরার চেষ্টা করে এবং যা থেকে আমলাতন্ত্রের উদ্ভব হয়। সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মিথ এবং আমলাতন্ত্র—দুটোরই প্রয়োজন। নোয়া হারারি পবিত্র গ্রন্থগুলোর রচনা ও ব্যাখ্যা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভবকে বিশ্বাস ও ভ্রান্তির প্রশ্নে, শৃঙ্খলা বজায় রাখা বনাম সত্য সন্ধানের বিপরীত পন্থা হিসেবে দেখেছেন।

হারারি এই ফ্রেমিংকে রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্র মূলত ‘তথ্যের ভিন্নধর্মী নেটওয়ার্ক’। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে গণমাধ্যম জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করেছে, তবে একই সঙ্গে ‘বৃহৎ আকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথও খুলে দিয়েছে।’ গণতন্ত্রে তথ্যপ্রবাহকে বিকেন্দ্রীকৃত এবং শাসকদের পতনযোগ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং এর বিপরীতটাই হলো একনায়কতন্ত্র। এখন বিভিন্ন রূপে ডিজিটাল মাধ্যম নিজস্ব রাজনৈতিক প্রভাব ফেলছে। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি বড় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

অন্যান্য রচনার মতোই হারারির লেখা আত্মবিশ্বাসী, বহুমুখিতা এবং হাস্যরসে ভরপুর। তিনি ইতিহাস, ধর্ম, রোগতত্ত্ব, পুরাণ, সাহিত্য, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এবং তাঁর নিজের পারিবারিক জীবনী থেকে উদাহরণ টানেন এবং প্রায়ই কয়েক প্যারার মধ্যে হাজার বছরের ইতিহাস বলে ফেলেন। কিছু পাঠকের কাছে এটি প্রাণবন্ত মনে হলেও অন্যদের কাছে হয়তো এটি বিভ্রান্তিকর।

অনেকেই ভাবতে পারেন, কেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকা একটি বইতে লেখক এত বেশি সময় ব্যয় করেছেন ধর্মীয় ইতিহাস, বিশেষত বাইবেলের ইতিহাস নিয়ে। কারণ, হারারি যুক্তি দিয়েছেন—পবিত্র গ্রন্থ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উভয়ই এক ‘অবিনশ্বর অতিমানবীয় কর্তৃত্ব’ তৈরির প্রচেষ্টা। যেমন—চতুর্থ শতাব্দীতে কোন গ্রন্থগুলোকে বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল শতাব্দী ধরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, তেমনি আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও মানবজাতির ভবিষ্যৎকে গঠন করবে বলে তিনি উদ্বিগ্ন।

হারারি মনে করেন, এআই-এর পুরো অর্থ হওয়া উচিত ‘এলিয়েন ইন্টেলিজেন্স’। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, এআই সম্ভাব্যভাবে ‘নতুন ধরনের ঈশ্বর’ হয়ে উঠতে পারে। গল্প, তালিকা বা পত্রিকার মতো নয়, এআই তথ্য নেটওয়ার্কে মানুষের মতোই সক্রিয় এজেন্ট হতে পারে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বিদ্যমান কম্পিউটার-সম্পর্কিত বিপদ যেমন অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত, অনলাইন চরমপন্থা, সাইবার আক্রমণ এবং সর্বব্যাপী নজরদারি—সবই এআই-এর মাধ্যমে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এআই বিপজ্জনক নতুন মিথ, ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং এমন নতুন আর্থিক পণ্য তৈরি করতে পারে—যা অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে।

নোয়া হারারির কল্পনা করা কিছু ভীতিকর পরিস্থিতি অবাস্তব মনে হতে পারে। তিনি কল্পনা করেছেন, একজন স্বৈরশাসক নিজস্ব ব্যবস্থায় তৈরি এআই নজরদারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন এবং আরেকজন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস করে পারমাণবিক অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ এআই-এর হাতে তুলে দিচ্ছেন। তার কিছু উদ্বেগ কিঞ্চিৎ কল্পনা প্রবণ বলে মনে হতে পারে—কারণ তিনি পর্যটকদের রেস্টুরেন্ট ও হোটেল ভাড়া নেওয়ার অ্যাপকেও ভয়ংকর ‘নজরদারি ব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি প্রায়ই সমস্ত ধরনের কম্পিউটিংকে এআই-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন এবং তার ‘তথ্য নেটওয়ার্কের’ সংজ্ঞা এতটাই নমনীয় যে এটি চ্যাটজিপিটির মতো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল থেকে শুরু করে ইউরোপে প্রাক-আধুনিক যুগের ডাইনি-শিকারি গোষ্ঠী পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করে।

তবে হারারির বর্ণনাভঙ্গি আকর্ষণীয় এবং তাঁর উপস্থাপন ভীষণ মৌলিক। কম্পিউটিং ও এই বিষয়ে লেখালেখিতে তিনি নিজেকে ‘আউটসাইডার’ মনে করেন, যা তাঁকে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। প্রযুক্তিপ্রেমীরা তাঁর লেখা পড়ে ইতিহাসের অপ্রত্যাশিত দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন, আর ইতিহাসপ্রেমীরা এই বিতর্কের একটি বোঝাপড়া লাভ করবেন। মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করতে গল্প বলার যে ধারণা, তা পাঠকদের একসঙ্গে যুক্ত করে। হারারির বই সেই তত্ত্বেরই বাস্তব উদাহরণ।

দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত