Ajker Patrika

নাম নিয়ে বারবার বিপাকে ‘চুতিয়া’ জনগোষ্ঠী

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭: ৫৮
Thumbnail image

এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি। যেমন বঙ্গদেশে ‘মাগি’ শব্দ নিয়ে একটা জটিলতা আছে। তেমনি ভুটানে মেয়েদের অতি সাধারণ নামটি শুনলে বাংলাভাষীদের লজ্জায় কান লাল হয়ে যাবে! এমন নাম নিয়েই বিপাকে পড়তে হয় আসামের এক জনগোষ্ঠীর মানুষদের।

২০০৪ সালে উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও নানামুখী চাপের মুখে পরবর্তীতে কঠোর কমিউনিটি গাইডলাইন করতে বাধ্য হয় ফেসবুক। তবে এ নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি! এই গাইডলাইনের আলোকে নানা সময় ফেসবুকের পদক্ষেপ কখনো ক্রোধ, ক্ষোভ আবার কখনো হাস্যরসের জন্ম দিয়ে চলেছে। ২০১২ সালের দিকে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল। এতে ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জনগোষ্ঠী বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। কারণ, নামের পদবির কারণে কমিউনিটি গাইডলাইনের দোহাই দিয়ে ফেসবুক তাঁদের অ্যাকাউন্ট বারবার বাতিল করছিল।

এমনকি ২০২০ সালে খোদ ভারতে ওই জনগোষ্ঠীর এক উচ্চশিক্ষিত নারী চাকরির আবেদন করতে গিয়ে নামের পদবির কারণে বিপাকে পড়েন। এ নিয়ে তখন ভারতজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। কারণ, ভারতেরই একটি জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এমন অজ্ঞ থাকতে পারে, সেটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় বলে মনে করেছেন সাধারণ নাগরিকরেরা। 

কী সেই পদবি, যার জন্য আসামের ওই জনগোষ্ঠীকে বারবার এমন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে? তাঁরা হলেন ‘চুতিয়া’। মূর্খ, নির্বোধ, বলদ...ইত্যাদি গালির বিকল্প হিসেবে ভারতে চুতিয়া শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয়। 

বিহু উৎসবে ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করছেন চুতিয়া নারীরা। ছবি: উইকিপিডিয়ামজার ব্যাপার হলো এই জনগোষ্ঠী এখন এসে এতটা অবহেলিত হলেও প্রায় পাঁচ শ বছর তাদের একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। অথচ ভারতে হিন্দিভাষীদের কাছে এটি এখন একটা গালি। এমনকি ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেম এটিকে আপত্তিকর শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে। 

চুতিয়া সম্প্রদায়ের অবস্থান
১৫১২-১৫২৪ সালের দিকে চুতিয়া এবং আসামিদের দ্বন্দ্ব শুরুর আগে তাদের একটি সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। ১৪ শতকের শুরু থেকে ১৫ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত চুতিয়া রাজাদের রাজত্ব ছিল। ১৪ শতক থেকে ১৫ শতকের শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রায় ১০ জন রাজার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন—নন্দীশ্বর, সত্যনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ, ধর্মনারায়ণ, দুর্লভ নারায়ণ, মুক্তধর্ম নারায়ণ, প্রত্যক্ষণ নারায়ণ, যশ নারায়ণ, পুরন্দর নারায়ণ ও ধীর নারায়ণ।

প্রায় ৫০০ বছরের স্বাধীন চুতিয়া রাজ্যের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে আশপাশের নানা জনজাতির সঙ্গে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করতে হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চুতিয়া রাজ্যের বিস্তার ছিল বর্তমান আসামের লক্ষীমপুর, ধেমাজি, তিনসুকিয়া ও ডিব্রুগড় জেলায়। 

তাঁদের বীরাঙ্গনার নাম সতী সাধনী। বহুদিন ধরেই চুতিয়া জাতি ডিব্রুগড়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত ভারতের সর্ববৃহৎ দোতলা সেতুর (বগীবিল সেতু) নামকরণ সতী সাধনী সেতু করার দাবি করে আসছেন। 

চুতিয়া রাজবংশের পতনের পর এই জনগোষ্ঠী বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন বনাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। সাংস্কৃতিক নানা দিক এবং জীবনাচারণের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে এখন অভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বর্তমানে তাঁদের মধ্যে প্রধান চারটি ভাগ দেখা যায়—হিন্দু চুতিয়া, অহম চুতিয়া, বোরাহি চুতিয়া ও মিরি চুতিয়া। 

তিনসুকিয়ার বোরগাঁওয়ে চুতিয়াদের ধর্ম হাসুরি পারফরমেন্স। ছবি: উইকিপিডিয়াঅন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো চুতিয়াদেরও আলাদা ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে। চুতিয়া ছেলেদের ঐতিহ্যবাহী পরিধেয় চুতিয়া পাগুরি, চুরিয়া বা চুরুলসা, গামুসা ও বিশুবান, তাঙ্গালি এবং ছেলেংশা বা ছেলেঙ্গ চাদর। 

চুতিয়া মেয়েদের পোশাক অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও রঙিন। উৎসবে ঝলমলে পোশাক আর দৈনন্দিন জীবনে তাঁরা পরেন সাদামাটা পোশাক। চুতিয়া মেয়েরা মূলত মেখেলা বা ইগু, রিহা বা রিশা, গাথিগি, দুকোতিয়া, চাদর ও কোকালমোরা, হাসোতি ও দাবুয়া কাতারি এবং হারুদাই জাপি পরে থাকেন। 

বর্তমানে চুতিয়ারা বাস করেন মধ্য আসাম ও অরুণাচলের কাছাকাছি উত্তর আসামে। ডিব্রুগড়, শোণিতপুর, জোড়হাট, সাদিয়া ও তিনশুকিয়াতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ চুতিয়ার বাস।

চুতিয়া জনজাতির ইতিহাস
আসামের ‘অসমিয়া ক্রনিকল’-এ চুতিয়া জাতির ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, এই সম্প্রদায়ের নাম চুতিয়া রাজা অসম্ভিনার নামে রাখা হয়েছিল। তিনি সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাস করতেন। সেই সময়ে চুতিয়া রাজবংশের লোকেরা বর্তমান ভারতের আসাম ও অরুণাচল প্রদেশে সাম্রাজ্য গঠন করেছিল। ১১৮৭ থেকে ১৬৭৩ সাল পর্যন্ত সেখানে রাজত্ব করেছিল। 

এই সম্প্রদায়ের লোকদের দেহের গঠন পূর্ব এশীয় এবং ইন্দো-আরিয়ানের মিশ্র রূপ। আসামে বসবাসকারী এই গোষ্ঠী দক্ষিণ চীন (বর্তমান তিব্বত ও সিচুয়ান) থেকে আসা প্রথম জনগোষ্ঠী বলে ধারণা করা হয়। 

চুতিয়াদের রাজত্ব ছিল লক্ষীমপুর ও সুবানসিরী নদীর পেছনের দিকের অংশে। তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের উত্তর প্রান্ত থেকে সমগ্র জাতিকে শাসন করতেন। এর আগে তাঁরা তিব্বতি-বর্মণ উৎসের একটি ভাষায় কথা বলতেন। তবে ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে অসমিয়া ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন।

ভারত সরকারের নথিতে চুতিয়া
চুতিয়া সম্প্রদায়কে সরকার ওবিসি বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিতে রাখে। মূলত অসমিয়া ভাষা বলার লোক হিসেবে তাঁরা বিবেচিত হন। 

অসমীয় সংস্কৃতির প্রতীক (ওপর থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে): জাপি, বিহু নাচ, সারাই, বিহু ঢোল এবং গামোসা। ছবি: আজকের পত্রিকাগবেষণায় চুতিয়া
বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, ডব্লিউবি ব্রাউন এবং পবনচন্দ্র সাইকিয়া তাঁদের বইয়ে লিখেছেন চু-তি-য়া মূলত ‘দেওরি চুতিয়া’ শব্দবন্ধটি থেকে এসেছে। এর অর্থ খাঁটি জলের কাছাকাছি বাস করা মানুষ। এখানে ‘চু’ অর্থ খাঁটি, শুদ্ধ বা ভালো। ‘তি’ অর্থ পানি এবং ‘য়া’-এর অর্থ ওই ভূমিতে বাস করা লোক। 

আরএম নাথ ‘ব্যাকগ্রাউন্ড অব আসামিজ কালচার’ বইয়ের পটভূমিতে দাবি করেছেন, এখানকার ভাষায় পর্বতশৃঙ্গ (যাকে এখানে চুত বলা হয়) থেকে চুতিয়া শব্দের উত্‍পত্তি। উচ্চ আসামের সমভূমিতে আসার আগে এই লোকেরা পাহাড়ে বাস করতেন। এই সম্প্রদায়ের অনেকগুলো লোকসংগীত রয়েছে, যার মাধ্যমে তাঁরা বলেন যে, তাঁরা ভূমিক্কা এবং সুবাহু চুতনের বংশধর। 

চুতিয়াদের ধর্ম
চুতিয়ারা এক আদি পুরুষ দেবতা এবং এক দেবীর উপাসনা করেন। দেবতার নাম কুন্ডিমামা, বালিয়া বাবা অথবা পিশা ডেমা নামেও ডাকেন তাঁরা। কাছারিদের কাছে আবার এই দেবতা বাথাউ বা বাথাউ ব্রাই। আর দেবীকে ডাকা হয় কেচাইখাতি বা পিশাচী-সাই নামে। এ ছাড়া অন্যান্য বড়ো-কাছারি গোষ্ঠীর মধ্যে উপজাতীয় দেবী খেসাই খাইতির উপাসনা দেখা যায়। 

অবশ্য চুতিয়াদের অনেকে কালীর বিভিন্ন অবতারের পূজা করেন। আজকাল এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ লোকই একসারনা ধর্মের অনুসারী, যা ১৫ শতাব্দীতে আসামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে চুতিয়া সম্প্রদায়ের প্রচুর লোক হিন্দু ধর্মও অনুসরণ করে। এরা অনেক ছোট ছোট সম্প্রদায়েও বিভক্ত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত