আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

সিআইএ কর্মকর্তা আসিফ রহমানের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি গত অক্টোবরে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেছেন। এ ঘটনায় কয়েক দশক ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে এসেছে। এটি মূলত গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরির খেলা!
ইরানভিত্তিক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে রহমানের তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। চ্যানেলটি ইরানের সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে এ ঘটনা মার্কিন প্রশাসনকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে। এর আগে পেন্টাগনের নথি ফাঁসের দায়ে দপ্তরের কর্মকর্তা জ্যাক টিক্সেরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
ইরানি চ্যানেলে ফাঁস হওয়া তথ্য ইরান, ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অস্বচ্ছ সম্পর্ককে উন্মোচন করেছে। এই সম্পর্ক বর্তমান সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত হচ্ছে।
অক্টোবরের শেষ দিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিনবেত পূর্ব জেরুজালেমে সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাঁরা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর একদিন আগে, হাইফায় আরও সাত ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থায় ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। এদের প্রায় সবাই ইহুদি!
ইসরায়েলি পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে ইরান সমর্থিত আরও কয়েকটি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও, গত সেপ্টেম্বরে ৭৩ বছর বয়সী ইসরায়েলি ব্যবসায়ী মোতি মামানকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শিনবেত এবং ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি ইরানের কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার চেয়েছিলেন।
অন্য দিকে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলাকালেই তেহরান বেশ কয়েকজন ইরানিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ইরান তিন পুরুষ ও এক নারীকে ফাঁসি দেয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মোসাদের হয়ে কাজ করেছেন এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অপহরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিলেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থায় (পেজার–ওয়াকিটকি) ইসরায়েলের হামলার পর ইরান ১২ জন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ইরানে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
ইলেকট্রনিক নজরদারি, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং ও অন্যান্য নজরদারি আজকাল গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ টুল বা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে তথ্য সংগ্রহ এবং সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণে গুপ্তচর হিসেবে মানুষ এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মার্কিন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো সিনা টুসি বলেন, ‘গুপ্তচর হিসেবে মানুষকে ব্যবহার ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উভয় দেশই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে। দেশ দুটির গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরি কার্যক্রম তাদের বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে ভূমিকা রাখে।’
হাইফায় আটক হওয়া ইসরায়েলিরা ইরানের হয়ে গত দুই বছরে ৬০০–৭০০টি গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ করেছে তেল আবিব। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল— ইসরায়েলের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এটি সম্ভবত ইসরায়েলের হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের মতো একটি সম্ভাব্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনা। যেমনটা ছিল, গত জুলাইয়ে ইরানে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘একাধিক হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ড এবং অন্তর্ঘাতমূলক মিশনের মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে। যা মূলত দেশটিতে মোসাদের গভীর অনুপ্রবেশকেই নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে এবং এই বিষয়টি ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।’
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার এমনটাই জানিয়েছেন। তবে বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ইসরায়েলি সমাজে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেই বিভাজনগুলোর ফাটল দিয়ে এখন প্রবেশ করছে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা। হাইফায় আটক হওয়া ১৪ জন এজেন্টের প্রথম দলটি ১০ বছর আগে আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় দলটি আরব–ইসরায়েলি হিসেবে পরিচিত। এই দুটি দলই ইসরায়েলি সমাজের মূলধারার বাইরের বলে মনে করা হলেও—এই পরিবর্তনকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন আত্তার।
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা সময়ে পুরো ইসরায়েলকে একটি একক পরিচয়ের আওতায় ধরা হতো...তাদের এমনভাবে পড়ানো হতো যে, তারা তাদের আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদি ইরান এই দুই দলকে নিজের পক্ষে কাজ করতে রাজি করিয়ে থাকতে পারে, তবে তারা আরও অনেককেই তাদের দলে ভেড়াতে পেরেছে বলেই মনে হয়।’
ইসরায়েলি সমাজে ইরানের প্রবেশের প্রচেষ্টা সম্প্রতি সামনে এলেও ইসরায়েল যে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে, সে বিষয়ে আগেই অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছে ইরানের বিশাল আয়তন, যেখানে জনসংখ্যা ইসরায়েলের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৯ গুণ। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ইসরায়েলকে সুবিধা দিয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আহরন ব্রেগম্যান বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, দেশটির শাসকগোষ্ঠীকে ভেতর থেকে উৎখাত করা। এটাই তাদের (ইসরায়েলের) কাজের পদ্ধতির মূলে। ইরানের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনার পরিকল্পনা করা, চর নিয়োগ দেওয়ার ও গোয়েন্দাগিরি শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েল হাতে অনেক সময় পেয়েছে।’
অন্যদিকে, ইরান সম্ভবত তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনেকাংশেই মিত্রদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, যারা তাদের তথ্য সরবরাহ করে। ইরানি গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত ইসরায়েলে কাজ করা ফিলিস্তিনিদের নিয়োগ দেওয়া। যারা সেখানে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হয়। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ইসরায়েলি সমাজে প্রবেশের চেষ্টাও ইরান করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানি গোয়েন্দারা বিচারবিভাগীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ এবং গাজায় আটক বন্দীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তারা ইসরায়েলিদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্থাপনার ছবি তুলতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল।
তবে ইরান ইসরায়েলে ততটা সফল নয়, যতটা সফল ইরানে ইসরায়েল। এই বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘তবে, ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি উন্নত এবং বিস্তৃত বলে মনে হয়। ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, ইসমাইল হানিয়ার মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অন্তর্ঘাত চালানো এবং ইরানের গভীরে ইসরায়েলের হামলা চালানোর সক্ষমতা ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল ইরানের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানগুলোতে কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান বিরোধী গুপ্তচর সংস্থাগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে এবং তা প্রকাশিত হতে দেয় এবং আবার পরে সেই তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তারাই। বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আস্থার সংকটে ফেলে দিতে এটা একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।
নিউইয়র্কভিত্তিক সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো ভিনা আলী খান বলেন, ‘ইরানের ইতিহাসে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করার নজির রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করা সেসব দেশের ভাষার কিন্তু ইরান থেকে পরিচালিত গণমাধ্যম রয়েছে। খবর ছড়ানোর পর ইরান সেগুলোকে নিজেরাই মিথ্যা প্রমাণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।’
উদাহরণ হিসেবে ভিনা আলী বলেন, ‘ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ইরানের বিপ্লবী গার্ডবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ক্বানি মারা গেছেন বা আটক হয়েছেন। কিন্তু পরে ইরান তাঁকে জীবিত প্রমাণ করে। এভাবে, ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পুনরায় এমন সব বার্তা প্রচার করে—যার মাধ্যমে দেশটি প্রমাণ করে দেয় যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরোপুরি ভুল ছিল। এ কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস করা উচিত নয়।’
পাবলিক ন্যারেটিভ বা জনগণের কাছে প্রচলিত বয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করা গুপ্তচরবৃত্তির জগতে প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার অন্যতম কৌশল। এ বিষয়ে ব্রেগম্যান বলেন, এটি প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্যও জরুরি। শিনবেত ও পুলিশ সচেতনভাবে ইরানি গুপ্তচর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করছে। এটি মূলত অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য। তারা (ইসরায়েল) তাদের প্রচেষ্টাগুলো প্রকাশ করছে। তারা মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা তৎপর আছে এবং যারা ইরানের হয়ে কাজ করবে তাদের পাকড়াও করা হবে।’
একইভাবে, সিনা টুসি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ব্যর্থতা ঢাকা পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়টি আগেভাগে জানতে না পারা।
টুসি বলেন, ‘এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসরায়েলি এস্টাবলিশমেন্ট এবং এর সমর্থক গণমাধ্যম ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার অদৃশ্য শক্তির যে ছবি তুলে ধরে তা বাস্তবতার সঙ্গে সব সময় মেলে না। ইসরায়েলের কৌশলগত সাফল্য থাকার পরও গোপনীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য হওয়ার ধারণা দেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে।’
টুসি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে এটি এখন একাধিক শত্রু ও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।’
অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

সিআইএ কর্মকর্তা আসিফ রহমানের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি গত অক্টোবরে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেছেন। এ ঘটনায় কয়েক দশক ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে এসেছে। এটি মূলত গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরির খেলা!
ইরানভিত্তিক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে রহমানের তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। চ্যানেলটি ইরানের সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে এ ঘটনা মার্কিন প্রশাসনকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে। এর আগে পেন্টাগনের নথি ফাঁসের দায়ে দপ্তরের কর্মকর্তা জ্যাক টিক্সেরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
ইরানি চ্যানেলে ফাঁস হওয়া তথ্য ইরান, ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অস্বচ্ছ সম্পর্ককে উন্মোচন করেছে। এই সম্পর্ক বর্তমান সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত হচ্ছে।
অক্টোবরের শেষ দিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিনবেত পূর্ব জেরুজালেমে সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাঁরা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর একদিন আগে, হাইফায় আরও সাত ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থায় ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। এদের প্রায় সবাই ইহুদি!
ইসরায়েলি পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে ইরান সমর্থিত আরও কয়েকটি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও, গত সেপ্টেম্বরে ৭৩ বছর বয়সী ইসরায়েলি ব্যবসায়ী মোতি মামানকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শিনবেত এবং ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি ইরানের কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার চেয়েছিলেন।
অন্য দিকে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলাকালেই তেহরান বেশ কয়েকজন ইরানিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ইরান তিন পুরুষ ও এক নারীকে ফাঁসি দেয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মোসাদের হয়ে কাজ করেছেন এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অপহরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিলেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থায় (পেজার–ওয়াকিটকি) ইসরায়েলের হামলার পর ইরান ১২ জন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ইরানে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
ইলেকট্রনিক নজরদারি, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং ও অন্যান্য নজরদারি আজকাল গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ টুল বা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে তথ্য সংগ্রহ এবং সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণে গুপ্তচর হিসেবে মানুষ এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মার্কিন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো সিনা টুসি বলেন, ‘গুপ্তচর হিসেবে মানুষকে ব্যবহার ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উভয় দেশই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে। দেশ দুটির গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরি কার্যক্রম তাদের বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে ভূমিকা রাখে।’
হাইফায় আটক হওয়া ইসরায়েলিরা ইরানের হয়ে গত দুই বছরে ৬০০–৭০০টি গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ করেছে তেল আবিব। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল— ইসরায়েলের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এটি সম্ভবত ইসরায়েলের হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের মতো একটি সম্ভাব্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনা। যেমনটা ছিল, গত জুলাইয়ে ইরানে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘একাধিক হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ড এবং অন্তর্ঘাতমূলক মিশনের মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে। যা মূলত দেশটিতে মোসাদের গভীর অনুপ্রবেশকেই নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে এবং এই বিষয়টি ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।’
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার এমনটাই জানিয়েছেন। তবে বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ইসরায়েলি সমাজে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেই বিভাজনগুলোর ফাটল দিয়ে এখন প্রবেশ করছে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা। হাইফায় আটক হওয়া ১৪ জন এজেন্টের প্রথম দলটি ১০ বছর আগে আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় দলটি আরব–ইসরায়েলি হিসেবে পরিচিত। এই দুটি দলই ইসরায়েলি সমাজের মূলধারার বাইরের বলে মনে করা হলেও—এই পরিবর্তনকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন আত্তার।
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা সময়ে পুরো ইসরায়েলকে একটি একক পরিচয়ের আওতায় ধরা হতো...তাদের এমনভাবে পড়ানো হতো যে, তারা তাদের আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদি ইরান এই দুই দলকে নিজের পক্ষে কাজ করতে রাজি করিয়ে থাকতে পারে, তবে তারা আরও অনেককেই তাদের দলে ভেড়াতে পেরেছে বলেই মনে হয়।’
ইসরায়েলি সমাজে ইরানের প্রবেশের প্রচেষ্টা সম্প্রতি সামনে এলেও ইসরায়েল যে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে, সে বিষয়ে আগেই অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছে ইরানের বিশাল আয়তন, যেখানে জনসংখ্যা ইসরায়েলের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৯ গুণ। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ইসরায়েলকে সুবিধা দিয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আহরন ব্রেগম্যান বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, দেশটির শাসকগোষ্ঠীকে ভেতর থেকে উৎখাত করা। এটাই তাদের (ইসরায়েলের) কাজের পদ্ধতির মূলে। ইরানের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনার পরিকল্পনা করা, চর নিয়োগ দেওয়ার ও গোয়েন্দাগিরি শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েল হাতে অনেক সময় পেয়েছে।’
অন্যদিকে, ইরান সম্ভবত তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনেকাংশেই মিত্রদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, যারা তাদের তথ্য সরবরাহ করে। ইরানি গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত ইসরায়েলে কাজ করা ফিলিস্তিনিদের নিয়োগ দেওয়া। যারা সেখানে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হয়। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ইসরায়েলি সমাজে প্রবেশের চেষ্টাও ইরান করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানি গোয়েন্দারা বিচারবিভাগীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ এবং গাজায় আটক বন্দীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তারা ইসরায়েলিদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্থাপনার ছবি তুলতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল।
তবে ইরান ইসরায়েলে ততটা সফল নয়, যতটা সফল ইরানে ইসরায়েল। এই বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘তবে, ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি উন্নত এবং বিস্তৃত বলে মনে হয়। ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, ইসমাইল হানিয়ার মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অন্তর্ঘাত চালানো এবং ইরানের গভীরে ইসরায়েলের হামলা চালানোর সক্ষমতা ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল ইরানের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানগুলোতে কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান বিরোধী গুপ্তচর সংস্থাগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে এবং তা প্রকাশিত হতে দেয় এবং আবার পরে সেই তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তারাই। বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আস্থার সংকটে ফেলে দিতে এটা একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।
নিউইয়র্কভিত্তিক সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো ভিনা আলী খান বলেন, ‘ইরানের ইতিহাসে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করার নজির রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করা সেসব দেশের ভাষার কিন্তু ইরান থেকে পরিচালিত গণমাধ্যম রয়েছে। খবর ছড়ানোর পর ইরান সেগুলোকে নিজেরাই মিথ্যা প্রমাণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।’
উদাহরণ হিসেবে ভিনা আলী বলেন, ‘ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ইরানের বিপ্লবী গার্ডবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ক্বানি মারা গেছেন বা আটক হয়েছেন। কিন্তু পরে ইরান তাঁকে জীবিত প্রমাণ করে। এভাবে, ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পুনরায় এমন সব বার্তা প্রচার করে—যার মাধ্যমে দেশটি প্রমাণ করে দেয় যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরোপুরি ভুল ছিল। এ কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস করা উচিত নয়।’
পাবলিক ন্যারেটিভ বা জনগণের কাছে প্রচলিত বয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করা গুপ্তচরবৃত্তির জগতে প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার অন্যতম কৌশল। এ বিষয়ে ব্রেগম্যান বলেন, এটি প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্যও জরুরি। শিনবেত ও পুলিশ সচেতনভাবে ইরানি গুপ্তচর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করছে। এটি মূলত অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য। তারা (ইসরায়েল) তাদের প্রচেষ্টাগুলো প্রকাশ করছে। তারা মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা তৎপর আছে এবং যারা ইরানের হয়ে কাজ করবে তাদের পাকড়াও করা হবে।’
একইভাবে, সিনা টুসি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ব্যর্থতা ঢাকা পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়টি আগেভাগে জানতে না পারা।
টুসি বলেন, ‘এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসরায়েলি এস্টাবলিশমেন্ট এবং এর সমর্থক গণমাধ্যম ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার অদৃশ্য শক্তির যে ছবি তুলে ধরে তা বাস্তবতার সঙ্গে সব সময় মেলে না। ইসরায়েলের কৌশলগত সাফল্য থাকার পরও গোপনীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য হওয়ার ধারণা দেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে।’
টুসি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে এটি এখন একাধিক শত্রু ও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।’
অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

সিআইএ কর্মকর্তা আসিফ রহমানের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি গত অক্টোবরে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেছেন। এ ঘটনায় কয়েক দশক ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে এসেছে। এটি মূলত গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরির খেলা!
ইরানভিত্তিক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে রহমানের তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। চ্যানেলটি ইরানের সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে এ ঘটনা মার্কিন প্রশাসনকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে। এর আগে পেন্টাগনের নথি ফাঁসের দায়ে দপ্তরের কর্মকর্তা জ্যাক টিক্সেরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
ইরানি চ্যানেলে ফাঁস হওয়া তথ্য ইরান, ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অস্বচ্ছ সম্পর্ককে উন্মোচন করেছে। এই সম্পর্ক বর্তমান সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত হচ্ছে।
অক্টোবরের শেষ দিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিনবেত পূর্ব জেরুজালেমে সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাঁরা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর একদিন আগে, হাইফায় আরও সাত ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থায় ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। এদের প্রায় সবাই ইহুদি!
ইসরায়েলি পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে ইরান সমর্থিত আরও কয়েকটি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও, গত সেপ্টেম্বরে ৭৩ বছর বয়সী ইসরায়েলি ব্যবসায়ী মোতি মামানকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শিনবেত এবং ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি ইরানের কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার চেয়েছিলেন।
অন্য দিকে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলাকালেই তেহরান বেশ কয়েকজন ইরানিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ইরান তিন পুরুষ ও এক নারীকে ফাঁসি দেয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মোসাদের হয়ে কাজ করেছেন এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অপহরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিলেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থায় (পেজার–ওয়াকিটকি) ইসরায়েলের হামলার পর ইরান ১২ জন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ইরানে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
ইলেকট্রনিক নজরদারি, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং ও অন্যান্য নজরদারি আজকাল গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ টুল বা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে তথ্য সংগ্রহ এবং সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণে গুপ্তচর হিসেবে মানুষ এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মার্কিন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো সিনা টুসি বলেন, ‘গুপ্তচর হিসেবে মানুষকে ব্যবহার ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উভয় দেশই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে। দেশ দুটির গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরি কার্যক্রম তাদের বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে ভূমিকা রাখে।’
হাইফায় আটক হওয়া ইসরায়েলিরা ইরানের হয়ে গত দুই বছরে ৬০০–৭০০টি গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ করেছে তেল আবিব। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল— ইসরায়েলের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এটি সম্ভবত ইসরায়েলের হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের মতো একটি সম্ভাব্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনা। যেমনটা ছিল, গত জুলাইয়ে ইরানে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘একাধিক হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ড এবং অন্তর্ঘাতমূলক মিশনের মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে। যা মূলত দেশটিতে মোসাদের গভীর অনুপ্রবেশকেই নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে এবং এই বিষয়টি ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।’
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার এমনটাই জানিয়েছেন। তবে বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ইসরায়েলি সমাজে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেই বিভাজনগুলোর ফাটল দিয়ে এখন প্রবেশ করছে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা। হাইফায় আটক হওয়া ১৪ জন এজেন্টের প্রথম দলটি ১০ বছর আগে আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় দলটি আরব–ইসরায়েলি হিসেবে পরিচিত। এই দুটি দলই ইসরায়েলি সমাজের মূলধারার বাইরের বলে মনে করা হলেও—এই পরিবর্তনকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন আত্তার।
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা সময়ে পুরো ইসরায়েলকে একটি একক পরিচয়ের আওতায় ধরা হতো...তাদের এমনভাবে পড়ানো হতো যে, তারা তাদের আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদি ইরান এই দুই দলকে নিজের পক্ষে কাজ করতে রাজি করিয়ে থাকতে পারে, তবে তারা আরও অনেককেই তাদের দলে ভেড়াতে পেরেছে বলেই মনে হয়।’
ইসরায়েলি সমাজে ইরানের প্রবেশের প্রচেষ্টা সম্প্রতি সামনে এলেও ইসরায়েল যে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে, সে বিষয়ে আগেই অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছে ইরানের বিশাল আয়তন, যেখানে জনসংখ্যা ইসরায়েলের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৯ গুণ। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ইসরায়েলকে সুবিধা দিয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আহরন ব্রেগম্যান বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, দেশটির শাসকগোষ্ঠীকে ভেতর থেকে উৎখাত করা। এটাই তাদের (ইসরায়েলের) কাজের পদ্ধতির মূলে। ইরানের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনার পরিকল্পনা করা, চর নিয়োগ দেওয়ার ও গোয়েন্দাগিরি শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েল হাতে অনেক সময় পেয়েছে।’
অন্যদিকে, ইরান সম্ভবত তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনেকাংশেই মিত্রদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, যারা তাদের তথ্য সরবরাহ করে। ইরানি গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত ইসরায়েলে কাজ করা ফিলিস্তিনিদের নিয়োগ দেওয়া। যারা সেখানে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হয়। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ইসরায়েলি সমাজে প্রবেশের চেষ্টাও ইরান করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানি গোয়েন্দারা বিচারবিভাগীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ এবং গাজায় আটক বন্দীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তারা ইসরায়েলিদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্থাপনার ছবি তুলতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল।
তবে ইরান ইসরায়েলে ততটা সফল নয়, যতটা সফল ইরানে ইসরায়েল। এই বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘তবে, ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি উন্নত এবং বিস্তৃত বলে মনে হয়। ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, ইসমাইল হানিয়ার মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অন্তর্ঘাত চালানো এবং ইরানের গভীরে ইসরায়েলের হামলা চালানোর সক্ষমতা ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল ইরানের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানগুলোতে কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান বিরোধী গুপ্তচর সংস্থাগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে এবং তা প্রকাশিত হতে দেয় এবং আবার পরে সেই তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তারাই। বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আস্থার সংকটে ফেলে দিতে এটা একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।
নিউইয়র্কভিত্তিক সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো ভিনা আলী খান বলেন, ‘ইরানের ইতিহাসে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করার নজির রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করা সেসব দেশের ভাষার কিন্তু ইরান থেকে পরিচালিত গণমাধ্যম রয়েছে। খবর ছড়ানোর পর ইরান সেগুলোকে নিজেরাই মিথ্যা প্রমাণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।’
উদাহরণ হিসেবে ভিনা আলী বলেন, ‘ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ইরানের বিপ্লবী গার্ডবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ক্বানি মারা গেছেন বা আটক হয়েছেন। কিন্তু পরে ইরান তাঁকে জীবিত প্রমাণ করে। এভাবে, ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পুনরায় এমন সব বার্তা প্রচার করে—যার মাধ্যমে দেশটি প্রমাণ করে দেয় যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরোপুরি ভুল ছিল। এ কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস করা উচিত নয়।’
পাবলিক ন্যারেটিভ বা জনগণের কাছে প্রচলিত বয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করা গুপ্তচরবৃত্তির জগতে প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার অন্যতম কৌশল। এ বিষয়ে ব্রেগম্যান বলেন, এটি প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্যও জরুরি। শিনবেত ও পুলিশ সচেতনভাবে ইরানি গুপ্তচর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করছে। এটি মূলত অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য। তারা (ইসরায়েল) তাদের প্রচেষ্টাগুলো প্রকাশ করছে। তারা মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা তৎপর আছে এবং যারা ইরানের হয়ে কাজ করবে তাদের পাকড়াও করা হবে।’
একইভাবে, সিনা টুসি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ব্যর্থতা ঢাকা পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়টি আগেভাগে জানতে না পারা।
টুসি বলেন, ‘এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসরায়েলি এস্টাবলিশমেন্ট এবং এর সমর্থক গণমাধ্যম ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার অদৃশ্য শক্তির যে ছবি তুলে ধরে তা বাস্তবতার সঙ্গে সব সময় মেলে না। ইসরায়েলের কৌশলগত সাফল্য থাকার পরও গোপনীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য হওয়ার ধারণা দেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে।’
টুসি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে এটি এখন একাধিক শত্রু ও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।’
অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

সিআইএ কর্মকর্তা আসিফ রহমানের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি গত অক্টোবরে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেছেন। এ ঘটনায় কয়েক দশক ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে এসেছে। এটি মূলত গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরির খেলা!
ইরানভিত্তিক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে রহমানের তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হয়েছে। চ্যানেলটি ইরানের সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে এ ঘটনা মার্কিন প্রশাসনকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে। এর আগে পেন্টাগনের নথি ফাঁসের দায়ে দপ্তরের কর্মকর্তা জ্যাক টিক্সেরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
ইরানি চ্যানেলে ফাঁস হওয়া তথ্য ইরান, ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অস্বচ্ছ সম্পর্ককে উন্মোচন করেছে। এই সম্পর্ক বর্তমান সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত হচ্ছে।
অক্টোবরের শেষ দিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিনবেত পূর্ব জেরুজালেমে সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তারের কথা জানায়। তাঁরা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর একদিন আগে, হাইফায় আরও সাত ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থায় ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। এদের প্রায় সবাই ইহুদি!
ইসরায়েলি পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটিতে ইরান সমর্থিত আরও কয়েকটি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও, গত সেপ্টেম্বরে ৭৩ বছর বয়সী ইসরায়েলি ব্যবসায়ী মোতি মামানকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শিনবেত এবং ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর বিনিময়ে তিনি ইরানের কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার চেয়েছিলেন।
অন্য দিকে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলাকালেই তেহরান বেশ কয়েকজন ইরানিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সহযোগিতা করেছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ইরান তিন পুরুষ ও এক নারীকে ফাঁসি দেয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মোসাদের হয়ে কাজ করেছেন এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অপহরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিলেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থায় (পেজার–ওয়াকিটকি) ইসরায়েলের হামলার পর ইরান ১২ জন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ইরানে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
ইলেকট্রনিক নজরদারি, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং ও অন্যান্য নজরদারি আজকাল গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ টুল বা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে তথ্য সংগ্রহ এবং সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণে গুপ্তচর হিসেবে মানুষ এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
মার্কিন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো সিনা টুসি বলেন, ‘গুপ্তচর হিসেবে মানুষকে ব্যবহার ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উভয় দেশই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে। দেশ দুটির গোয়েন্দাগিরি ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরি কার্যক্রম তাদের বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে ভূমিকা রাখে।’
হাইফায় আটক হওয়া ইসরায়েলিরা ইরানের হয়ে গত দুই বছরে ৬০০–৭০০টি গোয়েন্দা মিশন পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ করেছে তেল আবিব। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল— ইসরায়েলের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যা করা। এটি সম্ভবত ইসরায়েলের হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের মতো একটি সম্ভাব্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনা। যেমনটা ছিল, গত জুলাইয়ে ইরানে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ড।
এ বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘একাধিক হাইপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ড এবং অন্তর্ঘাতমূলক মিশনের মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে। যা মূলত দেশটিতে মোসাদের গভীর অনুপ্রবেশকেই নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ইরান ইসরায়েলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে এবং এই বিষয়টি ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।’
একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার এমনটাই জানিয়েছেন। তবে বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ইসরায়েলি সমাজে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেই বিভাজনগুলোর ফাটল দিয়ে এখন প্রবেশ করছে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা। হাইফায় আটক হওয়া ১৪ জন এজেন্টের প্রথম দলটি ১০ বছর আগে আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় দলটি আরব–ইসরায়েলি হিসেবে পরিচিত। এই দুটি দলই ইসরায়েলি সমাজের মূলধারার বাইরের বলে মনে করা হলেও—এই পরিবর্তনকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন আত্তার।
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটা সময়ে পুরো ইসরায়েলকে একটি একক পরিচয়ের আওতায় ধরা হতো...তাদের এমনভাবে পড়ানো হতো যে, তারা তাদের আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদি ইরান এই দুই দলকে নিজের পক্ষে কাজ করতে রাজি করিয়ে থাকতে পারে, তবে তারা আরও অনেককেই তাদের দলে ভেড়াতে পেরেছে বলেই মনে হয়।’
ইসরায়েলি সমাজে ইরানের প্রবেশের প্রচেষ্টা সম্প্রতি সামনে এলেও ইসরায়েল যে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে আসছে, সে বিষয়ে আগেই অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করছে ইরানের বিশাল আয়তন, যেখানে জনসংখ্যা ইসরায়েলের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৯ গুণ। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ইসরায়েলকে সুবিধা দিয়েছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক আহরন ব্রেগম্যান বলেন, ‘১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, দেশটির শাসকগোষ্ঠীকে ভেতর থেকে উৎখাত করা। এটাই তাদের (ইসরায়েলের) কাজের পদ্ধতির মূলে। ইরানের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনার পরিকল্পনা করা, চর নিয়োগ দেওয়ার ও গোয়েন্দাগিরি শক্তিশালী করার জন্য ইসরায়েল হাতে অনেক সময় পেয়েছে।’
অন্যদিকে, ইরান সম্ভবত তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনেকাংশেই মিত্রদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, যারা তাদের তথ্য সরবরাহ করে। ইরানি গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত ইসরায়েলে কাজ করা ফিলিস্তিনিদের নিয়োগ দেওয়া। যারা সেখানে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হয়। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে ইসরায়েলি সমাজে প্রবেশের চেষ্টাও ইরান করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানি গোয়েন্দারা বিচারবিভাগীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ এবং গাজায় আটক বন্দীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তারা ইসরায়েলিদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্থাপনার ছবি তুলতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল।
তবে ইরান ইসরায়েলে ততটা সফল নয়, যতটা সফল ইরানে ইসরায়েল। এই বিষয়ে সিনা টুসি বলেন, ‘তবে, ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি উন্নত এবং বিস্তৃত বলে মনে হয়। ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা, ইসমাইল হানিয়ার মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অন্তর্ঘাত চালানো এবং ইরানের গভীরে ইসরায়েলের হামলা চালানোর সক্ষমতা ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল ইরানের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানগুলোতে কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান বিরোধী গুপ্তচর সংস্থাগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে এবং তা প্রকাশিত হতে দেয় এবং আবার পরে সেই তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তারাই। বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আস্থার সংকটে ফেলে দিতে এটা একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে।
নিউইয়র্কভিত্তিক সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো ভিনা আলী খান বলেন, ‘ইরানের ইতিহাসে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিথ্যা খবর প্রচার করার নজির রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করা সেসব দেশের ভাষার কিন্তু ইরান থেকে পরিচালিত গণমাধ্যম রয়েছে। খবর ছড়ানোর পর ইরান সেগুলোকে নিজেরাই মিথ্যা প্রমাণ করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে।’
উদাহরণ হিসেবে ভিনা আলী বলেন, ‘ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, ইরানের বিপ্লবী গার্ডবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ক্বানি মারা গেছেন বা আটক হয়েছেন। কিন্তু পরে ইরান তাঁকে জীবিত প্রমাণ করে। এভাবে, ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পুনরায় এমন সব বার্তা প্রচার করে—যার মাধ্যমে দেশটি প্রমাণ করে দেয় যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরোপুরি ভুল ছিল। এ কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস করা উচিত নয়।’
পাবলিক ন্যারেটিভ বা জনগণের কাছে প্রচলিত বয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করা গুপ্তচরবৃত্তির জগতে প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার অন্যতম কৌশল। এ বিষয়ে ব্রেগম্যান বলেন, এটি প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্যও জরুরি। শিনবেত ও পুলিশ সচেতনভাবে ইরানি গুপ্তচর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করছে। এটি মূলত অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য। তারা (ইসরায়েল) তাদের প্রচেষ্টাগুলো প্রকাশ করছে। তারা মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা তৎপর আছে এবং যারা ইরানের হয়ে কাজ করবে তাদের পাকড়াও করা হবে।’
একইভাবে, সিনা টুসি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়ার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ব্যর্থতা ঢাকা পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়টি আগেভাগে জানতে না পারা।
টুসি বলেন, ‘এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসরায়েলি এস্টাবলিশমেন্ট এবং এর সমর্থক গণমাধ্যম ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার অদৃশ্য শক্তির যে ছবি তুলে ধরে তা বাস্তবতার সঙ্গে সব সময় মেলে না। ইসরায়েলের কৌশলগত সাফল্য থাকার পরও গোপনীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ইসরায়েলের অপ্রতিরোধ্য হওয়ার ধারণা দেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে।’
টুসি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে এটি এখন একাধিক শত্রু ও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।’
অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
১৭ ঘণ্টা আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২১ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
১ দিন আগে
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
২২ নভেম্বর ২০২৪
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২১ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
১ দিন আগে
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
২২ নভেম্বর ২০২৪
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
১৭ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
১ দিন আগে
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
১ দিন আগেশশী থারুরের নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
২২ নভেম্বর ২০২৪
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
১৭ ঘণ্টা আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২১ ঘণ্টা আগে
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ..
১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একধরনের অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জি বিক্ষোভে গত সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এটি অনেকটা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর মতো। সে সময় শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া বা সংগ্রাম’ আন্দোলনও একই ধারায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
এ ধরনের একের পর এক গণ-আন্দোলন ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জনসংখ্যাগত চাপের মতো মৌলিক সংকটে ভুগছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। নেপালের কথাই ধরা যাক—রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর ২০০৮ থেকে গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছিল ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশির বয়স ১৫ বছরের নিচে, দেশের জনগণের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর, আর প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন বেকার।
এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের চারপাশে যেন এক অস্থিরতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় চলছে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমার কার্যত ব্যর্থ বা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর চীন ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশীই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, তাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় পরস্পরের সঙ্গে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে।
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছে বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু ভারতের মধ্যে এই আলোচনায় নিকট প্রতিবেশীরা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটার একটা কারণ, নয়াদিল্লির নিজস্ব প্রবণতা—বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পুরো অঞ্চলকে আলাদা নজরে দেখা। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সব দক্ষিণ এশীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রথম দফায় তিনি ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকার ভারতকে আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে চলতি বছরের ‘রাইসিনা ডায়ালগে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান কূটনৈতিক সম্মেলনে ইউক্রেন ও গাজা সংঘাত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মহাকাশে আধিপত্য—সব বিষয়ই সেখানে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, মাত্র ছয় মাস আগে বাংলাদেশের মনসুন রেভল্যুশনে ক্ষমতাচ্যুত হয় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকারগুলোর একটি।
রাইসিনা ডায়ালগের ঠিক এক মাস পর চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় পর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ডায়ালগে ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করলেও আফগানিস্তান বা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটিই ইঙ্গিত দেয় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি একধরনের ‘উদাসীনতা’ ধীরে ধীরে নীতি-কৌশলে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার ভারতীয় সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় এক সদস্য বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীকে ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও সত্য এই যে কোয়াড বা ব্রিকসের মতো ‘সমভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর’ জোট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে না।
ভারতের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংকটের দায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে দেন। পাকিস্তান সার্কের সদস্যদেশ—এটি হয়তো সার্কের অচলাবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এতে ব্যাখ্যা মেলে না, কেন অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনও প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন ‘বিমসটেক’-এর কথা। পাকিস্তান এর সদস্য নয়, তবু ১৯৯৭ সালে গঠনের পর থেকে সংগঠনটি মাত্র ছয়বার শীর্ষ সম্মেলন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতার সঙ্গে আঞ্চলিক ঘটনাবলিকে নয়াদিল্লির গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা—গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় এমন বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাইরের নিরাপত্তা হুমকি আসে তাদের সীমান্ত বা আশপাশের অঞ্চল থেকেই; যেমন ইউরোপের জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এক অস্তিত্বের হুমকি বা স্নায়ুযুদ্ধকালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি এসেছিল নিজের ‘পেছনের উঠান’ থেকেই। আবার অনুপ্রবেশের মতো বিষয়ও বহু দেশের রাজনীতিতে তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যদি নিজেকে কেবল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে—তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে না।
এই ‘উদাসীনতা’ ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট। সম্প্রতি লাদাখ (যা চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চল) ও মণিপুরে অস্থিরতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। মণিপুর রাজ্যটি মিয়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার ধীর প্রতিক্রিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মণিপুরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার দুই বছরের বেশি সময় পর নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফরে যান।
নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। পূর্বমুখী নীতি বা ‘লুক ইস্ট’ নীতি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নামে নতুনভাবে প্রচারে আনে, যা আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে।
ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও (যা নয়াদিল্লি ‘ওয়েস্ট এশিয়া’ বলে উল্লেখ করে) জটিল। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতা এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারত এই অঞ্চলের (পাকিস্তানের পর পশ্চিম দিকে) সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে নানা বাধা কাটিয়ে উঠেছে। আকাশপথ, নৌপথ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে ইরানে নয়াদিল্লি পরিচালিত চাবাহার বন্দর এবং ২০২৩ সালে জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি কাবুলের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সম্পৃক্ততা এখনো নড়বড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘোষিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বিবেচনায় নিলে সেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, চীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও আন্তর্দেশীয় উৎপাদন নেটওয়ার্কে নিজেদের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যদি দেশটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
পশ্চিমা দেশগুলোও অনেক সময় ভারতকে একা একটি দেশ হিসেবে দেখে—দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নয়। এর পেছনে আংশিক কারণ প্রশাসনিক জটিলতা; যেমন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান ডিরেক্টরেট’ আলাদা বিভাগ, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ে কাজ করে আরেকটি বিভাগ— ‘আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান ডিরেক্টরেট।’
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে (ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স) ভারত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’-এর অধীনে, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীনে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গরকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়াদিল্লিতে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই নিয়োগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে এবং ভারতকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসেবেই দেখবে।
সর্বোপরি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতনীতি আরও নিবিড়ভাবে দক্ষিণ এশিয়া নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতকে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই অঞ্চলের অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে এগোতে পারবে।
এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার চাপ—দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স এখনো ১৮ বছরের নিচে। রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকি—এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়-সংবেদনশীল এলাকার একটি। আছে অভিবাসন সংকটও—অনেক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীর বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়।
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোরও ভাবতে হবে—কীভাবে তারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাবে। কারণ, এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার ও গোষ্ঠীকে সরিয়ে জনগণের শক্তিতে নতুন প্রজন্মের নেতারা উঠে আসছেন।
এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে পরাজিত হয়েছেন পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রার্থীরা। বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী জোটের নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে, যার দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা একসময় দেশজুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল শ্রীলঙ্কার অস্থির রাজনীতিকে যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেশের মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনগণের গভীর হতাশাও স্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশ ও নেপালে একই ধরনের কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দেশই বর্তমানে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। ছাত্র ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে—বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নেপালের হামি নেপাল-এর মতো সংগঠনগুলো এখন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই প্রবণতা দুই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির প্রভাবকে দুর্বল করার সম্ভাবনা তৈরি করছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যুগে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলে (নেপালি কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল পুরুষ নেতাদের আধিপত্য।
এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য উভয় রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাও রক্ষা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে—দেশটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎস এবং দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রাখে। যেখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রায়ই নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা করেন। এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
তবে বাস্তবতা হলো, প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নয়াদিল্লির কার্যক্রম; যেমন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকটের সময় অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া—ভারতকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
যা হোক, এখন এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে—ঠিক তখনই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে গতি পাচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার তাগিদ আরও বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই নিবন্ধের লেখক এই প্রস্তাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তুলে ধরেন। সে সময় জয়শঙ্কর উদাহরণ দেন ভারত কীভাবে আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে—অবকাঠামোগত প্রকল্প, আর্থিক সহায়তা, টিকা বিতরণ এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের মাধ্যমে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে কেন ভারতের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আঞ্চলিক সংহতি ও আস্থা এখনো দুর্বল।
এটি পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিবাসন, জলবায়ু ও চীনের বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যা হোক, এই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে না পারলেও সমমনা দেশগুলো তাদের শক্তি ও সংযুক্তি সক্ষমতা ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সহজতর করতে পারে; যেমন জলবায়ু সহনশীলতা, অভিবাসন এবং শারীরিক ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি।
তবে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। কারণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা কমছে, বৈদেশিক নীতি এখন ‘অগ্রাধিকার’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে এবং আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলে যা ঘটে, তার প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একধরনের অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জি বিক্ষোভে গত সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এটি অনেকটা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর মতো। সে সময় শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। আবার ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার ‘আরাগালায়া বা সংগ্রাম’ আন্দোলনও একই ধারায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
এ ধরনের একের পর এক গণ-আন্দোলন ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও জনসংখ্যাগত চাপের মতো মৌলিক সংকটে ভুগছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া। নেপালের কথাই ধরা যাক—রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর ২০০৮ থেকে গত ১৭ বছরে দেশটিতে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছিল ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামে। নেপালের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশির বয়স ১৫ বছরের নিচে, দেশের জনগণের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর, আর প্রতি পাঁচজন তরুণের একজন বেকার।
এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের চারপাশে যেন এক অস্থিরতার বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তায় চলছে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমার কার্যত ব্যর্থ বা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর চীন ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশীই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, তাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘ এবং দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় পরস্পরের সঙ্গে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৪ সালে।
গত কয়েক বছরে ভারতের আলোচনা ও বিশ্লেষণে প্রাধান্য পেয়েছে দেশটির বৈশ্বিক ভূমিকা ও পরাশক্তি হয়ে ওঠার উচ্চাভিলাষ। ২০২৩ সালে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব, মহাকাশ অভিযান, বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান এবং দশকের শেষে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা—এসব বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আলোচনায় এসেছে বেশি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের মতো শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। কিন্তু ভারতের মধ্যে এই আলোচনায় নিকট প্রতিবেশীরা যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটার একটা কারণ, নয়াদিল্লির নিজস্ব প্রবণতা—বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পুরো অঞ্চলকে আলাদা নজরে দেখা। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে সব দক্ষিণ এশীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং প্রথম দফায় তিনি ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি ঘোষণা করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সরকার ভারতকে আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে চলতি বছরের ‘রাইসিনা ডায়ালগে’। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান কূটনৈতিক সম্মেলনে ইউক্রেন ও গাজা সংঘাত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মহাকাশে আধিপত্য—সব বিষয়ই সেখানে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, মাত্র ছয় মাস আগে বাংলাদেশের মনসুন রেভল্যুশনে ক্ষমতাচ্যুত হয় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকারগুলোর একটি।
রাইসিনা ডায়ালগের ঠিক এক মাস পর চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরে প্রাণঘাতী হামলা হয়। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় পর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। ডায়ালগে ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করলেও আফগানিস্তান বা মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এটিই ইঙ্গিত দেয় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি একধরনের ‘উদাসীনতা’ ধীরে ধীরে নীতি-কৌশলে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার ভারতীয় সংসদ সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার আলোচনায় এক সদস্য বলেন, ভারত তার প্রতিবেশীকে ভৌগোলিক দূরত্বে নয়, বরং ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। যদিও সত্য এই যে কোয়াড বা ব্রিকসের মতো ‘সমভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর’ জোট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গতি পেয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার বিকল্প হতে পারে না।
ভারতের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংকটের দায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনকে দেন। পাকিস্তান সার্কের সদস্যদেশ—এটি হয়তো সার্কের অচলাবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু এতে ব্যাখ্যা মেলে না, কেন অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনও প্রায় অকার্যকর হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন ‘বিমসটেক’-এর কথা। পাকিস্তান এর সদস্য নয়, তবু ১৯৯৭ সালে গঠনের পর থেকে সংগঠনটি মাত্র ছয়বার শীর্ষ সম্মেলন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতার সঙ্গে আঞ্চলিক ঘটনাবলিকে নয়াদিল্লির গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা—গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনায় এমন বিশ্লেষণ প্রায় অনুপস্থিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বাইরের নিরাপত্তা হুমকি আসে তাদের সীমান্ত বা আশপাশের অঞ্চল থেকেই; যেমন ইউরোপের জন্য রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এক অস্তিত্বের হুমকি বা স্নায়ুযুদ্ধকালে কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় হুমকি এসেছিল নিজের ‘পেছনের উঠান’ থেকেই। আবার অনুপ্রবেশের মতো বিষয়ও বহু দেশের রাজনীতিতে তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যদি নিজেকে কেবল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে—তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে না।
এই ‘উদাসীনতা’ ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট। সম্প্রতি লাদাখ (যা চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত অঞ্চল) ও মণিপুরে অস্থিরতার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। মণিপুর রাজ্যটি মিয়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত। দুই ক্ষেত্রেই কেন্দ্র সরকার ধীর প্রতিক্রিয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মণিপুরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার দুই বছরের বেশি সময় পর নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফরে যান।
নয়াদিল্লির দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। পূর্বমুখী নীতি বা ‘লুক ইস্ট’ নীতি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নামে নতুনভাবে প্রচারে আনে, যা আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশে ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিশীল সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে।
ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও (যা নয়াদিল্লি ‘ওয়েস্ট এশিয়া’ বলে উল্লেখ করে) জটিল। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক ও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতা এতে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে এক নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারত এই অঞ্চলের (পাকিস্তানের পর পশ্চিম দিকে) সঙ্গে যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে নানা বাধা কাটিয়ে উঠেছে। আকাশপথ, নৌপথ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়াতে দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে ইরানে নয়াদিল্লি পরিচালিত চাবাহার বন্দর এবং ২০২৩ সালে জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডর’-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে। পাশাপাশি কাবুলের তালেবান সরকারের সঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের সম্পৃক্ততা এখনো নড়বড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘোষিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বিবেচনায় নিলে সেই পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, চীন বৈশ্বিক শক্তি হয়ে ওঠার আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ও আন্তর্দেশীয় উৎপাদন নেটওয়ার্কে নিজেদের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যদি দেশটি বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
পশ্চিমা দেশগুলোও অনেক সময় ভারতকে একা একটি দেশ হিসেবে দেখে—দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নয়। এর পেছনে আংশিক কারণ প্রশাসনিক জটিলতা; যেমন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান ডিরেক্টরেট’ আলাদা বিভাগ, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ে কাজ করে আরেকটি বিভাগ— ‘আফগানিস্তান অ্যান্ড পাকিস্তান ডিরেক্টরেট।’
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে (ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স) ভারত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’-এর অধীনে, আর আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’-এর অধীনে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গরকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নয়াদিল্লিতে নিয়োগ দেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপ। যদিও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই নিয়োগ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ভারত-পাকিস্তানকে একসঙ্গে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করবে এবং ভারতকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি হিসেবেই দেখবে।
সর্বোপরি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতনীতি আরও নিবিড়ভাবে দক্ষিণ এশিয়া নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারতকে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা দেশগুলোও এই অঞ্চলের অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে এগোতে পারবে।
এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার চাপ—দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের বয়স এখনো ১৮ বছরের নিচে। রয়েছে জলবায়ু ঝুঁকি—এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপর্যয়-সংবেদনশীল এলাকার একটি। আছে অভিবাসন সংকটও—অনেক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীর বড় অংশ দক্ষিণ এশীয়।
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোরও ভাবতে হবে—কীভাবে তারা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে সাজাবে। কারণ, এখন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার ও গোষ্ঠীকে সরিয়ে জনগণের শক্তিতে নতুন প্রজন্মের নেতারা উঠে আসছেন।
এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে পরাজিত হয়েছেন পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রার্থীরা। বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী জোটের নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে, যার দল জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা একসময় দেশজুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল। এই অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল শ্রীলঙ্কার অস্থির রাজনীতিকে যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি দেশের মূলধারার রাজনীতির প্রতি জনগণের গভীর হতাশাও স্পষ্ট করেছে।
বাংলাদেশ ও নেপালে একই ধরনের কিছু রাজনৈতিক প্রবণতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। দুই দেশই বর্তমানে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আছে। বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। ছাত্র ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে—বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নেপালের হামি নেপাল-এর মতো সংগঠনগুলো এখন প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এই প্রবণতা দুই দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির প্রভাবকে দুর্বল করার সম্ভাবনা তৈরি করছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’-এর যুগে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো এবং নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলে (নেপালি কংগ্রেস ও দুটি কমিউনিস্ট পার্টি) ছিল পুরুষ নেতাদের আধিপত্য।
এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য উভয় রাষ্ট্র থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে, পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতাও রক্ষা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে—দেশটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎস এবং দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রাখে। যেখানে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা প্রায়ই নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা করেন। এটি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
তবে বাস্তবতা হলো, প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নয়াদিল্লির কার্যক্রম; যেমন শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকটের সময় অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া—ভারতকে ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে।
যা হোক, এখন এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে—ঠিক তখনই আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে গতি পাচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার তাগিদ আরও বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই নিবন্ধের লেখক এই প্রস্তাব ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তুলে ধরেন। সে সময় জয়শঙ্কর উদাহরণ দেন ভারত কীভাবে আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে—অবকাঠামোগত প্রকল্প, আর্থিক সহায়তা, টিকা বিতরণ এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের মাধ্যমে। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে কেন ভারতের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আঞ্চলিক সংহতি ও আস্থা এখনো দুর্বল।
এটি পশ্চিমাদের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অভিবাসন, জলবায়ু ও চীনের বৈশ্বিক ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। যা হোক, এই অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে না পারলেও সমমনা দেশগুলো তাদের শক্তি ও সংযুক্তি সক্ষমতা ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সহজতর করতে পারে; যেমন জলবায়ু সহনশীলতা, অভিবাসন এবং শারীরিক ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি।
তবে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে না। কারণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা কমছে, বৈদেশিক নীতি এখন ‘অগ্রাধিকার’ নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে এবং আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলে যা ঘটে, তার প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

একটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
২২ নভেম্বর ২০২৪
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
১৭ ঘণ্টা আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২১ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
১ দিন আগে