হুসাইন আহমদ, ঢাকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে ইরানের দূত আমির সাইদ ইরাভানি বলেছেন, ইরানের প্রতিরোধের সময়, প্রকৃতি এবং মাত্রা নির্ধারণ করবে সশস্ত্র বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চাপেই যুক্তরাষ্ট্র ‘অযথা ও ব্যয়বহুল’ যুদ্ধে জড়িয়েছে।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার জন্য ১৫ জুন প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, কিন্তু ইসরায়েল দুই দিন আগে হামলা চালিয়ে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবিলম্বে এই অন্যায় ও বিধ্বংসী হামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন আমির সাইদ। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পরিষদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হবে।
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর গত ১০ দিনে ইসরায়েলে ইরানি হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় জরুরি চিকিৎসা সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড অ্যাডম।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, এখন পর্যন্ত তারা ১,২১৩ জন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিয়েছে, যাদের মধ্যে ১৬ জনের অবস্থা গুরুতর। বাকিরা মাঝারি ও হালকা ধরনের শারীরিক আঘাত কিংবা মানসিক আঘাত (উদ্বেগ-আতঙ্ক) নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এদিকে, ইসরায়েল চালানো পাল্টা হামলায় ইরানে ইতোমধ্যে ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই হামলাগুলো তাদের নাগরিক স্থাপনা, হাসপাতাল ও শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি উত্তপ্ত, এবং দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত দ্রুত বন্ধে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো কূটনৈতিক অগ্রগতি দেখা যায়নি।
তেহরানে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিমান হামলার প্রতিবাদে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। দেশটির রাজধানীজুড়ে রোববার (২২ জুন) সকাল থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়, যার মূল স্লোগান ছিল— "আমেরিকার আগ্রাসনের জবাব চাই", "আমেরিকা নিপাত যাক", "ইসরায়েল ধ্বংস হোক"।
প্রতিবাদকারীদের হাতে ছিল ইরানি পতাকা, নিহতদের ছবি এবং ট্রাম্প ও ইসরায়েলি নেতাদের কুশপুতুল। অনেকে হাতে ধরে রেখেছিলেন ব্যানার যাতে লেখা ছিল:
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, “এই হামলা কেবল ইরানের নয়, সমস্ত মুসলিম বিশ্বের উপর আঘাত। আমেরিকা জানে না, ইরান কখনও মাথানত করে না।”
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিক্ষোভের লাইভ সম্প্রচার করে। অনেক জায়গায় ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থেকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রতিরোধে সক্রিয় থাকতে।
তেহরানের আজাদি স্কয়ার, ফার্দৌসি স্কয়ার, ইমাম হোমেইনি মসজিদের সামনে, এবং পার্লামেন্ট ভবনের সামনে ছিল প্রধান বিক্ষোভস্থল।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিক্ষোভগুলো শুধু সরকার সমর্থিত নয়—বিশেষ করে ইরানে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর হামলার পর সাধারণ জনগণের মধ্যেও জাতীয় ঐক্য ও ক্ষোভ উভয়ই দৃশ্যমান।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের “অপারেশন মিডনাইট হ্যামার” নামক সামরিক অভিযানে ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এর পরই দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। এটা এমন এক সময় ঘটল, যখন মাত্র এক দিন আগেই ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এই সংকটের একমাত্র সমাধান কূটনীতি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ইরানের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসনের কারণে উত্তেজনার অভূতপূর্ব এই বৃদ্ধি ও সহিংসতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আরও তীব্র হলে তা শুধু এই অঞ্চলই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এ বিষয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানকে ফোন করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
এই অবস্থান পাকিস্তানের জন্য একটি ‘অসঙ্গতিপূর্ণ কূটনৈতিক পরিস্থিতির’ জন্ম দিয়েছে। মাত্র একদিন আগে ইসলামাবাদ বলেছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তারা তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের কৌশলগত হিসাব এখন বড় এক পরীক্ষার সামনে, কারণ একদিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন চায়, অন্যদিকে প্রতিবেশী ও ধর্মীয়ভাবে ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সংহতি জানানোও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের অবস্থান আগামী দিনগুলোতে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর দেশটি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে—তা নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা নানা দিক বিশ্লেষণ করছেন।
জেনেভাভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সমসাময়িক যুদ্ধবিশেষজ্ঞ জঁ-মার্ক রিক্লি আল জাজিরাকে বলেন, ‘ইরানের সামনে এখন সব ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিকল্প খোলা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রাখতে হবে।’
‘তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা আছে, তবে মাঝারি ও দূর-পাল্লার ব্যবস্থা কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে,’ বলেন রিক্লি। ‘তবে তাদের স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এখনো কার্যকর আছে, যেগুলোর সাহায্যে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানা সম্ভব।’
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নৃশংস সামরিক আগ্রাসনের’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর এই হামলাকে তারা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের ‘গভীর ও নজিরবিহীন লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই জঘন্য আগ্রাসনের বিপজ্জনক পরিণতি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে দায়ী।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইরান নিজের ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও জনগণকে সব শক্তি ও উপায়ে রক্ষা করবে। পাশাপাশি তারা সতর্ক করে দেয়, এ ধরনের ‘নির্লজ্জ আগ্রাসনের মুখে’ নীরবতা বিশ্বকে এক নজিরবিহীন বিপদ ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি অধিবেশন আহ্বানের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার বিরুদ্ধে নিঃশর্ত নিন্দা জানানোর অনুরোধ জানায়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিকে ‘যুদ্ধবাদী পক্ষগুলোর পক্ষে পক্ষপাতিত্ব’ করার অভিযোগও করেছে ইরান।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই বিপর্যয়ের পথ প্রশস্ত করেছেন গ্রোসি। আমরা সংস্থাটিকে অবিলম্বে বৈঠক ডেকে তাদের আইনি দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আজকের পত্রিকার সরাসরি সম্প্রচারে স্বাগতম
মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিয়ে আজকের পত্রিকার সরাসরি সম্প্রচারে স্বাগতম। সংঘাতের দশম দিনে ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি ইরানে সামরিক অভিযানে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে মার্কিন এই আগ্রাসনে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা হয়েছে।
ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘বানোয়াট অজুহাতে যুদ্ধ শুরু’ করার অভিযোগ তুলেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক পর্যায়ে ইরানে ‘শাসন পরিবর্তনের’ ইঙ্গিত দিলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল দুই দেশই দাবি করেছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল কেবল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখা।
দিনভর সর্বশেষ আপডেট আপনারা জানতে পারবেন এই লাইভ পেজ থেকে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের গত ১০ দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ জানতে চাইলে আগের লাইভ পেজে ফিরে যেতে পারেন।