Ajker Patrika

বিমান থেকে প্যারাসুটে ত্রাণ: গাজায় আমেরিকার খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি

আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪, ২২: ৪৭
বিমান থেকে প্যারাসুটে ত্রাণ: গাজায় আমেরিকার খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি

গত মঙ্গলবার উত্তর গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ৩৬ হাজারের বেশি খাবারের প্যাকেট ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। জর্ডানের সঙ্গে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্রের এই ত্রাণ সহায়তা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে গাজায় পাঠানো এ ধরনের দ্বিতীয় যৌথ মিশন।

এই সহায়তার ঠিক আগের দিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, গাজার উত্তরে শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। সেখানে আনুমানিক ৩ লাখ শিশু খাবার ও পানির অভাবে রয়েছে।

তবে উড়োজাহাজ থেকে এভাবে খাবার ফেলার কৌশলটি যথেষ্ট আলোচনা–সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, এভাবে পাঠানো ত্রাণ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারে না। আর গাজার মাটিতে সহায়তা প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ হচ্ছে, সেটিও প্রমাণিত হলো এই কৌশলে।

ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যকার যুদ্ধে মিসর নিয়ন্ত্রিত রাফাহ ক্রসিং এবং ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত কেরাম শালোম ক্রসিং দিয়ে ত্রাণবাহী লরিগুলো গাজার দক্ষিণে প্রবেশ করেছে। কিন্তু গাজার উত্তরাংশ এখন কোনো সহায়তা পাচ্ছে না। সহিংসতা এবং লুটপাটসহ বিশৃঙ্খলার কারণে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) উত্তর গাজায় খাদ্য সরবরাহ স্থগিত করেছে।

গত বৃহস্পতিবার যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও সাত শতাধিক। সে ঘটনায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড়ের মুখে ইসরায়েল দাবি করে, বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে উত্তর গাজার ওই ত্রাণ কেন্দ্রে উপস্থিত ফিলিস্তিনিরা ‘হুমকি তৈরি করেছে’—এমন ধারণা থেকে সৈন্যরা গুলি চালিয়েছিল।

কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার ডব্লিউএফপি বলেছে, তারা সেদিন খাদ্য সরবরাহ নিয়ে উত্তর গাজায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। অভিযোগটি সম্পর্কে আইডিএফ এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।

যথেষ্ট নয়
যুক্তরাষ্ট্র এবং জর্ডানের পাশাপাশি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসর গত কয়েক সপ্তাহে গাজায় ২০ বারের বেশি উড়োজাহাজ থেকে খাবারের প্যাকেট ফেলেছে। গত শুক্রবার ফেলা প্যাকেটগুলোর মধ্যে বিন (সয়াবিন বা শিমের বীজ) এবং নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ছিল। আবু ইউসুফ নামে গাজার এক অধিবাসী বলেন, গাজা শহরের আল–শিফা হাসপাতালে ফেলা সেই প্যাকেটগুলোর কিছুই তিনি পাননি।

আবু ইউসুফ বলেন, ‘আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমরা ত্রাণবাহী প্যারাসুটগুলো দেখতে পাই। তাই আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। প্যাকেটগুলো আমাদের থেকে ৫০০ মিটার দূরে পড়ল। সেখানে অনেক মানুষ ছিল। আর সেই তুলনায় সাহায্য ছিল সামান্য। আমরা কিছুই পাইনি। বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত সাহায্য দেওয়া হয়নি।’

গাজার আরেক অধিবাসী ইসমাইল মকবেল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ সাহায্যের প্যাকেট পড়তে দেখেছে। যখন হাজার হাজার মানুষ এ ধরনের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে, তখন মাত্র ১০ থেকে ২০ জন মানুষ এসব প্যাকেট পায়! বাকিরা খালি হাতেই ফিরে আসে। দুর্ভাগ্য হলো, এভাবে খাবার ফেলার পদ্ধতিটি গাজার উত্তরে খাদ্য সহায়তা পৌঁছানোর উপযুক্ত উপায় নয়। এভাবে সাহায্য পাঠানোর পরিবর্তে স্থল কিংবা জলপথে গাজায় ত্রাণ পাঠানো উচিত। এভাবে সব নাগরিকের চাহিদা পূরণ হয় না।’

ব্যয়বহুল ও এলোমেলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সৈন্যদের সহায়তায় শুরু হয় উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলার এই পদ্ধতি। জাতিসংঘ প্রথম ১৯৭৩ সালে পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছিল। তবে এভাবে ত্রাণ কেবল তখনই দেওয়া হয় যখন অন্য আর কোনো উপায় থাকে না। ডব্লিউএফপি ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলেছিল যে, দক্ষিণ সুদান হলো সর্বশেষ স্থান যেখানে তারা উড়োজাহাজ থেকে খাদ্য সহায়তা ফেলেছিল।

নরওয়েজীয় রিফিউজি কাউন্সিলের মহাসচিব এবং জাতিসংঘের প্রাক্তন ত্রাণ বিষয়ক সংস্থার প্রধান জেন এগল্যান্ড গাজায় সাম্প্রতিক তিন দিনের সফর থেকে ফিরে বিবিসিকে বলেছেন, উড়োজাহাজ থেকে খাদ্য সহায়তা ফেলা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এলোমেলো প্রক্রিয়া। এভাবে সাহায্য ফেললে যাদের প্রয়োজন তাঁরা সেটা পান না।

ডব্লিউএফপি বলছে, উড়োজাহাজ, জ্বালানি এবং কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কিত খরচের কারণে স্থলভাগে বিতরণ করা সাহায্যের তুলনায় উড়োজাহাজ থেকে সাহায্য ফেলা সাত গুণ বেশি ব্যয়বহুল। তা ছাড়া, লরিগুলোতে যে পরিমাণে ত্রাণ আনা সম্ভব তার তুলনায় প্রতিটি ফ্লাইটে তুলনামূলক অল্প পরিমাণে ত্রাণ সরবরাহ করা যায়।

অন্যদিকে, রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি অনুপযুক্ত বা অনিরাপদ খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে মানুষের জীবনকে যাতে ঝুঁকিতে ফেলা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং খাবার বিতরণে নিয়ন্ত্রণ আনার ওপর জোর দিয়েছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছিল যে, অপুষ্টিতে ভোগা বা অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য আকস্মিক এবং অনিয়ন্ত্রিত খাবার সরবরাহ করা জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

ডব্লিউএফপি বলছে, বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চতা যেমন—প্রায় ৩০০ মিটার থেকে ৫ হাজার ৬০০ মিটার (৯৮৫–১৮,৩৭০ ফুট) উচ্চতা থেকে খাবারের প্যাকেট ফেলা হয়। তাই এই উচ্চতা থেকে মাটিতে পতনজনিত ধাক্কা প্যাকেটগুলো সহ্য করতে পারে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী প্যাকেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্থাটির মতে, যে জায়গায় খাবারের প্যাকেট ফেলা হবে তা বিস্তৃত হওয়া উচিত। আর এই বিস্তৃত ও খোলা জায়গাগুলো ফুটবল মাঠের চেয়ে ছোট হওয়া উচিত নয়। এই কারণে প্রায়ই গাজার উপকূলরেখা লক্ষ্য করে সাহায্যের প্যাকেট ফেলা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, খাবারের প্যাকেট অনেক সময়ই সাগরে গিয়ে পড়েছে। আবার কখনো বাতাসে উড়ে চলে গেছে ইসরায়েলে।

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করা
গাজার বাসিন্দা সামির আবো সাভা বিবিসিকে বলেন, তিনি মনে করেন, যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘গাজার নাগরিক হিসেবে এই জিনিস (উড়োজাহাজ থেকে ফেলা সাহায্য) কোনো কাজেই আসে না। আমরা যা চাই তা হলো—আমেরিকা ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতির জন্য যেন চাপ দেয় এবং ইসরায়েলকে অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়া বন্ধ করে।’

সাহায্য বিতরণের কাজে নিযুক্ত কয়েকজন কর্মীর কণ্ঠেও এ কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। গত সপ্তাহে অক্সফাম আমেরিকার কর্মী স্কট পল সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, গাজায় কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই উড়োজাহাজে করে সাহায্য ফেলার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা। কারণ, এগুলো গাজাবাসীর ওপর নির্বিচারে হামলায় ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য চাপ দেওয়া।

ফিলিস্তিনিদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার কাজ করা মেলানি ওয়ার্ড বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যদের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে, ইসরায়েল যেন অবিলম্বে সাহায্য পৌঁছানোর জন্য গাজার সমস্ত ক্রসিংগুলো খুলে দেয়।

বিবিসির নিবন্ধ থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত