Ajker Patrika

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের কাজ কী, দেশে কেন আপত্তি

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৫৩
জেনেভায় ওএইচসিএইচআর-এর সদরদপ্তর। ছবি: সংগৃহীত
জেনেভায় ওএইচসিএইচআর-এর সদরদপ্তর। ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর), বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান সংস্থা হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা জাতিসংঘ সচিবালয়ের একটি বিভাগ হিসেবে পরিচালিত হয়। এ সংস্থার ম্যান্ডেট জাতিসংঘের সনদ (ইউএন চার্টার) এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র থেকে উদ্ভূত।

কাজের ক্ষেত্র

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) কাজ অত্যন্ত বিস্তৃত এবং বহুমুখী। এটির লক্ষ্য হলো সবার জন্য মানবাধিকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। এই সংস্থার প্রধান প্রধান কাজের ক্ষেত্রগুলো হলো:

সর্বজনীন মানবাধিকার: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রকাশিত মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়া।

মানবাধিকার ইস্যুতে নেতৃত্ব: বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার আলোচনায় একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, আন্তর্জাতিক ও জাতীয়—উভয় স্তরেই মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

জাতিসংঘ ব্যবস্থার কার্যক্রম সমন্বয়: পুরো জাতিসংঘ ব্যবস্থার মধ্যে মানবাধিকার-সংক্রান্ত প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত ও সমন্বয় করা।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রচার: রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলো অনুমোদন এবং সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নে উৎসাহিত করা।

নতুন মানদণ্ড তৈরি: নতুন মানবাধিকার মানদণ্ড এবং দলিল তৈরিতে সহায়তা করা।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সমর্থন: জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা এবং চুক্তি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোকে, যেমন—মানবাধিকার কাউন্সিল এবং বিভিন্ন চুক্তি সংস্থা, বাস্তব ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া: মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ: সংঘাত বা অপব্যবহারের দিকে নিয়ে যেতে পারে—এমন পরিস্থিতি প্রশমিত করতে প্রতিরোধমূলক মানবাধিকার কার্যক্রম গ্রহণ করা।

জাতীয় মানবাধিকার অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা: সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে স্বাধীন জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান (এনএইচআরআই) প্রতিষ্ঠা ও সমর্থন করা।

ক্ষেত্রভিত্তিক কার্যক্রম ও অভিযান: মাঠপর্যায়ে উপস্থিতির মাধ্যমে সংস্থাটি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে প্রায়ই কারিগরি সহায়তা এবং পর্যবেক্ষণ দেয়।

শিক্ষা ও অ্যাডভোকেসি: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জনসাধারণের মধ্যে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং জড়িত থাকার জন্য গবেষণা, শিক্ষা এবং অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমে অংশ নেওয়া।

সরকারকে সহায়তা: বিচার প্রশাসন, আইন সংস্কার, মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন এবং মানবাধিকার শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোতে সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সক্ষমতা-নির্মাণ সহায়তা দেওয়া।

মানবাধিকারের মূলধারা: সংস্থাটি জাতিসংঘের সমস্ত কর্মসূচিতে মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করে, যাতে শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার–জাতিসংঘের তিনটি স্তম্ভ–একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং পারস্পরিকভাবে শক্তিশালী হয়।

ওএইচসিএইচআরের সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এ ছাড়া নিউইয়র্ক কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয়, দেশীয় কার্যালয় এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনে মানবাধিকার শাখাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি বজায় রাখে জাতিসংঘের এই মানবাধিকার সংস্থা।

নিউইয়র্ক কার্যালয় জাতিসংঘের সদর দপ্তরে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অপারেশনাল কার্যক্রমে মানবাধিকারের নিয়মাবলি কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করে।

আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো বৃহত্তর অঞ্চলগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখে। এর মধ্যে রয়েছে—পূর্ব আফ্রিকা (আদ্দিস আবাবা), দক্ষিণ আফ্রিকা (প্রিটোরিয়া), পশ্চিম আফ্রিকা (ডাকার), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ব্যাংকক), প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (সুভা), মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (বৈরুত), মধ্য এশিয়া (বিশকেক), ইউরোপ (ব্রাসেলস), মধ্য আমেরিকা (পানামা সিটি), দক্ষিণ আমেরিকা (সান্তিয়াগো দে চিলি)।

দেশীয় এবং স্বতন্ত্র কার্যালয় রয়েছে প্রায় ১৮টি (বাড়ে কমে)। এই কার্যালয়গুলো স্বাগতিক সরকারগুলোর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সাধারণত মানবাধিকার সুরক্ষা, প্রচার, পর্যবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের ম্যান্ডেট থাকে। দেশীয় কার্যালয় রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে: বুর্কিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সুদান, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে।

বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ বা সংঘাত-পরবর্তী অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অন্তর্ভুক্ত মানবাধিকার কর্মকর্তাদেরও সহায়তা করে এই সংস্থা। যেমন—আফগানিস্তান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, হাইতি, ইরাক, কোসোভো, লিবিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান—এসব দেশে শাখাগুলো সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করে।

এই বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওএইচসিএইচআর সরাসরি সরকার, নাগরিক সমাজ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে মাঠপর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপন ও নানামুখি আপত্তি

ঢাকায় কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার মধ্যে সম্প্রতি তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের আপত্তির প্রধান কারণ হলো, অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকারের নামে ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। তারা মনে করে, এই ধরনের কার্যালয় স্থাপন করলে তা সার্বভৌমত্ব ও ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে। বিশেষ করে এলজিবিটি অধিকারের ইস্যুটি বারবার সামনে এসেছে।

বিশেষ করে, হেফাজতে ইসলাম সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, অতীতেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকারের অজুহাতে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। তাই, তারা এই ধরনের কার্যালয় স্থাপনে রাজি নয়।

এ ছাড়া এনসিপির নেতা সারজিস আলমও আপত্তির কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাশক্তির অন্যায় আগ্রাসন, হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ওএইচসিএইচআর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়া এবং তাঁর ভাষায় পশ্চিমে দাবি অনুযায়ী, মুসলিমদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী তকমা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

সমালোচকেরা মনে করেন, এই ধরনের কার্যালয় স্থাপন করা হলে তা দেশের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

আপত্তির মূল কারণগুলোর মধ্যে—

কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন মনে করে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজ করতে পারে। তাদের আশঙ্কা, এই কার্যালয় দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকারের নামে বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করেছে, যা এই ক্ষেত্রেও হতে পারে বলে তারা মনে করে।

এসব উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যাসহ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এই কার্যালয় কোনো হস্তক্ষেপমূলক সংস্থা হবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, ‘ওএইচসিএইচআর মিশন কেবল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, যেমন—পূর্ববর্তী সরকারের সময় সংঘটিত অপরাধ—প্রতিরোধ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই কাজ করবে। এটি কোনো সামাজিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্ম হবে না, যা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর বাইরে যায়।’

এ ছাড়া, সরকারের পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার থাকবে এ চুক্তি থেকে সরে আসার, যদি মনে করে যে এই অংশীদারত্ব আর দেশের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

সরকার মনে করে, এই ধরনের একটি কার্যালয় আগের সরকারগুলোর সময় যদি থাকত, যখন বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গণহত্যার মতো অপরাধ দায়মুক্তির সঙ্গে সংঘটিত হতো, তাহলে হয়তো অনেক অপরাধের তদন্ত, নথিভুক্ত ও বিচার হতো।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাবিপ্রবিতে শাস্তি পাচ্ছেন ছাত্রলীগের ১০২ জন

ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কাও ঢাকায় এসিসির সভা বর্জন করল

এনসিপির নিবন্ধন: ২০০ ভোটারের শর্ত পূরণ হয়নি ২৫ উপজেলায়

গাড়ি কেনার টাকা না দেওয়ায় স্ত্রীকে মারধর, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে মামলা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢুকতে লাগবে আলাদা অনুমোদন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত