Ajker Patrika

করতোয়ায় ৫ স্বজনের সলিল সমাধি, মংলু রামের বাড়িতে শোক করারও কেউ নেই

আল মামুন জীবন, বোদা (পঞ্চগড়) থেকে
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ৪৩
Thumbnail image

পঞ্চগড়ের বোদায় শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে বদ্বেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মংলু রামের জামাই বিনয় কুমার (৪৫)। সঙ্গে ছিলেন বোন, স্ত্রী, বাবা, শ্যালকসহ ছয় স্বজন। করতোয়া নদের মাঝ বরাবর নৌকা ডুবে গেলে জামাই কোনো রকম বেঁচে গেলেও বাকি সবার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। 

একসঙ্গে পাঁচ স্বজনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ ষাটোর্ধ্ব মংলু রাম। তাঁর বাড়ি বোদা উপজেলার মারেয়া ইউনিয়নের বটতলী গ্রামে। জামাইয়ের বাড়ি একই ইউনিয়নের তেপু ঘরিয়া গ্রামে। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মংলু বলেন, গত রোববার মহালয়ার দিন বদেশ্বরী মন্দিরে ভক্তি করতে পুণ্যার্থীদের সঙ্গে পারুল রানী (৩৫), জামাই বিনয় কুমার, বড় ছেলে হরি কিশোর (৪৫), তাঁর স্ত্রী কনিকা রানী (৩০), তাঁর বোন মনিকা রানী (২৭) এবং কনিকা ও মনিকার বাবা সরেন রায় (৫৫) নৌকায় ওঠেন। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর জামাই সাঁতরে পাড়ে উঠতে সক্ষম হন। পরে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। 

পরিবারের বড় সন্তান হরি কিশোর ট্রাক্টর দিয়ে হাল চাষা করে সংসারের খরচ বহন করতেন। মংলু বলেন, ‘এখন আমি বয়স্ক মানুষ, সংসার কীভাবে চলবে, কীভাবে বাকি জীবনটা পার করবো! কঠিন সমস্যায় পড়ে গেলাম। তবুও মায়ের কাছে প্রার্থনা করি, সকলেই যেন স্বর্গবাসী হয়।’ 

মংলুর ভাতিজা সুরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘একসঙ্গে জামাই, মেয়ে, বড় ছেলেসহ ছয়জনকে হারানোর বেদনায় কাতর তিনি। পুরো বাড়ি এখন ফাঁকা হয়ে পড়ে থাকবে। একসঙ্গে ৫ জনের মৃত্যু, বাড়িতে শোক করার লোকও নাই।’ 

এদিকে দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর গ্রামের একই পরিবারের চারজন রয়েছেন মৃতদের তালিকায়। তাঁরা হলেন—ওই গ্রামের রবিন রায়ের স্ত্রী তারা রায় (২২), ছেলে বিষ্ণু রায় (৩), ছোট ভাই কার্তিক রায়ের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী (২৫) ও বড় ভাই বাবুল রায়ের ছেলে দীপঙ্করও (৩)। 

এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনদের আহাজারিতে গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে হারিয়ে রবিন রায় পাগলপ্রায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটা খুব বায়না ধরেছিল নতুন কাপড় নেবে। আমি বলেছিলাম, মহালয়া শেষ হলে তারপর কিনে দেব। আমার বাচ্চার আর নতুন কাপড় পরা হলো না। আমার আজ সব শেষ হয়ে গেল। কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি!’

এ ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দিপু বলেন, ‘রোববার বিকেলে মহালয়া দেখার জন্য যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ করে নৌকা দুলতে থাকে। তারপর আমি নিচে পড়ে যাই। সাঁতার কেটে পাড়ে আসি।’ 

মংলু রামের খা খা বাড়িতে শোক করারও কেউ নেইআজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘করতোয়া নদ থেকে উদ্ধার হওয়া হাসপাতালে বর্তমানে কেউ চিকিৎসাধীন নেই। ১৯ জন গত ৩ দিনে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ীতে ফিরেছেন।’ 

ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে খোলা কন্ট্রোল রুমে জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বসে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। 

আজ করতোয়া নদের আউলিয়া ঘাটে দিনভর স্বজনদের চেয়ে বেশি ভিড় করতে দেখা গেছে উৎসুক লোকজনের। ডুবুরি দলের উদ্ধার কাজ দেখতে এসেছেন বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। 

সন্ধ্যা ৭টায় উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছে প্রশাসন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে নারী ৩০ জন, পরুষ ১৭ জন এবং শিশু ২১ জন। উদ্ধার হওয়া মরহেদগুলের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৪ জন, আটোয়ারী উপজেলার ২ জন, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১৮ জন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ৩ জন এবং পঞ্চগড় সদর উপজেলার একজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত