Ajker Patrika

বিরোধীদের বাউন্সারে ইমরানের হুক, ছক্কা নাকি আউট?

ইয়াসিন আরাফাত 
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২২, ১৭: ২১
বিরোধীদের বাউন্সারে ইমরানের হুক, ছক্কা নাকি আউট?

তিনটি বছর ক্ষমতায় থাকার পর ইমরান খানের গদি এবার টালমাটাল। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা নিয়ে বিপদে তিনি। ইমরান তাঁর এহেন বিপদের জন্য ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুললেও শুধু কি সে কারণেই তিনি গ্যাঁড়াকলে? 

নিন্দুকেরা বলছেন, ক্ষমতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ৬৯ বছর বয়সী সাবেক এই বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী রাজনীতিকেরা। সাদা চোখে দেখলে ইমরান খানের সংকটের শুরুর মূল নায়ক তাঁর রাজনৈতিক জোটের প্রধান শরিক এমকিউএম। গত বুধবার বিরোধী জোটে যোগ দেওয়ার পরই পাকিস্তানের বিরোধী দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আর তার পরেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে আসে ‘হুমকি দেওয়া’ চিঠি ও ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রের সূত্র। ইমরান খান গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে উৎখাতের চেষ্টা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি অস্বীকার করেছে। ইমরানের বিরোধিরা বলছেন, এটি স্রেফ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা। 

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরানের ভাগ্য নিয়ে আগামী ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আগাম ভোট অনুষ্ঠিত হবে। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে হলে ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ জন এমপির সমর্থন পেতে হবে। কাগজে কলমে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের ভোট এখন ১৭৫ আর সরকারি দলের ১৬৪। 

বিশ্লেষকেরা ইমরানের বর্তমান অবস্থার জন্য কেবল ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রই দায়ী তেমনটা মনে করছেন না। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো কার্যকারণের মধ্যে দুর্নীতি একটি বলে মনে করছেন অনেকে। মজার বিষয় হলো, দুর্নীতির ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করে ইমরানও ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু নিজের সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারেননি তিনি। সমালোচকেরা বলছেন, ইমরান খান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পাকিস্তানের সমাজে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে তুলে এনেছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ইমরানের নেতৃত্বাধীন সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে। বিরোধী দলের বেশির ভাগ নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একে অনেকে রাজনৈতিক ‘খেলা’ বলেই মনে করেন। ফলে ইমরানের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানেও আছে ‘দুষ্টু রাজনীতি’র ছায়া। এ নিয়ে পাকিস্তানের বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব বলেন, ‘ক্ষমতা ধরে রাখতে মিথ্যা দুর্নীতির বিবরণ দিয়েছেন ইমরান খান। তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন আমাদের দলের সবাইকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। আমরা প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম পরবর্তী কে জেলে যাবে, সেই খবরের জন্য।’ 

ওদিকে ইমরানের আমলও ধোয়া তুলসিপাতার মতো নয়। জার্মানভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স-২০২১ (সিপিআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত ১৮০টি দেশের তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান নিচ থেকে ১৪০। এর আগে ২০২০ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ১২৪, ২০১৯ সালে ১২০ এবং ২০১৮ সালে ১১৭তম। অর্থাৎ, ইমরানের আমলেও দুর্নীতিতে পাকিস্তানের অবনমন ছাড়া উন্নয়ন হয়নি।   

পাকিস্তানের লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিদি কিরমানি বলেন, ‘খানের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য সাধারণ মানুষের হতাশাকে টোকা দেয়। এগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের সস্তা টোপ। কিন্তু তা বিশ্লেষণ এবং তার পরিপূর্ণ সমাধান করার ইচ্ছা কমই ছিল ইমরানের।’ 

পাকিস্তানের সরকারপ্রধানদের ভাগ্যনিয়ন্তা হিসেবে দেশটির সামরিক বাহিনী বিখ্যাত। বিরোধীদের দাবি, ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেনা প্রভাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকে সরাতে পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি দলকে ব্যবহার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই সমর্থন নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন ইমরান খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিক্ষোভকারীদের প্রতি সেনাবাহিনীর অন্তর্নিহিত সমর্থন ও নীরব অভ্যুত্থানই ইমরান খানকে জাতীয় রাজনীতিতে পোক্ত জায়গা করে দেয়। শোনা যাচ্ছে, এবার সেই সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও মতান্তর হয়েছে ইমরানের। যদিও এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এর সংগত কারণ অনুমান করাও সহজ। খালে নেমে কুমিরের সঙ্গে কে আর যুঝতে যায়!

২০১৪ সালে ইমরান খানের সরকারবিরোধী আন্দোলনপাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন লাহোরের গবেষক হাসান আসকারী রিজভী। তাঁর মতে, ইমরান খান সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় ফাটল তৈরি করেন। সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে এখন এবং এটি ভবিষ্যতেও বজায় থাকতে পারে। আর সেটি বজায় থাকলে ইমরানের সংকট আরও ঘনীভূত হওয়াটা অসম্ভব নয়। 

২০১৮ সালে পাকিস্তানে ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরির ইশতেহার দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। তিনি পাঁচটি ভিন্ন নির্বাচনি এলাকা থেকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ভোট নিয়ে জয়লাভ করেন। ওই সময় ইমরান খান বলেছিলেন, ‘চীন ৭০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করেছে। আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।’ চীনের প্রতি ইমরানের এই ‘প্রীতি’ দিনকে দিন আরও বেড়েছে। ধীরে ধীরে ঘোর পশ্চিমাবিরোধী হয়ে উঠেছেন তিনি। ২০২০ সালের জুনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১১ সালে অভিযান চালিয়ে আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে ৷ আর গত বছর মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পর ইমরান খান বলেন, ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে আফগানরা।’ সেই সঙ্গে তালেবানের প্রশংসাও করেন তিনি। 

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধের দামামার মধ্যে রাশিয়া সফর করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ওই দিনই ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী। মস্কোয় নেমেই ইমরান খান বলেন, ‘কী একটা সময়ে এসেছি...আমি শিহরিত। আমরা মস্কোতে এসে খুবই শিহরিত।’ খুব স্বাভাবিকভাবেই ইমরানের এমন ‘উদ্‌যাপন’ ভালোভাবে নেয়নি পশ্চিমারা। 

রাশিয়া সফরে ইমরান খানপাকিস্তানের আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আহসান ইকবাল। তাঁর মতে, ইউরোপে সংঘাতের বিষয়ে খারাপভাবে ভুলভাবে এগিয়েছেন ইমরান খান। তিনি বলেন, ‘তাঁর (ইমরান খানের) অন্তত বলা উচিত ছিল যে আমরা এই আগ্রাসনকে সমর্থন করি না। তবে আমাদের সরকার কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি এবং আমি মনে করি এটি একটি বড় ভুল ছিল।’ 

এ নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজের মতে, ‘ইমরান খানকে সরিয়ে দেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আবার সুসম্পর্কের অবস্থানে যেতে পারে। কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মেরামত করা সময়ের দাবি।’ 

এ তো গেল নানামুখী রাজনৈতিক খেলার বিষয়। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কেমন আছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ষড়যন্ত্রের তত্ত্বগুলো একপাশে রেখে সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের সমস্যাই ইমরান খানের পতনের জন্য যথেষ্ট।

চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হামিদ মীর বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিজের কথায় অটল থাকতে পারেননি ইমরান খান। ক্ষমতা নেওয়ার পরবর্তী তিন বছরে তিনি ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে অতীতের ঋণ নেওয়ার সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। এদিকে ২০২২ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে পেট্রলের দাম সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দামও। এমন পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকেরা। 

এ ব্যাপারে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সদস্য শেরি রহমান বলেন, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার এত বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে যে, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে। রান্নার তেল, শাকসবজি, মাংস, পেট্রলের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্রুতহারে বেড়েছে।  

এসবের বিপরীতে ইমরান খানের দাবি ছিল, জীবনযাপনের ব্যয়ের দিক থেকে পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা দেশগুলোর একটি। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি দেখছে পাকিস্তান। ডলারের বিনিময়ে পাকিস্তানের রুপির দামেরও রেকর্ড পতন হয়েছে। এ নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, তিনি আলু-টমেটোর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনীতিতে আসেননি। 

অথচ সেই আলু-টমেটোর দাম এখন ইমরানের বিদায়ঘণ্টায় জোর হাওয়া দিচ্ছে। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হারলে হয়তো আগাম নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে পাকিস্তানে। সেখানেও কিন্তু সাধারণ মানুষ আলু-টমেটোর দাম মাথায় রেখেই ভোট দেবেন। হুমকি দেওয়া ‘উড়ো চিঠি’ আর কজনের বিবেচনায় থাকবে?

যদিও পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজের মতে, ভবিষ্যতের নির্বাচনের কথা ভেবেই ইমরান খান হুমকি দেওয়া চিঠি ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের তত্ত্বে মন দিয়েছেন। কারণ নির্বাচনে ব্যবহার করার জন্য এটি একটি ‘নিখুঁত প্লট’। 

ইমরান খান আশা ছাড়ছেন না। গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি ‘শেষ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাবেন’ বলে জানিয়েছেন। খেলার মাঠে ‘হার না মানা’ মানসিকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন ইমরান। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ ঠিক ২২ গজের মতো নয়, বরং ঢের বন্ধুর। এই মাঠে প্রতিপক্ষের বাউন্সার সামলে ধৈর্য ধরে টিকে থাকা বেশ কঠিন। শেষ পর্যন্ত ফিল্ডারের হাতে বল জমা দিয়ে অলরাউন্ডার ইমরান খানের মাথা নিচু করে সাজঘরে ফিরতে হয় কি না, তাই এখন দেখার।       

তথ্যসূত্র: বিবিসি, এএফপি, ডয়চে ভেলে, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও টাইম ম্যাগাজিন

বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হোলি আর্টিজানের ঘটনায় ‘জঙ্গি সন্দেহে’ আটক ছিলেন অনিন্দ্য, রাজশাহীর সাবেক মেয়র লিটনের চাচাতো ভাই তিনি

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান: ভারতীয় দুই কোম্পানির ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করল বাংলাদেশ

রাবির অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ

মহিলা মাদ্রাসা থেকে দুই শিশু শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত