অনলাইন ডেস্ক
পদার্থবিদ্যার এক জটিল ধারণা ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’। সহজভাবে এটিকে ‘ত্রিমুখী সমস্যা’ও বলা যেতে পারে। তিনটি মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়া এক অনিশ্চিত অপরিমাপযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করে— এটি বোঝাতেই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। এই ধারণাটি এখন রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনটি প্রধান পক্ষ যেমন—ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা—পরস্পর যখন এমনভাবে মিথস্ক্রিয়া করে যা অস্থির এবং অননুমেয় ফলাফলের জন্ম দেয়, সেই পরিস্থিতিকেই রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বলা হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অনাস্থা, মিত্র পরিবর্তন এবং পারস্পরিক প্রভাব এই পরিস্থিতি তৈরি করে।
রাজনীতিতে থ্রি-বডি প্রবলেম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পদার্থবিদ্যার সমস্যাটির মতোই, এখানে কোনো একক পক্ষ অন্যদের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে একটা অস্থির রাজনৈতিক গতিশীলতা তৈরি হয়।
কোনো এক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিটি পক্ষ স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের ভিত্তিতে মিত্র খুঁজতে থাকে, জোটবদ্ধ হয় বা বিরোধিতা করে। তখন এই ধরনের মৈত্রী বা জোট হয় খুবই অস্থির। পক্ষগুলোর এমন আচরণ পুরো ব্যবস্থাকেই অস্থিতিশীল করে তোলে।
এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রতিটি পক্ষের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়শই অপ্রত্যাশিত পরিণতি বা ফিডব্যাক লুপ তৈরি করে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। একের পর এক ইস্যু বদল হতে থাকে।
দ্বি-পক্ষীয় ব্যবস্থা (যেমন দুই-দলীয় রাজনীতি) সংঘাতের একপর্যায়ে স্থিতাবস্থা অর্জন করে। উভয়পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু থ্রি-বডি প্রবলেম বা ত্রিমুখী ব্যবস্থায় খুব কমই অনুমানযোগ্য ভারসাম্য তৈরি হয়। স্বার্থগুলো বহুমাত্রিক হওয়ার হওয়ার কারণে স্থির ভারসাম্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
একই ভাবে এ বছর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বাজারের পারস্পরিক ক্রিয়া শেয়ারবাজার, বন্ড, কমোডিটি ও মুদ্রার গতিপথ অনুমান করা ট্রেডার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও কঠিন করে তুলেছে।
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ শব্দবন্ধটি চীনা ঔপন্যাসিক লিউ সিক্সিনের উপন্যাস ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’ থেকে গণমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে। সর্বশেষ এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০২৪ সালে সিরিজ মুক্তি দিয়েছে নেটফ্লিক্স। এই সিরিজ রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
এই উপন্যাসের উপজীব্য চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাল। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে রাজনৈতিক চরমপন্থা এবং সরকারি সেন্সরশিপ। নেটফ্লিক্সের নির্মাতারা আধুনিক রাজনীতির সঙ্গেও এর সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন।
লিউ সিক্সিনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং এর নেটফ্লিক্স সংস্করণে ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ সমস্যাটিকে ‘রাজনৈতিক ও অস্তিত্ববাদী’ বিষয়বস্তুর রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে, একটি তিন-নক্ষত্র ব্যবস্থায় গ্রহের বিশৃঙ্খল কক্ষপথের কারণে কীভাবে ত্রিসোলারান সভ্যতা অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে। এটিকে মানবজাতির ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার’ সমান্তরাল বলা হচ্ছে। উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ভয়, আদর্শ (আইডলজি) এবং টিকে থাকার তাগিদ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে চালিত করে। উপন্যাসে মানবজাতির বিভিন্ন দল ত্রিসোলারানদের পক্ষে বা বিপক্ষে জোটবদ্ধ হয়। ত্রিসোলারান আক্রমণের হুমকি ফুটিয়ে তোলে কীভাবে ‘বহিরাগত চাপ’ (যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক সংঘাত) জাতিগুলোকে ‘অস্থির জোট বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ ঠেলে দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই থ্রি-বডি প্রবলেম বুঝতে পারাটা সহজ। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া সম্পর্কের মতো ত্রিমুখী কূটনীতি প্রায়শই ‘থ্রি-বডি’ গতিমুখ প্রদর্শন করে। প্রতিটি দেশের পদক্ষেপ (যেমন বাণিজ্য চুক্তি, নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক অবস্থান) অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়ই অস্থিরতা তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিক্সনের চীন সফর (১৯৭২) যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন-চীন ত্রিভুজ ভেঙে দিয়েছিল। এই সফর নতুন হিসাব-নিকাশের জন্ম দেয়।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে এই তিনটি শক্তি বাণিজ্য যুদ্ধ, সামরিক উত্তেজনা এবং কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে দিয়ে চলছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রচেষ্টা (যেমন, চীনকে প্রতিহত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোট) এমন এক পরিবর্তনশীল গতিশীলতা তৈরি করেছে যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ট্রিপল এন্টেন্ট (ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য) বনাম ট্রিপল অ্যালায়েন্স (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ইতালি) ‘থ্রি-বডি’র মতো জটিলতা প্রদর্শন করেছিল। যেখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কৌশলগত প্রয়োজনের কারণে জোটগুলো পরিবর্তিত হয়েছিল।
ইউক্রেন সংঘাত এর একটি উদাহরণ: রাশিয়া, ন্যাটো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে) এবং চীন একটি ত্রিমুখী গতিশীলতা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটি পক্ষের পদক্ষেপ (নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানি চুক্তি, বা সামরিক সাহায্য) অপ্রত্যাশিতভাবে প্রভাব ফেলে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্রিভুজ ‘থ্রি-বডি’ বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে। বাণিজ্য বিরোধ, জলবায়ু আলোচনা এবং প্রযুক্তিগত মান (যেমন এআই রেগুলেশন) প্রতিটি পক্ষকে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করছে, যেখানে কোনো স্থিতিশীল সংহতি নেই। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪-২৫ সালে ইইউ’র ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ওপর জোর (যেমন জিডিপিআর প্রয়োগ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের কৌশল সমন্বয় করতে বাধ্য করছে।
এ ছাড়া বহু-দলীয় গণতন্ত্রে, তিনটি প্রভাবশালী দল বা উপদল অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস, বিজেপি এবং আম আদমি পার্টি (এএপি) বা তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) মতো আঞ্চলিক দলগুলো একটি জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। নির্বাচনী ফলাফল এবং আঞ্চলিক স্বার্থের ভিত্তিতে জোটগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজেপির বিপরীতে ইন্ডিয়া জোট কার্যকর না হওয়া এর একটি মোক্ষম দৃষ্টান্ত।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে রক্ষণশীল, বামপন্থী, উদার গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। কোনো একক দল প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাময়িক জোটগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতা পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের পর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা যখন কনজারভেটিভদের সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন ব্রিটেনের রাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়েছিল।
বাংলাদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা চলছে, সেখানেও এই থ্রি-বডি প্রবলেম অনেকখানি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক জোট এখনো নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে বহু মেরু অবস্থান দেখা যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় জোটের আভাস মিলছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলো সাময়িক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে পারছে না। পারস্পরিক প্রভাব অর্থাৎ কোনো একটি দলের তাৎক্ষণিক অবস্থান অন্যদের সিদ্ধান্তেও যেভাবে প্রভাব ফেলছে তাতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যদি দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী উপদল থাকে। মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল এবং পপুলিস্ট (জনতুষ্টিবাদী)—এমন দ্বন্দ্ব অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা বা অস্থির নীতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ২০২০ সালের মার্কিন ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির কথা স্মরণ করতে পারি। ওই সময় বার্নি স্যান্ডার্সের প্রগতিশীল, জো বাইডেনের মধ্যপন্থী এবং এলিজাবেথ ওয়ারেনের মিশ্র উপদলের মধ্যে উত্তেজনা ঐক্যের পথকে জটিল করে তুলেছিল।
অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বহু-পক্ষীয় ব্যবস্থায় স্থিতিশীল শাসন বা কূটনীতি কঠিন করে তোলে। ত্রিমুখী মিথস্ক্রিয়াগুলো সহজ সমাধানকে বারবার প্রতিহত করে। এর জন্য পক্ষগুলোর মধ্যে অবিরাম আলোচনা এবং অভিযোজনের প্রয়োজন হয়। আলোচনাই উদ্ভাবনের (যেমন, সৃজনশীল জোট) দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয় তবে অচলাবস্থা বা সংঘাতের কারণও হতে পারে।
তাহলে এই ধরনের জটিলতার সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে? ভূরাজনৈতিক তো বটেই যে কোনো সম্পর্কে মিত্রতার প্রথম শর্ত হলো হলো প্রতিপক্ষের আচরণ ‘অনুমানযোগ্য’ হওয়া। ক্ষুদ্র ও স্বল্পমেয়াদি স্বার্থে যদি কোনো পক্ষ অস্থির ও প্রতারণামূলক আচরণ করতে থাকে তাহলে সমঝোতা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে স্বল্পমেয়াদি জোট গঠনও কার্যকর হতে পারে। সংসদীয় জোটের ক্ষেত্রে এটি অনেক সময় স্থিতিশীলতা দেয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ চতুর্থ পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা কমাতে পারে। সে ক্ষেত্রেও পক্ষগুলোর মধ্যে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা জরুরি।
এসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নেওয়া এড়িয়ে যাওয়া উচিত। সমঝোতার শর্ত তৈরির সুযোগ দিতে অন্যদের অভিপ্রায় প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ এখন রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী রূপক। দুই-এর বেশি শক্তি যদি বিরোধে লিপ্ত হয় তাহলে ফলাফল প্রায়শই বিশৃঙ্খল ও অস্থির হয়। নীতি নির্ধারকেরা হয়তো এটি বোঝেন, কিন্তু নানা অনুঘটক ও শক্তি এখানে অস্থিরতা জিইয়ে রাখার পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে। এই ধরনের অস্থিরতার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়াতে এবং কার্যকরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে ছাড় দেওয়ার মানসিক নিয়ে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পদার্থবিদ্যার এক জটিল ধারণা ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’। সহজভাবে এটিকে ‘ত্রিমুখী সমস্যা’ও বলা যেতে পারে। তিনটি মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়া এক অনিশ্চিত অপরিমাপযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করে— এটি বোঝাতেই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। এই ধারণাটি এখন রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনটি প্রধান পক্ষ যেমন—ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা—পরস্পর যখন এমনভাবে মিথস্ক্রিয়া করে যা অস্থির এবং অননুমেয় ফলাফলের জন্ম দেয়, সেই পরিস্থিতিকেই রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বলা হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অনাস্থা, মিত্র পরিবর্তন এবং পারস্পরিক প্রভাব এই পরিস্থিতি তৈরি করে।
রাজনীতিতে থ্রি-বডি প্রবলেম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পদার্থবিদ্যার সমস্যাটির মতোই, এখানে কোনো একক পক্ষ অন্যদের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে একটা অস্থির রাজনৈতিক গতিশীলতা তৈরি হয়।
কোনো এক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিটি পক্ষ স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের ভিত্তিতে মিত্র খুঁজতে থাকে, জোটবদ্ধ হয় বা বিরোধিতা করে। তখন এই ধরনের মৈত্রী বা জোট হয় খুবই অস্থির। পক্ষগুলোর এমন আচরণ পুরো ব্যবস্থাকেই অস্থিতিশীল করে তোলে।
এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রতিটি পক্ষের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়শই অপ্রত্যাশিত পরিণতি বা ফিডব্যাক লুপ তৈরি করে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। একের পর এক ইস্যু বদল হতে থাকে।
দ্বি-পক্ষীয় ব্যবস্থা (যেমন দুই-দলীয় রাজনীতি) সংঘাতের একপর্যায়ে স্থিতাবস্থা অর্জন করে। উভয়পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু থ্রি-বডি প্রবলেম বা ত্রিমুখী ব্যবস্থায় খুব কমই অনুমানযোগ্য ভারসাম্য তৈরি হয়। স্বার্থগুলো বহুমাত্রিক হওয়ার হওয়ার কারণে স্থির ভারসাম্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
একই ভাবে এ বছর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বাজারের পারস্পরিক ক্রিয়া শেয়ারবাজার, বন্ড, কমোডিটি ও মুদ্রার গতিপথ অনুমান করা ট্রেডার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও কঠিন করে তুলেছে।
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ শব্দবন্ধটি চীনা ঔপন্যাসিক লিউ সিক্সিনের উপন্যাস ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’ থেকে গণমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে। সর্বশেষ এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০২৪ সালে সিরিজ মুক্তি দিয়েছে নেটফ্লিক্স। এই সিরিজ রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
এই উপন্যাসের উপজীব্য চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাল। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে রাজনৈতিক চরমপন্থা এবং সরকারি সেন্সরশিপ। নেটফ্লিক্সের নির্মাতারা আধুনিক রাজনীতির সঙ্গেও এর সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন।
লিউ সিক্সিনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং এর নেটফ্লিক্স সংস্করণে ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ সমস্যাটিকে ‘রাজনৈতিক ও অস্তিত্ববাদী’ বিষয়বস্তুর রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে, একটি তিন-নক্ষত্র ব্যবস্থায় গ্রহের বিশৃঙ্খল কক্ষপথের কারণে কীভাবে ত্রিসোলারান সভ্যতা অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে। এটিকে মানবজাতির ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার’ সমান্তরাল বলা হচ্ছে। উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ভয়, আদর্শ (আইডলজি) এবং টিকে থাকার তাগিদ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে চালিত করে। উপন্যাসে মানবজাতির বিভিন্ন দল ত্রিসোলারানদের পক্ষে বা বিপক্ষে জোটবদ্ধ হয়। ত্রিসোলারান আক্রমণের হুমকি ফুটিয়ে তোলে কীভাবে ‘বহিরাগত চাপ’ (যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক সংঘাত) জাতিগুলোকে ‘অস্থির জোট বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ ঠেলে দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই থ্রি-বডি প্রবলেম বুঝতে পারাটা সহজ। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া সম্পর্কের মতো ত্রিমুখী কূটনীতি প্রায়শই ‘থ্রি-বডি’ গতিমুখ প্রদর্শন করে। প্রতিটি দেশের পদক্ষেপ (যেমন বাণিজ্য চুক্তি, নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক অবস্থান) অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়ই অস্থিরতা তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিক্সনের চীন সফর (১৯৭২) যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন-চীন ত্রিভুজ ভেঙে দিয়েছিল। এই সফর নতুন হিসাব-নিকাশের জন্ম দেয়।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে এই তিনটি শক্তি বাণিজ্য যুদ্ধ, সামরিক উত্তেজনা এবং কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে দিয়ে চলছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রচেষ্টা (যেমন, চীনকে প্রতিহত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোট) এমন এক পরিবর্তনশীল গতিশীলতা তৈরি করেছে যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ট্রিপল এন্টেন্ট (ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য) বনাম ট্রিপল অ্যালায়েন্স (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ইতালি) ‘থ্রি-বডি’র মতো জটিলতা প্রদর্শন করেছিল। যেখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কৌশলগত প্রয়োজনের কারণে জোটগুলো পরিবর্তিত হয়েছিল।
ইউক্রেন সংঘাত এর একটি উদাহরণ: রাশিয়া, ন্যাটো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে) এবং চীন একটি ত্রিমুখী গতিশীলতা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটি পক্ষের পদক্ষেপ (নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানি চুক্তি, বা সামরিক সাহায্য) অপ্রত্যাশিতভাবে প্রভাব ফেলে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্রিভুজ ‘থ্রি-বডি’ বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে। বাণিজ্য বিরোধ, জলবায়ু আলোচনা এবং প্রযুক্তিগত মান (যেমন এআই রেগুলেশন) প্রতিটি পক্ষকে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করছে, যেখানে কোনো স্থিতিশীল সংহতি নেই। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪-২৫ সালে ইইউ’র ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ওপর জোর (যেমন জিডিপিআর প্রয়োগ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের কৌশল সমন্বয় করতে বাধ্য করছে।
এ ছাড়া বহু-দলীয় গণতন্ত্রে, তিনটি প্রভাবশালী দল বা উপদল অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস, বিজেপি এবং আম আদমি পার্টি (এএপি) বা তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) মতো আঞ্চলিক দলগুলো একটি জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। নির্বাচনী ফলাফল এবং আঞ্চলিক স্বার্থের ভিত্তিতে জোটগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজেপির বিপরীতে ইন্ডিয়া জোট কার্যকর না হওয়া এর একটি মোক্ষম দৃষ্টান্ত।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে রক্ষণশীল, বামপন্থী, উদার গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। কোনো একক দল প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাময়িক জোটগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতা পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের পর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা যখন কনজারভেটিভদের সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন ব্রিটেনের রাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়েছিল।
বাংলাদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা চলছে, সেখানেও এই থ্রি-বডি প্রবলেম অনেকখানি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক জোট এখনো নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে বহু মেরু অবস্থান দেখা যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় জোটের আভাস মিলছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলো সাময়িক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে পারছে না। পারস্পরিক প্রভাব অর্থাৎ কোনো একটি দলের তাৎক্ষণিক অবস্থান অন্যদের সিদ্ধান্তেও যেভাবে প্রভাব ফেলছে তাতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যদি দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী উপদল থাকে। মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল এবং পপুলিস্ট (জনতুষ্টিবাদী)—এমন দ্বন্দ্ব অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা বা অস্থির নীতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ২০২০ সালের মার্কিন ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির কথা স্মরণ করতে পারি। ওই সময় বার্নি স্যান্ডার্সের প্রগতিশীল, জো বাইডেনের মধ্যপন্থী এবং এলিজাবেথ ওয়ারেনের মিশ্র উপদলের মধ্যে উত্তেজনা ঐক্যের পথকে জটিল করে তুলেছিল।
অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বহু-পক্ষীয় ব্যবস্থায় স্থিতিশীল শাসন বা কূটনীতি কঠিন করে তোলে। ত্রিমুখী মিথস্ক্রিয়াগুলো সহজ সমাধানকে বারবার প্রতিহত করে। এর জন্য পক্ষগুলোর মধ্যে অবিরাম আলোচনা এবং অভিযোজনের প্রয়োজন হয়। আলোচনাই উদ্ভাবনের (যেমন, সৃজনশীল জোট) দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয় তবে অচলাবস্থা বা সংঘাতের কারণও হতে পারে।
তাহলে এই ধরনের জটিলতার সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে? ভূরাজনৈতিক তো বটেই যে কোনো সম্পর্কে মিত্রতার প্রথম শর্ত হলো হলো প্রতিপক্ষের আচরণ ‘অনুমানযোগ্য’ হওয়া। ক্ষুদ্র ও স্বল্পমেয়াদি স্বার্থে যদি কোনো পক্ষ অস্থির ও প্রতারণামূলক আচরণ করতে থাকে তাহলে সমঝোতা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে স্বল্পমেয়াদি জোট গঠনও কার্যকর হতে পারে। সংসদীয় জোটের ক্ষেত্রে এটি অনেক সময় স্থিতিশীলতা দেয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ চতুর্থ পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা কমাতে পারে। সে ক্ষেত্রেও পক্ষগুলোর মধ্যে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা জরুরি।
এসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নেওয়া এড়িয়ে যাওয়া উচিত। সমঝোতার শর্ত তৈরির সুযোগ দিতে অন্যদের অভিপ্রায় প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।
‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ এখন রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী রূপক। দুই-এর বেশি শক্তি যদি বিরোধে লিপ্ত হয় তাহলে ফলাফল প্রায়শই বিশৃঙ্খল ও অস্থির হয়। নীতি নির্ধারকেরা হয়তো এটি বোঝেন, কিন্তু নানা অনুঘটক ও শক্তি এখানে অস্থিরতা জিইয়ে রাখার পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে। এই ধরনের অস্থিরতার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়াতে এবং কার্যকরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে ছাড় দেওয়ার মানসিক নিয়ে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ফেসেঙ্কো বলেন, ‘উভয় পক্ষই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিবেচনা করবে এবং যে প্রথমে আলোচনা ছেড়ে যাবে, সে তার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার অবস্থান হারাবে।’ আবার, আলোচনা সম্ভবত দেখাবে যে উভয় পক্ষই মীমাংসার জন্য প্রস্তুতও নয়। কারণ, রাশিয়া ইউক্রেনের আরও অঞ্চল নিজেদের জন্য দখল
১৩ ঘণ্টা আগেইউক্রেন যুদ্ধে বেশ কয়েকটি ঘটনায় এস-৪০০-এর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে যখন ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান অস্ত্রাগার, বিশেষ করে মার্কিন-সরবরাহকৃত এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের মুখোমুখি হয় তখন এই রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব একটা কাজে দেয় না।
১ দিন আগেআসলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মি উভয়ই চীনা ভাড়াটে সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছে। জান্তা সরকার মিয়ানমারে বিদেশি সৈন্যদের উপস্থিতিকে বৈধতা দিতে একটি আইন পাশ করেছে। তবে আরাকান আর্মির অনুমোদন কম আনুষ্ঠানিক। তাদের আলোচনার বিষয়ে অবগত এক ব্যক্তি বলেছেন, ‘অবশ্যই, তাদের একপ্রকার..
১ দিন আগেতুরস্কে ২০০৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ানের আগের শাসনামল এই জেন-জি দেখেনি। তবে সাম্প্রতিক আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে তারাই—বিশেষত ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা, যারা এখনকার প্রাপ্তবয়স্ক এবং মোট ভোটারদের এক চতুর্থাংশ। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ এরদোয়ানের দল একে পার্টিকে ভোট...
৪ দিন আগে