Ajker Patrika

জওয়ান–এর পরতে পরতে রাজনৈতিক বার্তা, কণ্ঠে জনতার জয়গান

খায়রুল বাসার নির্ঝর, ঢাকা
আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ১৩
Thumbnail image

গল্প ততক্ষণে হাফটাইম পেরিয়ে এগোচ্ছে শেষের দিকে। একটি জেল অবরুদ্ধ করে রেখেছেন আজাদ (শাহরুখ খান)। তাঁকে ধরতে ছুটছে গোটা দেশের প্রশাসন। লাইভ ভিডিওতে এলেন আজাদরূপী শাহরুখ। আঙুল উঁচিয়ে দর্শকের চোখে চোখ রেখে বলে গেলেন, ‘দোকানে চাল–ডাল কিনতে গেলে কত দরদাম করেন! যে মশার কয়েল পাঁচ ঘণ্টা জ্বলে, সেটা কেনার সময়ও কত প্রশ্ন! অথচ পাঁচ বছরের জন্য কাউকে নির্বাচিত করার আগে কিছুই জানতে চান না। ভোট দেওয়ার আগে তাঁদের প্রশ্ন করুন, আমার জন্য কী করবেন? আমার সন্তানের শিক্ষার জন্য কী করবেন? আমি অসুস্থ হলে আমার পরিবারের জন্য কী করবেন?’ 

জওয়ানের গল্প এখানে এসে অন্য বাঁক নেয়। একটা পুরোদস্তুর মসলাদার বাণিজ্যিক সিনেমা এখানে এসে হয়ে ওঠে প্রচণ্ড রাজনৈতিক। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ সিনেমায় শাহরুখ বলেছিলেন, ‘ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব কমনম্যান’। জওয়ানেও তিনি ভরসা রাখলেন সেই ‘কমনম্যান’দের ওপর। সেই নিগৃহীত, বঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষ, যাঁরা নিজেদের শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত সচল রাখছেন দেশের অর্থনীতির চাকা, অথচ ক্ষমতার কাছে তাঁরা কেবলই ভোটার, কেবলই সংখ্যা; শাহরুখ তাঁদের মনে করিয়ে দিলেন—দেশের পট পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে তাঁদের হাতেই। তাঁদের একটি আঙুলের ছাপই সেই দিনবদলের হাতিয়ার। অতএব, ইভিএম কিংবা ব্যালটে আঙুল রাখার আগে প্রশ্ন তুলুন। যোগ্য ব্যক্তিকে বসান ক্ষমতায়, যারা সত্যিই সাধারণ মানুষের হয়ে কাজ করবে। এমন অনেক প্রসঙ্গ, যা সাধারণত এ উপমহাদেশে বাণিজ্যিক সিনেমার বিষয় হয়ে ওঠে না, সেগুলোই জওয়ানের মূল ভিত্তি। 

জওয়ান সিনেমার দৃশ্যের শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীতটুকরো টুকরো অনেক গল্প অথবা প্রশ্ন দেশপ্রেমের সুতোয় গেঁথে জওয়ান নামে একটি মালা গেঁথেছেন পরিচালক অ্যাটলি কুমার। আগে থেকে তিনি নিশ্চয় জানতেন, সাধারণ মানুষ যেসব বৈষম্য ও অবহেলার অভিশাপে দিনের পর দিন ধুঁকছে; সে সবের প্রতিবাদ একজনই করতে পারেন। একজনের কণ্ঠই পারে আপামর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে, তিনি শাহরুখ খান। হলোও তাই। গণতন্ত্রের আওয়াজ কতটা শক্তিশালী, নির্বিকার জনতাকে তাঁদের ভাষাতেই বুঝিয়ে দিলেন শাহরুখ। জওয়ানের প্রত্যেক মোচড়ে তাই তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনি তুললেন দর্শক। আবেগে কাঁদলেন। প্রেমে ভাসলেন। 

শাহরুখের ‘পাঠান’ থেকে ‘জওয়ান’—প্রায় ৮ মাসের ব্যবধান। দুটি সিনেমার গল্প গজিয়েছে, ডালপালা মেলেছে একই বীজ থেকে—দেশপ্রেম। তবে এই ৮ মাসে দেশপ্রেমের প্রশ্নে আরও অকপট, আরও ধারালো হয়েছেন শাহরুখ। সাধারণত বলিউডের এসব দেশপ্রেমের সিনেমায় নায়কের লড়াই হয় বিদেশি অপশক্তির বিরুদ্ধে। তবে জওয়ানে রাষ্ট্র ব্যবস্থাই ভিলেন। যেভাবে পরিচালিত হয় রাষ্ট্রযন্ত্র, সেই সর্ষের ভেতরেই খোঁজা হয়েছে অন্যায় ও দুর্নীতির ভূত। 

জওয়ান সিনেমার দৃশ্যের শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীতগল্পের শুরুতেই আনা হয়েছে কৃষকদের প্রসঙ্গ। শাহরুখ পরিসংখ্যান টেনে দেখিয়ে দিয়েছেন, ভারতে প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেন ব্যাংকঋণ শোধ করতে না পেরে। সামান্য ঋণ শোধ দিতে না পারলে যে ব্যাংক অত্যাচার চালায় কৃষকদের ওপরে, সেই একই ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার কোটি রুপি নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় প্রভাবশালীরা। অথচ রাষ্ট্র সেখানে স্পিকটি নট। শাহরুখ কথা বললেন ভারতের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার পরিস্থিতি নিয়ে, ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি, প্রতিরক্ষা খাতে আর্থিক অসংগতি নিয়ে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও বুনে দেওয়া হয়েছে চিত্রনাট্যে। আজাদের নেতৃত্বে লড়াই করে এক নারীবাহিনি। তাঁদের দেখে মনে পড়ে যেতে পারে ‘মানি হাইস্ট’-এর প্রফেসর আর তার গ্যাংকে। 

জওয়ানের পুরো গল্পে দুই চরিত্রে (আজাদ ও বিক্রম রাঠোর) একাই সবটুকু আলো কেড়ে নিয়েছেন শাহরুখ। তাঁর সামনে প্রধান ভিলেন অস্ত্র ব্যবসায়ী কালি (বিজয়) তেমন জায়গা পায়নি। নর্মদার (নয়নতারা) সঙ্গে আজাদের এবং ঐশ্বরিয়ার (দীপিকা) সঙ্গে বিক্রম রাঠোরের রসায়নও অতটা দানা বাঁধেনি। তাঁদের তুলনায় অল্প জায়গা পেয়েও শেষে এসে চমকে দিয়েছেন সঞ্জয় দত্ত। 

জওয়ান সিনেমার দৃশ্যের শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীততবে নর্মদাকে চাইলে আলাদা করে ভারতের আরেক ঘটনার প্রতিভূ ভাবা যেতেই পারে। তিনি স্পেশাল ফো‌র্সের চিফ। একজন একা মা। শাহরুখের সাহায্যে বারবার ছুটে আসেন। একসময় শাহরু‌খের স‌ঙ্গে পারিবারিকভাবে বি‌য়ে হয়। তবে শাহরু‌খের পরিচয় জানতে পারেন পরে। এরপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের স্বার্থে শাহরু‌খের পিছু নেন। কিন্তু সব জানার পর নিজেই ভিড়ে যান তাঁদের দলে। নর্মদা একই সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর এবং কোমল হৃদয়ের নারী। নষ্ট ব্যবস্থার ভেত‌রে এক সৎ ও সাহসী নারী। হতে পারে সরকারের ‘ভুল পরিকল্পনার’ বলির কাষ্ঠে মাথা পাততে বাধ্য হওয়া নীরবে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নর্মদার প্রতিভূ। এই নর্মদাদের বাঁচাতে আরেক ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’–এর ডাক দিয়ে গেল জওয়ান!

তবে কিছু চরিত্রের নানা খামতি অতটা চোখে পড়ে না চিত্রনাট্যের আঁটসাঁট বুননের গুণে। বরং পুরোটা সময় চোখ লেগে থাকবে দুই চরিত্রের শাহরুখের দিকে, যিনি ডার্ক নাইটের ব্যাটম্যানের মতো আবির্ভূত হয়েছেন ধ্বংসপ্রায় গোথাম শহরকে উদ্ধার করতে।

এক নজরে জওয়ান
অভিনয়: শাহরুখ খান, নয়নতারা, বিজয় সেতুপতি প্রমুখ। 
পরিচালনা: অ্যাটলি কুমার
মুক্তি: ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ 
প্রথম চার দিনে বিশ্বব্যাপী আয়: ৫০০ কোটি রুপির বেশি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত