ফজলুল কবির
দেশের অর্থনীতি নিয়ে কতশত দুশ্চিন্তার কথা শোনা যায়। রাজনীতি নিয়েও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার পর বোঝা গেল রাজনীতি ও নির্বাচনী উত্তাপ ছড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরসহ হাজারটা ইস্যু। কিন্তু এতসব কিছু থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে দেখা গেল নারীর পোশাক নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়তে। প্রশ্ন হলো—এই সময়ে হঠাৎ করে নারীর পোশাক নিয়ে এত হল্লা কেন?
প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক, নারীর পোশাক নিয়ে আদতেই হল্লা হচ্ছে কি না। বিষয়টি বুঝতে হলে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার দিকে তাকাতে হবে। টিপ-কাণ্ডের কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এর পরপরই ঘটেছে নরসিংদীর রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে এক তরুণীর হেনস্তা হওয়া এবং তা আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ঘটনা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে নারীর পোশাক নিয়ে যে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীরা দাঁড়ালেন, তা মূলত নরসিংদীর ঘটনায় আদালতের বলা কথার জেরেই। আর এই অবস্থানের পাল্টা হিসেবে কয়েক দিনের মাথায় রাজু ভাস্কর্যেই আবার জড়ো হলেন আরেক দল ঢাবি শিক্ষার্থী, যাঁরা সব ধরনের পোশাক, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরই বহমানতা চান এবং এটি নারী প্রশ্নেই।
এই প্রতিটি ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এই আলোচনায় নারীর পোশাক ঠিক করে দেওয়ার বিষয়ে একটি বড় অংশকেই একমত হতে দেখা গেল, যেখানে রয়েছে শিক্ষা-শ্রেণি ইত্যাদি বিচারে সমাজের নানা স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। আজকের পত্রিকায় দ্বিতীয় অবস্থান, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি ভিডিও শেয়ার হওয়ার পর তার নিচের কমেন্টসগুলো ভীষণ রকম ভাবনার উদ্রেক করে। সেখানে প্রায় সবাইকে ওই শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তার পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। খেয়াল করুন—সেখানে কিন্তু ছেলে শিক্ষার্থীও ছিলেন। কিন্তু তা নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। বেছে বেছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়ার নানা উপায় নিয়ে তাঁদের আলোচনায় মশগুল হতে দেখা গেল। দুয়েকজন যাঁরা এ ধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন, তাঁদের দিকেও ছুটে গেল ব্যক্তিগত আক্রমণ।
এদিকে এই একই প্রশ্নে চিরচেনা নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মুখপাত্রদের কাছ থেকে এল নারীর পোশাক বাছাইয়ের স্বাধীনতা এবং তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মতো বক্তব্য। তাঁরা বিবৃতি দিলেন। পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, টিভি চ্যানেলগুলো তা প্রচারও করল। কিন্তু তাতে কারও কিছু এল-গেল না। কেন? সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুটি অংশের অবস্থানের দিকে একটু তাকানো যাক।
একদল বলছে, ‘ছোট পোশাক পরলেই নারী বিজ্ঞানী হয় না।’ অন্যদল বলছে, ‘বৈচিত্র্যই সাধারণ, বৈচিত্র্যই বাংলাদেশ।’ প্রথম দলে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের পরিধেয়র মধ্যেও কিন্তু বৈচিত্র্য ছিল। সেখানে থাকা ছেলেদের কেউ টি-শার্ট, কেউ পাঞ্জাবি পরেছেন, কেউ পাজামা তো কেউ প্যান্ট পরেছেন। মেয়েদের কেউ বোরকা পরেছেন তো কেউ সালোয়ার-কামিজ পরে মাথা ঢেকেছেন হিজাবে। বৈচিত্র্য সেখানে ছিল। তাঁরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা ধ্বংস নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অথচ একজনও শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি পরেননি। অন্যদিকে যাঁরা বৈচিত্র্যের দাবি নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশেই হাজির হয়েছেন, তাঁরাও একেকজন একেকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করলেও সেখানে লুঙ্গি বা ধুতি পরিহিত কোনো তরুণকে অন্তত দেখা গেল না। মেয়েদের পোশাকে বৈচিত্র্য ছিল মানতে হবে।
তার মানে উভয় পক্ষই আদতে বিতর্কের কেন্দ্রে নারীর পোশাককেই হাজির করেছে। নমুনা হিসেবে একদল হাজির করেছে বোরকা ও হিজাব। অন্যদল নমুনা হিসেবে সম্ভাব্য সব ধরনের পোশাককে হাজির করার চেষ্টা করেছে। উভয় পক্ষের কাছেই পুরুষের পোশাক কোনো গুরুত্ব পায়নি। দাবি যা-ই হোক, প্রবণতা বলে দিচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষই যেন নির্ধারক। কারণ, দুই দলের পুরুষেরাই নিজেদের উপস্থাপনের কৌশল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি রক্ষার নামে তার বোঝা বহনের কাজটি নারীর ঘাড়েই পড়ে; পুরুষ ঠিক করবে যে সে নারীর চর্চায় বাধা দেবে, নাকি সঙ্গ দেবে।
এই দুটি ঘটনা কিন্তু ঘটিয়েছেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই। উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট। এই দুই ঘটনা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঘটে শেষ হয়ে যায়নি। দুটি ঘটনারই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। এবং দুটি ভিডিওর নিচেই অজস্র কমেন্ট পড়েছে, যেখানে নারীর পোশাক নির্ধারণের পক্ষেই বেশি মত পড়তে দেখা গেছে। এখানে আবার সেই পুরোনো প্রশ্নটি সামনে এল—নারী ও মানবাধিকার রক্ষায় চার-পাঁচ দশক ধরে কাজ করে যাওয়া সংস্থাগুলো তবে কী করল এত দিন। বৈচিত্র্য প্রশ্নটিরই যদি মীমাংসা না হয়, তবে এত দিনের কাজের খতিয়ান তাঁরা কীভাবে দেবেন।
এসব সংস্থায় অনেক মান্যবর রয়েছেন। তাঁদের নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখা যায়। তাঁরা শুধু নারী-পুরুষ নয়, সব নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বলেন। বেশ সোচ্চারেই বলেন। যেকোনো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের স্বাক্ষরসমেত প্রতিবাদলিপি বা বিবৃতি আসে। সেগুলো পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে প্রচারও হয়। প্রতিবছর হচ্ছে, দিনের পর দিন হচ্ছে। কিন্তু নারীকে সুনির্দিষ্ট পোশাকের ভেতরে বন্দী করার পক্ষে জনমত বাড়ছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত!
বিস্ময়চিহ্নটি অভ্যাসবশত দেওয়া। কিন্তু সত্যিই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, এই সংগঠনগুলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, লৈঙ্গিক সাম্য ইত্যাদি নিয়ে শুধু অভিজাত নাগরিক পরিসরেই তাদের বক্তব্য দিয়ে গেছে। বিভিন্ন ঘটনায় তারা বিবৃতি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু তা-ও ওই অভ্যাসবশত। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে, বিপুল বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে এ নিয়ে তেমন কোনো কাজ তারা করেনি, যাতে ব্যক্তির পোশাকের অধিকার প্রশ্নে একটা ঐকমত্য অন্তত হতে পারে। এসব সংগঠনের বিস্তৃতি ও কর্মকাণ্ড মূলত তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং আছে। এরই ফল হচ্ছে তারা এমনকি এমন মৌলিক একটি প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও এক মঞ্চে আনতে পারেনি। অ্যাকটিভিজমের নামে তারা শুধু জনবিচ্ছিন্নই হয়েছে। আর এর মাধ্যমে তারা নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের মতো গুরুতর একটি বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে দূরবর্তী একটি প্রসঙ্গে পরিণত করেছে।
দেশের অর্থনীতি, উৎপাদনব্যবস্থা, শ্রম ও শ্রমকেন্দ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অপরাধ ও এর ধরন, আর্থিক বিষয়াদি, প্রবাসী শ্রম, রেমিট্যান্স, ব্যাংক-বিমা, রাজনীতি, নারী অধিকার, তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার,///// নিরাপদ সড়ক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করে একেকটি সংস্থা গড়ে উঠেছে। তারা নিজের বা পরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে; অবশ্য বনে না গিয়েই। যেন এই প্রতিটি ক্ষেত্র আসলেই আলাদা, যেন এদের কারও সঙ্গে কারও কোনো সম্বন্ধ নেই। এদিকে অন্য পক্ষটি এই সবগুলোকে এক করে দেখে একের পর এক ইশতেহার দিয়ে গেছে নানাভাবে, নানা পন্থায়। আর প্রতিটি ইশতেহারের বিপরীতে অধিকার সংস্থাগুলো একের পর এক বিবৃতি প্রসব করেছে, শহুরে অ্যাকটিভিজম করেছে। আর এই বিবৃতি ও অ্যাকটিভিজমের মাধ্যমে তারা আবার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ‘অপর’-ই করে তুলেছে সংযুক্ত না করার মধ্য দিয়ে। যেহেতু দীর্ঘ অনভ্যাসে তারা বনে ঢুকতেই ভুলে গেছে, এমনকি হয়তো ভয়ও পায়। এরই ফল হচ্ছে নারীর পোশাক নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে এত বিপুলসংখ্যকের অবস্থান। রাষ্ট্র এখানে বিচারকের আসনে বসে হাঙ্গামা দেখতে থাকা পাড়ার পান্ডার ভূমিকায়, শেষ দৃশ্যে যে মারখানেঅলা ও মারদেনেঅলা উভয়ের পিঠেই হাত বুলিয়ে মীমাংসা করে দেবে।
সংস্থাগুলো এসবকে রাষ্ট্রের ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠার ইঙ্গিতবাহীও বলতে পারে। হ্যাঁ, রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদের দিকে এগোয়, ততই এর ভেতরটা ফাঁপা হতে থাকে। একসময় নিজেই ভুলে যায় যে সে নিজে কিসের কর্তা এবং কার ওপর কর্তৃত্ব করবে। ফলে সে তখন উদ্ভ্রান্ত রাখালের মতো সবকিছুকেই তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। যাবতীয় নিয়মকে উল্টে দিতে থাকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যেতে থাকে সাধারণ মানুষের আচার ও ভাবনাজগৎ। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপনা মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে তাকেও একই মতবাদে আসক্ত করে ফেলে। বাংলাদেশে এর প্রতিটি লক্ষণ এখন স্পষ্ট।
অধিকার সংস্থাগুলো এ-ও বলতে পারে, ‘মাঠে কাজ করার কথা সরকারের, রাষ্ট্রের। আমরা তো চাপ প্রয়োগের কাজটি করব।’ কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে চাপ প্রয়োগের জন্য বল প্রয়োজন। পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে গোড়ার কথা এটি। ওজন যদি বেশি না হয়, তবে কারও ওপর চড়ে বসলেও সে চাপ অনুভব না-ও করতে পারে। সোজা কথায়, বাগ্বিতণ্ডা বা আলাপ চলে শক্তিতে শক্তিতে। দুই শক্তির মধ্যে একটি রাষ্ট্র নিজে। সে সব সময় প্রতিপক্ষ চায়। চাপ প্রয়োগকারী হোক বা অন্য কেউ, নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্যই তার প্রতিপক্ষ প্রয়োজন। উদারবাদী সংস্থাগুলো নিজেকে কাঠামোর ভেতরে বিলীন হতে দিয়ে এই শক্তির সমীকরণ থেকে ছিটকে পড়েছে বলতে হবে। সে জায়গা নিয়ে নিয়েছে অন্য কেউ। তারা এখন প্রতিপক্ষের অবস্থানে নিজেদের ভিত পোক্ত করছে। এটা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। এ কারণেই তারা সেই শক্তির পেছনে সমবেত হচ্ছে বুঝে কিংবা না বুঝে। এখানে কাঁদুনি গেয়ে কোনো লাভ নেই। শহুরে অ্যাকটিভিজম দিয়েও কোনো লাভ নেই। বনের মোষ তাড়াতে হলে বনেই ঢুকতে হবে। রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত সত্যিই মোষ তাড়িয়ে আসা পক্ষটির সঙ্গেই আলাপ করবে, তর্ক করবে। কোনো ধোপদুরস্ত ফ্যাশনেবল মোষ-তাড়ানো পক্ষের সঙ্গে নয়। রাষ্ট্রের উদারবাদী অংশ এটি যত দ্রুত বুঝবে, ততই মঙ্গল।
ফজলুল কবির,সহাকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দেশের অর্থনীতি নিয়ে কতশত দুশ্চিন্তার কথা শোনা যায়। রাজনীতি নিয়েও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার পর বোঝা গেল রাজনীতি ও নির্বাচনী উত্তাপ ছড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরসহ হাজারটা ইস্যু। কিন্তু এতসব কিছু থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে দেখা গেল নারীর পোশাক নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়তে। প্রশ্ন হলো—এই সময়ে হঠাৎ করে নারীর পোশাক নিয়ে এত হল্লা কেন?
প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক, নারীর পোশাক নিয়ে আদতেই হল্লা হচ্ছে কি না। বিষয়টি বুঝতে হলে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার দিকে তাকাতে হবে। টিপ-কাণ্ডের কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এর পরপরই ঘটেছে নরসিংদীর রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে এক তরুণীর হেনস্তা হওয়া এবং তা আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ঘটনা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে নারীর পোশাক নিয়ে যে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শিক্ষার্থীরা দাঁড়ালেন, তা মূলত নরসিংদীর ঘটনায় আদালতের বলা কথার জেরেই। আর এই অবস্থানের পাল্টা হিসেবে কয়েক দিনের মাথায় রাজু ভাস্কর্যেই আবার জড়ো হলেন আরেক দল ঢাবি শিক্ষার্থী, যাঁরা সব ধরনের পোশাক, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরই বহমানতা চান এবং এটি নারী প্রশ্নেই।
এই প্রতিটি ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এই আলোচনায় নারীর পোশাক ঠিক করে দেওয়ার বিষয়ে একটি বড় অংশকেই একমত হতে দেখা গেল, যেখানে রয়েছে শিক্ষা-শ্রেণি ইত্যাদি বিচারে সমাজের নানা স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। আজকের পত্রিকায় দ্বিতীয় অবস্থান, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি ভিডিও শেয়ার হওয়ার পর তার নিচের কমেন্টসগুলো ভীষণ রকম ভাবনার উদ্রেক করে। সেখানে প্রায় সবাইকে ওই শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তার পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়। খেয়াল করুন—সেখানে কিন্তু ছেলে শিক্ষার্থীও ছিলেন। কিন্তু তা নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। বেছে বেছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়ার নানা উপায় নিয়ে তাঁদের আলোচনায় মশগুল হতে দেখা গেল। দুয়েকজন যাঁরা এ ধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন, তাঁদের দিকেও ছুটে গেল ব্যক্তিগত আক্রমণ।
এদিকে এই একই প্রশ্নে চিরচেনা নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মুখপাত্রদের কাছ থেকে এল নারীর পোশাক বাছাইয়ের স্বাধীনতা এবং তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মতো বক্তব্য। তাঁরা বিবৃতি দিলেন। পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, টিভি চ্যানেলগুলো তা প্রচারও করল। কিন্তু তাতে কারও কিছু এল-গেল না। কেন? সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুটি অংশের অবস্থানের দিকে একটু তাকানো যাক।
একদল বলছে, ‘ছোট পোশাক পরলেই নারী বিজ্ঞানী হয় না।’ অন্যদল বলছে, ‘বৈচিত্র্যই সাধারণ, বৈচিত্র্যই বাংলাদেশ।’ প্রথম দলে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের পরিধেয়র মধ্যেও কিন্তু বৈচিত্র্য ছিল। সেখানে থাকা ছেলেদের কেউ টি-শার্ট, কেউ পাঞ্জাবি পরেছেন, কেউ পাজামা তো কেউ প্যান্ট পরেছেন। মেয়েদের কেউ বোরকা পরেছেন তো কেউ সালোয়ার-কামিজ পরে মাথা ঢেকেছেন হিজাবে। বৈচিত্র্য সেখানে ছিল। তাঁরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা ধ্বংস নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অথচ একজনও শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি পরেননি। অন্যদিকে যাঁরা বৈচিত্র্যের দাবি নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশেই হাজির হয়েছেন, তাঁরাও একেকজন একেকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করলেও সেখানে লুঙ্গি বা ধুতি পরিহিত কোনো তরুণকে অন্তত দেখা গেল না। মেয়েদের পোশাকে বৈচিত্র্য ছিল মানতে হবে।
তার মানে উভয় পক্ষই আদতে বিতর্কের কেন্দ্রে নারীর পোশাককেই হাজির করেছে। নমুনা হিসেবে একদল হাজির করেছে বোরকা ও হিজাব। অন্যদল নমুনা হিসেবে সম্ভাব্য সব ধরনের পোশাককে হাজির করার চেষ্টা করেছে। উভয় পক্ষের কাছেই পুরুষের পোশাক কোনো গুরুত্ব পায়নি। দাবি যা-ই হোক, প্রবণতা বলে দিচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষই যেন নির্ধারক। কারণ, দুই দলের পুরুষেরাই নিজেদের উপস্থাপনের কৌশল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি রক্ষার নামে তার বোঝা বহনের কাজটি নারীর ঘাড়েই পড়ে; পুরুষ ঠিক করবে যে সে নারীর চর্চায় বাধা দেবে, নাকি সঙ্গ দেবে।
এই দুটি ঘটনা কিন্তু ঘটিয়েছেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই। উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট। এই দুই ঘটনা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঘটে শেষ হয়ে যায়নি। দুটি ঘটনারই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। এবং দুটি ভিডিওর নিচেই অজস্র কমেন্ট পড়েছে, যেখানে নারীর পোশাক নির্ধারণের পক্ষেই বেশি মত পড়তে দেখা গেছে। এখানে আবার সেই পুরোনো প্রশ্নটি সামনে এল—নারী ও মানবাধিকার রক্ষায় চার-পাঁচ দশক ধরে কাজ করে যাওয়া সংস্থাগুলো তবে কী করল এত দিন। বৈচিত্র্য প্রশ্নটিরই যদি মীমাংসা না হয়, তবে এত দিনের কাজের খতিয়ান তাঁরা কীভাবে দেবেন।
এসব সংস্থায় অনেক মান্যবর রয়েছেন। তাঁদের নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখা যায়। তাঁরা শুধু নারী-পুরুষ নয়, সব নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বলেন। বেশ সোচ্চারেই বলেন। যেকোনো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের স্বাক্ষরসমেত প্রতিবাদলিপি বা বিবৃতি আসে। সেগুলো পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে প্রচারও হয়। প্রতিবছর হচ্ছে, দিনের পর দিন হচ্ছে। কিন্তু নারীকে সুনির্দিষ্ট পোশাকের ভেতরে বন্দী করার পক্ষে জনমত বাড়ছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত!
বিস্ময়চিহ্নটি অভ্যাসবশত দেওয়া। কিন্তু সত্যিই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, এই সংগঠনগুলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার, লৈঙ্গিক সাম্য ইত্যাদি নিয়ে শুধু অভিজাত নাগরিক পরিসরেই তাদের বক্তব্য দিয়ে গেছে। বিভিন্ন ঘটনায় তারা বিবৃতি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু তা-ও ওই অভ্যাসবশত। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে, বিপুল বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে এ নিয়ে তেমন কোনো কাজ তারা করেনি, যাতে ব্যক্তির পোশাকের অধিকার প্রশ্নে একটা ঐকমত্য অন্তত হতে পারে। এসব সংগঠনের বিস্তৃতি ও কর্মকাণ্ড মূলত তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং আছে। এরই ফল হচ্ছে তারা এমনকি এমন মৌলিক একটি প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও এক মঞ্চে আনতে পারেনি। অ্যাকটিভিজমের নামে তারা শুধু জনবিচ্ছিন্নই হয়েছে। আর এর মাধ্যমে তারা নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের মতো গুরুতর একটি বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে দূরবর্তী একটি প্রসঙ্গে পরিণত করেছে।
দেশের অর্থনীতি, উৎপাদনব্যবস্থা, শ্রম ও শ্রমকেন্দ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অপরাধ ও এর ধরন, আর্থিক বিষয়াদি, প্রবাসী শ্রম, রেমিট্যান্স, ব্যাংক-বিমা, রাজনীতি, নারী অধিকার, তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার,///// নিরাপদ সড়ক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করে একেকটি সংস্থা গড়ে উঠেছে। তারা নিজের বা পরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে; অবশ্য বনে না গিয়েই। যেন এই প্রতিটি ক্ষেত্র আসলেই আলাদা, যেন এদের কারও সঙ্গে কারও কোনো সম্বন্ধ নেই। এদিকে অন্য পক্ষটি এই সবগুলোকে এক করে দেখে একের পর এক ইশতেহার দিয়ে গেছে নানাভাবে, নানা পন্থায়। আর প্রতিটি ইশতেহারের বিপরীতে অধিকার সংস্থাগুলো একের পর এক বিবৃতি প্রসব করেছে, শহুরে অ্যাকটিভিজম করেছে। আর এই বিবৃতি ও অ্যাকটিভিজমের মাধ্যমে তারা আবার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ‘অপর’-ই করে তুলেছে সংযুক্ত না করার মধ্য দিয়ে। যেহেতু দীর্ঘ অনভ্যাসে তারা বনে ঢুকতেই ভুলে গেছে, এমনকি হয়তো ভয়ও পায়। এরই ফল হচ্ছে নারীর পোশাক নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে এত বিপুলসংখ্যকের অবস্থান। রাষ্ট্র এখানে বিচারকের আসনে বসে হাঙ্গামা দেখতে থাকা পাড়ার পান্ডার ভূমিকায়, শেষ দৃশ্যে যে মারখানেঅলা ও মারদেনেঅলা উভয়ের পিঠেই হাত বুলিয়ে মীমাংসা করে দেবে।
সংস্থাগুলো এসবকে রাষ্ট্রের ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠার ইঙ্গিতবাহীও বলতে পারে। হ্যাঁ, রাষ্ট্র যত কর্তৃত্ববাদের দিকে এগোয়, ততই এর ভেতরটা ফাঁপা হতে থাকে। একসময় নিজেই ভুলে যায় যে সে নিজে কিসের কর্তা এবং কার ওপর কর্তৃত্ব করবে। ফলে সে তখন উদ্ভ্রান্ত রাখালের মতো সবকিছুকেই তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। যাবতীয় নিয়মকে উল্টে দিতে থাকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যেতে থাকে সাধারণ মানুষের আচার ও ভাবনাজগৎ। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপনা মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে তাকেও একই মতবাদে আসক্ত করে ফেলে। বাংলাদেশে এর প্রতিটি লক্ষণ এখন স্পষ্ট।
অধিকার সংস্থাগুলো এ-ও বলতে পারে, ‘মাঠে কাজ করার কথা সরকারের, রাষ্ট্রের। আমরা তো চাপ প্রয়োগের কাজটি করব।’ কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে চাপ প্রয়োগের জন্য বল প্রয়োজন। পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে গোড়ার কথা এটি। ওজন যদি বেশি না হয়, তবে কারও ওপর চড়ে বসলেও সে চাপ অনুভব না-ও করতে পারে। সোজা কথায়, বাগ্বিতণ্ডা বা আলাপ চলে শক্তিতে শক্তিতে। দুই শক্তির মধ্যে একটি রাষ্ট্র নিজে। সে সব সময় প্রতিপক্ষ চায়। চাপ প্রয়োগকারী হোক বা অন্য কেউ, নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্যই তার প্রতিপক্ষ প্রয়োজন। উদারবাদী সংস্থাগুলো নিজেকে কাঠামোর ভেতরে বিলীন হতে দিয়ে এই শক্তির সমীকরণ থেকে ছিটকে পড়েছে বলতে হবে। সে জায়গা নিয়ে নিয়েছে অন্য কেউ। তারা এখন প্রতিপক্ষের অবস্থানে নিজেদের ভিত পোক্ত করছে। এটা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। এ কারণেই তারা সেই শক্তির পেছনে সমবেত হচ্ছে বুঝে কিংবা না বুঝে। এখানে কাঁদুনি গেয়ে কোনো লাভ নেই। শহুরে অ্যাকটিভিজম দিয়েও কোনো লাভ নেই। বনের মোষ তাড়াতে হলে বনেই ঢুকতে হবে। রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত সত্যিই মোষ তাড়িয়ে আসা পক্ষটির সঙ্গেই আলাপ করবে, তর্ক করবে। কোনো ধোপদুরস্ত ফ্যাশনেবল মোষ-তাড়ানো পক্ষের সঙ্গে নয়। রাষ্ট্রের উদারবাদী অংশ এটি যত দ্রুত বুঝবে, ততই মঙ্গল।
ফজলুল কবির,সহাকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
৮ দিন আগেবিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪