Ajker Patrika

ধর্ষণকাণ্ডে ছাত্রলীগের নাম কেন বারবার আসে

একেএম শামসুদ্দিন
Thumbnail image

ফেব্রুয়ারি ও মার্চ বাঙালির ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল দুটো মাস। এ দুই মাসে বাংলাদেশের জনগণ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগী শহীদদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের বীরত্বগাথা নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন থাকে। এ সময় গান, কবিতা পাঠসহ নানাবিধ বর্ণিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, একাত্তরের মার্চে এসে সেই সংগ্রাম স্বাধীনতাযুদ্ধে রূপ নেয়।

এই দীর্ঘ সংগ্রামে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে, এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত উল্লিখিত সবার মধ্যে যে ছাত্রসংগঠনটি সবচেয়ে বেশি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে বলে ধরা হয়, সেই সংগঠনের নাম ‘ছাত্রলীগ’। শুধু ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধ নয়, স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ সংগঠনটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এই সংগঠন করেই এ দেশের অনেকেই জাতীয় পর্যায়ের স্বনামধন্য নেতা হয়েছেন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। একই বছরের ২ মার্চ তৎকালীন ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সেই সভায় বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, অজিত গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত, আবুল কাসেমসহ আরও অনেকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফন্ট্র নির্বাচনে ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।

১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবির আন্দোলন বেগবান করতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৬৯ সালে বাঙালি ছাত্রসমাজ যে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যা পরে ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, সেই আন্দোলনেও ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের জেলা ও থানা পর্যায়ে যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, তাতে ছাত্রলীগ নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। পরে এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরাই স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রলীগের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা রেখেছে, তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অনাহূত কর্মকাণ্ড অতীতের সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। ক্ষমতার এই কয়েক বছরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বে মারামারি-খুনোখুনি, নারী ধর্ষণ থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই, যাতে এই সংগঠনের সদস্যরা জড়িত ছিলেন না।

ছাত্রলীগের কর্মীদের ধারাবাহিক এসব কুকর্মের সর্বশেষ সংযোজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ। এই কুকর্মটিও তাঁরা করেছেন ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়।

ধর্ষণ ঘটনায় অন্যান্য অভিযুক্ত হলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র সাগর, সিদ্দিকী, হাসানুজ্জামান ও মুরাদ এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সাব্বির হাসান। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই তিন মূলনীতি নিয়ে গঠিত যে ছাত্রসংগঠন দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, এখন তারাই প্রতিনিয়ত নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষণের অভিযোগ থেকে যেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী বের হয়ে আসতে পারছেন না। ধর্ষণের ঘটনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই প্রথম নয়।

আলোড়ন সৃষ্টিকারী এমন ঘটনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতেও ঘটেছে। ১৯৯৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদ্‌যাপন করে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন। ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটে ছাত্রলীগের কর্মী সাইফুর রহমানসহ ৯ জনের দল স্বামীকে বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় তুলেছিল।

৩ ফেব্রুয়ারির ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে বিচার চেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। চার শতাধিক শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্যান্য ঘটনার মতো নিষ্ক্রিয় না থেকে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। অপরাধীদের ধরার বিষয়ে নিজেরা উদ্যোগী না হলেও পুলিশকে সহায়তা করেছে। অভিযুক্তদের সনদও স্থগিত করেছে। তবে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার রাতে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের আশ্রয়ে ছিলেন মোস্তাফিজুর। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে আশ্রয় দেওয়া হয়। সেখানে ভোর ৬ টা পর্যন্ত অবস্থান করেন মোস্তাফিজুর। সোহেলের নির্দেশেই নাকি মোস্তাফিজুরকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতা সাগর সিদ্দিকী।

পরিস্থিতি উত্তাল হতে শুরু করলে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী মোস্তাফিজুরকে ক্যাম্পাস থেকে সাভারে নিয়ে যান। অভিযোগ উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েবের। ফুটেজ গায়ের করার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও ওঠে আকতারুজ্জামান সোহেলের বিরুদ্ধে।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলের চাপে আত্মসমর্পণ করেন মোস্তাফিজুর। এবারের ধর্ষণের ঘটনায় আরও একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগ নেতা আটক করায় সোচ্চার সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ না করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরাও মোস্তাফিজুরের বিচার দাবি করে মানববন্ধন করেন। তাঁদের এই মানববন্ধন ও বিচার দাবি লোকদেখানো ছিল বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা মন্তব্য করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের এই ধর্ষক নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে থাকতেন। হলের এই কক্ষটিকে মোস্তাফিজুর ও তার সহযোগীরা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। ওই কক্ষে নিয়মিত মাদক সেবন চলত। মোস্তাফিজুরের হাত এত লম্বা ছিল যে তিনি এই টর্চার সেলে আশুলিয়া থানার এক পুলিশ কনস্টেবলকে আটকে রেখে ৫০ লাখ টাকাও দাবি করেন।

জানা গেছে, আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুরের সঙ্গে সমঝোতা করে কনস্টেবলকে ছাড়িয়ে নেন। সে সময় পুলিশ আটকের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত একটি খবর সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাটি সত্য হলে কর্তৃপক্ষের উচিত খবরের সূত্র ধরে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। মোস্তাফিজুর ও তাঁর সহযোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হলের সামনের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। তাঁদের অত্যাচারে হলের সাধারণ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দোকানমালিকেরা অতিষ্ঠ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগেও বছরজুড়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে ধর্ষণের মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি সংগঠনটির নেত্রীরাও এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। অতীতে সংগঠনটির নেত্রীদের ধর্ষণের অভিযোগে মামলার আসামিও হয়েছেন নেতারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীদের অভিমত, জাতীয় রাজনীতি দূষিত হয়ে পড়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়ানোর সাহস পাচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সংগঠনটিতে দিনে দিনে শুধু ধর্ষকের সংখ্যাই বাড়ছে।

অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন প্রশাসনের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। অপরদিকে ছাত্র সংসদও নেই। এখন শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চলছে। কাজেই তাঁরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থনও প্রয়োজন পড়ে না।

তা ছাড়া, ছাত্ররাজনীতি করেই অনেকে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছেন। কাজেই স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে তাঁদের বিবেকেও বাধে না। সাধারণ মানুষের ধারণা, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব যদি চান, তাহলে এসব বন্ধ করা কোনো কঠিন কাজ নয়। তাঁরা চাইলে যেকোনো মুহূর্তেই তা করতে পারেন। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্রসংগঠনের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে চাইলে এখনই তা করা উচিত।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত