Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সম্ভাব্য গতিপথ এবং সমাধানসূত্র

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ১৬: ৪৪
তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত। ছবি: এএফপি
তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত। ছবি: এএফপি

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল ‘যত দিন লাগে’ হামলা চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি দুর্বল করা এবং দেশটির সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করা। তবে এই লক্ষ্য অর্জিত হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।

ইরানও এরই মধ্যে ইসরায়েলে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। দেশটির হাতে প্রতিশোধ নেওয়ার আরও কিছু সীমিত পাল্টা পদক্ষেপের বিকল্প আছে। যদিও আরও রক্তপাত সম্ভবত অনিবার্য, তবে এখনই যুদ্ধ বন্ধ করার এবং এটি কীভাবে শেষ হতে পারে, তা নিয়ে ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিকল্প আছে, যেভাবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শেষ হতে পারে।

প্রথমত, ইরান ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি বড় আকারের সামরিক হামলা চালাবে। এরপর নিজ জনগণের কাছে দাবি করবে যে তারা পাল্টা জবাব দিয়েছে এবং ইসরায়েলিদের ক্ষতি করেছে। এরপর দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় তারা সম্মতি দেবে। সংক্ষেপে, এটি হবে মুখ বাঁচানোর লক্ষ্যে ‘একটি কৌশলগত আত্মসমর্পণ’।

মূলত, লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অভিযানের পর একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইসরায়েলের বর্তমান ইরান হামলা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে চালানো প্রচেষ্টার সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ—সামরিক অবকাঠামোতে ব্যাপক হামলা এবং অসংখ্য গুপ্তহত্যার মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া। এই বিষয়টি ইরানের নিরাপত্তা পরিষেবায় ইসরায়েলের গভীর অনুপ্রবেশের প্রমাণ দেয়।

হিজবুল্লাহর কাছে রকেটের বিশাল মজুত এবং হাজার হাজার যোদ্ধা থাকার পরও তারা ইসরায়েলের শর্তেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে কোনো কার্যকর পাল্টা আক্রমণ ছাড়াই। ইরানও এবারে হিজবুল্লাহর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি (অন্তত পশ্চিমা গণমাধ্যমের দাবি এমনটাই)।

এ ছাড়া, হিজবুল্লাহর মতো ইরানের প্রধান মিত্ররাও এখন আগের অবস্থার চেয়ে দুর্বল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের একসময়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ডিটারেন্ট) এখন অকার্যকর। ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো বিধ্বংসী হামলা ইরানের নেতৃত্বকে বিশৃঙ্খল করে দিতে পারে। এতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তেহরান দ্রুত শীর্ষ কমান্ডারদের পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেও চলমান সংঘাতে এই নতুন নেতৃত্বের কার্যকারিতা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল সম্ভবত নতুন কমান্ডার এবং তাদের স্থলাভিষিক্তদের ওপরও হামলা চালাবে। ইরান অবশ্যই যুদ্ধের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে চায় না, কিন্তু তারা হয়তো ক্রমাগত হামলা সহ্য না করে ভবিষ্যতের জন্য টিকে থাকার পথ বেছে নেবে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, ইরান টিকে থাকবে এবং ইসরায়েলের ওপর কিছু আঘাত হানবে। এটি প্রক্সি গোষ্ঠী ব্যবহার করে গেরিলা কৌশলে আঘাত হানা, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা বা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। একই সময়ে, ইসরায়েলের ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে। ইরানের নাতাঞ্জ ও অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইরান তুলনামূলকভাবে দ্রুত তা মেরামত করতে পারবে।

সাধারণত, ইসরায়েল যখন ‘শত্রুদের’ ওপর হামলা চালায় তখন প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রধান ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন পায়। কিন্তু ইসরায়েল যখন হামলা চালিয়ে যেতে চায়, তখন এই দেশগুলো দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

ইসরায়েল হয়তো ইউরোপীয়দের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেবে না। কারণ, ইউরোপ কয়েক মাস ধরে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও ইসরায়েল কর্ণপাত করেনি। কিন্তু ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মতামত, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতামতের বিষয়ে বেশি চিন্তিত। যদি ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর সত্যিকারের চাপ সৃষ্টি করেন, তাহলে ইসরায়েল তাদের অভিযান সংক্ষিপ্ত করতে পারে।

এই চাপ দুই দেশতে ফলপ্রসূ কূটনীতির দিকে নিয়ে যাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি আলোচনার চুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই প্রস্তাবিত চুক্তিটি ২০১৫ সালের জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের মতোই। তবে ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন। ট্রাম্প নতুন করে প্রস্তাব দেওয়ার পর ইরান এই আলোচনাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছিল। দেশটির নেতৃত্বের আপাত সমর্থন ছিল, তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে উত্তেজনাও ছিল। যা-ই হোক, ট্রাম্প হামলার পর ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ইরানকে একটি চুক্তি করতেই হবে। এর আগে আর কিছুই থাকবে না এবং যা একসময় ইরানের সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল, তা রক্ষা করতে হবে। আর মৃত্যু নয়, আর ধ্বংস নয়, শুধু এটা করুন, খুব দেরি হওয়ার আগে।’

এই ধরনের আলোচনা তেহরানের জন্য আকর্ষণীয়—দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত এবং নিষেধাজ্ঞা কমানোর প্রতিশ্রুতি তাদের কাছে লোভনীয়। এ ছাড়া ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক অভিযানের পর আলোচনার টেবিলে ইরানকে কম ছাড় দিতে হবে। তবে ইসরায়েলি হামলার মুখে এটি রাজনৈতিকভাবে আরও কঠিন। ট্রাম্প যেকোনো ছাড়কে নিজের বিজয় বলে ঘোষণা করবেন এবং ইরানকে চাপের মুখে নতি স্বীকার করা হয়েছে বলে মনে হবে।

তবে এমন ইতিবাচক পরিস্থিতির বিপরীতে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিও সম্ভব এবং সম্ভবত এটিই ঘটার আশঙ্কা বেশি। বিপর্যয়কর পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে একটি হলো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ইসরায়েলি হামলার আগে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্থাপনায় হামলার হুমকি দিয়েছিল। এ ধরনের হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং আকাশ প্রতিরক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সমর্থন ইরানকে এই ধারণা দিতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তারপরও ইরান ওয়াশিংটনকে জড়িত বলে মনে করতে পারে। তাদের কাছে মনে হতে পারে, আলোচনার আড়ালে মূলত ইসরায়েলকে সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও ইসরায়েল ও মার্কিন কর্মকর্তারা সতর্ক করেছিলেন, ইরান যদি চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু অভিযানের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাম্প নিশ্চিত করেন, যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সমাধানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং হামলা আসন্ন নয়। যদি তেহরান আলোচনাকে আড়াল হিসেবে দেখে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্থাপনাগুলো ইরানের ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রও নিজ কারণে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করতে পারেন, ইসরায়েল হামলার মাধ্যমে অর্ধেক কাজ করে ফেলেছে এবং এখন যুক্তরাষ্ট্র বাকি কাজ শেষ করতে পারে। আর তারা ইরানের ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে ভারী বাংকার বাস্টার দিয়ে হামলা চালাতে পারে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবেশে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ঘোরতর।

ইরান সম্ভবত ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং অন্যান্য স্থানে তাদের প্রক্সিদের ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য যা যা করা সম্ভব, করতে বলবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারাও মার্কিন স্থাপনাকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। এভাবে, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন, ইরাক এবং অন্যান্য স্থানে ইরানি প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে।

বর্তমানে অসম্ভাব্য মনে হলেও এই সংঘাতে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা জড়িত হতে পারে। জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনী এরই মধ্যে তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আটকের খবর জানিয়েছে। জর্ডানের এই পদক্ষেপকে আত্মরক্ষা হিসেবে দেখানো হলেও যদি যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হয়, তাহলে ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে অথবা তাদের ওপর নির্ভর করতে পারে।

একটি চূড়ান্ত সম্ভাবনা হলো, যুদ্ধ কখনোই শেষ হবে না। অন্তত আনুষ্ঠানিক অর্থে নয়। যদিও ইসরায়েলের বিশাল আকারের হামলার ঢেউ হয়তো একসময় থামবে, কিন্তু নিম্নস্তরের সংঘাত আরও কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। ইসরায়েল হয়তো মাঝেমধ্যে ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান হামলা চালাবে, পাশাপাশি ইরানে গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাবে। ইরানও মাঝেমধ্যে ইসরায়েলের দিকে হামলা চালাবে, সঙ্গে অন্যান্য উপায়েও পাল্টা আঘাতের চেষ্টা করবে। এটি সর্বাত্মক যুদ্ধ না হলেও কোনো স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিও নয়।

ক্রমাগত পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে, ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শন ছাড়াই গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরি করতে পারে এবং ইসরায়েলি হামলাকে এর ন্যায্যতা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইসরায়েল যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের তিনটি সংরক্ষণাগারেই আঘাত না করে, তাহলে তেহরানের জন্য এই কাজটি কঠিন হবে না।

আবার, বিভিন্ন সম্ভাবনার সমন্বয়ও সম্ভব। মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি একটি বৃহত্তর পারমাণবিক চুক্তির প্রথম ধাপ হতে পারে। ইরান হয়তো স্বল্প মেয়াদে ছাড় দেবে, কিন্তু বিশ্বাস করবে যে—প্রতিশোধ ঠান্ডা মাথায় নিতে হয় এবং আগামী মাসগুলোতে প্রক্সি হামলা চালাবে এবং প্রতিশোধের একটি রূপ হবে এটি। এভাবেই এটি একটি চিরস্থায়ী পাল্টাপাল্টি হামলার যুদ্ধে পরিণত হবে।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত