Ajker Patrika

ইয়ামথাং ভ্যালির অভিশাপ

সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
Thumbnail image

ভোরের দিকে ঘরটা এতই গরম হয়ে গিয়েছিল যে গোসল না করার মুড থেকে ধাপ করে গোসল করার মুডে চলে আসলাম। সাড়ে ছয়টার দিকে গরমে ঘুম ভেঙে গেল। দুজনেরই। খুব অস্থির লাগছিল বলে গোসল সেরে নিলাম। অতি অবশ্যই গরম পানি দিয়ে। ভুবন বলেছিল গোসল করবে না। আমি নিশ্চিন্ত মনে গিজারের গরম পানি গায়ে ঢেলে গোসল করে বের হয়েছি। ওদিকে উনি গিয়ে কোনো রকম অপেক্ষা ছাড়া ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে আসলেন। ভাবা যায়! মাইনাসের তাপমাত্রায় একটা মানুষ কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছেন! যাই হোক, গোসল সেরে খুব ফুরফুরে লাগছিল দুজনেরই। আমার তো ক্ষুধায় জান যায় যায় অবস্থা। সাতটার দিকে রুম থেকে বের হয়ে খাবার ঘরের দিকে যাব, এমন সময় হঠাৎ হোটেলের পেছন দিকে চোখ চলে গেল।

রীতিমতো চিৎকার করে ডাকলাম, ‘ভুবন, জলদি এদিকে আসো।’ ভুবনও যথারীতি চলে এল এবং আমার মতো হা করে তাকিয়ে রইল। সত্যি, একেবারে মুখটা খুলে গোল করে হা করে ছিলাম আমরা! হোটেলের পেছন থেকে সুবিশাল পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ধবধবে সাদা বরফ। এ দৃশ্য তো সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। ছবির চেয়ে কত সুন্দর এই সৃষ্টি। বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। না, একটা স্থিরচিত্র দেখেও বুঝবেন না। চলচ্চিত্রে দেখেও না। এর আসল রূপ শুধু এবং শুধুমাত্র সামনাসামনি দেখতে হয়। কিছুক্ষণ হা করে দাঁড়িয়ে থেকে সংবিৎ ফিরে এলে ভুবন ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিল। এরপর চলে গেলাম খেতে। আমরা দুজন ছাড়া কেউ তখনো রুম থেকে বের হননি। গিয়ে দেখি ম্যানেজার সাহেব দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন।

ইয়ামথাং ভ্যালিতে আমরাসকালের নাশতা তৈরি। জ্যাম আর বাটার স্যান্ডউইচ। সঙ্গে এলাচি চা। জ্যাম জিনিসটা আমার ভালো লাগে না। অতিমাত্রায় মিষ্টি মনে হয়। বাটার স্যান্ডউইচ খেলাম তাই। চা তো খেলামই। এরপর সবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সবাই যখন একে একে আসতে শুরু করল নাশতার জন্য, আমি ওদিকে ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। তিনি হিন্দি, বাংলা দুটোই পারেন। কথায় কথায় তখনই জানলাম তিনিই এখানকার সবকিছু একা দেখাশোনা করেন। রান্নাঘর আর খাবার ঘর থেকে হোটেলের সামনের রাস্তা দেখা যায়। দেখা যায় অদূরের বিশাল পাহাড়গুলো। আর চূড়ায় চূড়ায় মনে হয় কেউ সাদা দুধ ঢেলে দিয়েছে।

পাহাড়ের রাস্তা ধরে মাঝে মাঝে গরু-ছাগল হেঁটে যেতে দেখলাম। এদিকের পশু বা প্রাণীগুলোর লোম অনেক বড় বড় হয়। গ্যাংটক থেকে লাচুং আসা পর্যন্ত অনেক কুকুর দেখেছি, খুব সুন্দর। এদের লোমও বড় বড়। ভুবন বলছিল, শীতপ্রধান এলাকায় পশুদের লোম এমন বড় বড় হয়। এতে করে শীতের প্রকোপটা ওরা সয়ে নিতে পারে। ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গরুগুলো কি পাহাড়ি বা বুনো?’ উত্তরে তিনি না বললেন। এদিকে মোটামুটি সবাই গরু পালে। ছাগলও পালে। ‘তাহলে এরা এমন একা বাঁধন ছাড়া ঘুরছে কেন?’ ম্যানেজার সাহেব বললেন, এরা জানে বেলাশেষে কোন ঘরে ফিরতে হবে। আমি বললাম, ‘আজব তো! কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে?’ নাহ, চুরি করে না কেউ। সারা দিন ঘর খোলা রাখলেও কেউ চুরি করতে ঢুকবে না। আহা, এমন যদি সবখানে হতো! মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ম্যানেজার সাহেবের কাছ থেকে আরও জানলাম এখানে সবাই চাষবাস করেই চলে। পাহাড়ি এলাকায় যেমন সবজি হয়, সেগুলো চাষ করে নিজেদের মধ্যেই বিকিকিনি হয়। বাইরে থেকে আনা-নেওয়াটা খুব কম হয়। তাই সবকিছু এখানে পাওয়াও যায় না। ম্যানেজারের কথায় প্রমাণ পেলাম। রান্নাঘরে তাকে সারি করে সাজিয়ে রাখা সব টিনজাত খাবার। একটা টিন খুলে মটর বের করে সবজির কড়াইতে ঢেলে দিলেন। তেলে-আগুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমি বাইরে তাকিয়ে একপলকে প্রকৃতি দেখছিলাম। আর শুনছিলাম রান্নার ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ শব্দ। মাথাটা কেমন যেন ভার ভার হয়ে আসছিল।

ইয়ামথাং ভ্যালির পাদদেশে আমরা। চারদিক সফেদ বরফের আস্তরণসবার নাশতা খাওয়া শেষ হলে পান্ডেজির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দেশে। সেই আমরা ৯জন। জিপ নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে আরও ওপরের দিকে উঠছিলাম। সীমানা অঞ্চল। তাই এদিকে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আছে। একটু পরপর সেনাবাহিনীর কয়েকটা চেকপোস্ট। জিপ আটকে দেখে নেয় সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। পান্ডেজি আগেই বলে দিলেন, ‘ডরনা নেহি। নেইতো সক করেগা।’ ভয় পেলেই সন্দেহ করবে বলে আমরা সব দাঁত বের করে ভেটকি দিয়ে রইলাম প্রতিবার। বাকিটা পান্ডেজি সামলে নিলেন। যেতে যেতে খেয়াল করলাম রাস্তার দুই ধারে বরফ জমে আছে। সন্দেহ রইল না যে রাতে তুষারপাত হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে হয়েছিল বলে তেমন টের পাইনি। পান্ডেজি আরেকটা ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন, ‘ফটো নেহি লেনা।’ হুম, সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, পড়েছি। যাত্রাপথে ক্যামেরা বের করা যাবে না। ছবি তোলা তো দূরের কথা। সেনারা দেখলে রেখেই দেবে। ওদিকটায় ছবি তোলা নিষেধ। আর যখন থেকে সিকিমে প্রবেশ করেছি আমরা, কোথাও কোনো ময়লা দেখিনি রাস্তায়। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা তো নিষেধই। আবার উত্তরে প্রবেশ করলে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা নিষেধ। প্লাস্টিকের পানির বোতলও পাবেন না। তবে চিপস পাওয়া যাবে প্লাস্টিকের চেনা প্যাকেটে। সেটা আবার যথাস্থানে ফেলতে হবে। মন চাইলেই হাওয়ায় ভাসানো যাবে না। নইলে জরিমানা গুনে ফকির হতে হবে। খুব ভালো লাগল দেখতে, সেখানকার মানুষ এই নিয়মগুলো সঠিকভাবে মেনে চলে। বাইরের দর্শনার্থীরা এসে যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তবে সাধারণ মানুষেরাই অনেক রেগে যায়।

খুব বেশি হলে আধা ঘণ্টা। এর মধ্যে ইয়ামথাং ভ্যালির ফটকের সামনে চলে আসলাম। কিছুদূর আগে দেখেছিলাম রোডোডেন্ড্রন স্যাংকচুয়ারির ফটক। সেটা তখন বন্ধ ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে রোডোডেন্ড্রন ফুল ফোটে না। তাই আর তার সৌন্দর্য দেখা গেল না। যাই হোক, জিপ থেকে নেমে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে নিলাম। অদ্ভুত সুন্দর! ভুবন বলল, ‘অমায়িক সৌন্দর্য!’ ফটক দিয়ে প্রবেশের আগে দেখলাম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কেউ বিক্রি করছেন বিয়ার, কেউ ম্যাগি নুডুলস, সঙ্গে পানি, কেউ ভাড়া দিচ্ছেন রবার বুট ও দস্তানা। এই বুটগুলো পরে যেতে একরকম জোরাজুরিই করছিলেন ব্যবসায়ীরা।

আমাদের পরা বুটগুলো নাকি বরফে নষ্ট হয়ে যাবে। অগত্যা নিজেদের বুট খুলে ভাড়া নিলাম তাঁদেরগুলো। বরফ হাতে নিয়ে ছুড়ে মারার খেলার জন্য দস্তানাও নিতে হলো। ওইগুলো হাতে-পায়ে পরতেই মনে হলো বরফ পরে আছি। এত ঠান্ডা! যে নারী ভাড়া দিলেন, তিনি বোঝালেন যে একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নাহ, সারাক্ষণ এই ঠান্ডা নিয়েই চলতে হয়েছিল। ফটক দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করলাম সবাই। যে যার মতো করে বরফ নিয়ে খেলা শুরু করেছিল।

 ইয়ামথাং ভ্যালিতে সূর্য উঠছে ধীরে, বরফের ওপর চিকচিক করছে তার রোশনাইএদিকে মাথার ভারটাকে পাত্তা দিচ্ছিলাম না আমি। মনে জোর নিয়ে আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ছবি তুললাম। বরফ হাতে নিয়ে ছুড়ে মারার খেলাটাও খেললাম ভুবনের সঙ্গে। একটা সময় আর পারছিলাম না। হাত-পা ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। না পেরে ভুবনকে বললাম আমার খারাপ লাগছে। সঙ্গের ভাইয়েরা শুনে একেক জন একেক ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া শুরু করলেন। কারণ ওই পাঁচজন কোনো না কোনো ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে দশ রুপি দিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিলেন। আমার চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল। কান স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেউ পানি দিলেন, তো কেউ ওষুধ দিলেন। খেয়ে একটা গাছের নিচে বসলাম।

অপেক্ষা করছিলাম। আমার জন্য কারও যেন মজা করা মাটি না হয়ে যায়। কেউ একজন এসে খবর দিলেন একটা জায়গায় আগুন পোহানো যাচ্ছে। গেলাম সেখানে। একটা ভাঙা গাছ বেঞ্চির মতো শোয়ানো। তার পাশে আগুন জ্বলছে। গাছের এক পাশে বসে আগুন পোহাতে লাগলাম। সবাইকে আনন্দ করতে দেখছিলাম। যদিও আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। আমাদের দলটা যে যার মতো ভাগ হয়ে আনন্দ করছিল। ভুবন বেশ কিছুক্ষণ তাঁদের সঙ্গে ছিল। ফিরে এসে বলতে লাগল, ‘আমারও খারাপ লাগছে। চলো আমরা ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে আগাই। ওনারা আসুক।’ মাসুম ভাইকে বলে আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। ভ্যালির ফটক থেকে বের হয়ে রাবার বুট আর দস্তানা ফেরত দিয়ে আমাদের বুটগুলো নিয়ে নিলাম। একটা বেঞ্চিতে বসে জুতা খোলা ও পরা যায়। পান্ডেজিকে না পেয়ে সেই বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। এদিকে আমার শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলছিল। একজন ভদ্রমহিলা এসে আমাকে সরতে বললেন। তিনি বসে জুতা বদলাবেন। সঙ্গে তাঁর পরিবারের আরও সদস্য অপেক্ষা করছেন দাঁড়িয়ে। তাঁরাও বদলাবেন। আমি একপাশ হয়ে গিয়ে অনুরোধ করলাম আমাকে একটু বসে থাকতে দিতে। তিনি বুঝতে পারলেন আমার শরীর বেজায় খারাপ করেছে। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যায়া হুয়া বেটা?’ বললাম শ্বাস নিতে পারছি না। তাঁর মেয়ে অথবা ছেলের বউ হবেন, তিনি এগিয়ে এসে আমাকে একটা ছোট পুঁটলি দিলেন। সুতি রুমালে কর্পূর ছিল সেটাতে। বললেন এটা নাকে ধরে শুঁকতে। কিছুক্ষণ ইনহেলারের মতো ব্যবহার করার পর দেখলাম ভালোই লাগছে। জিনিসটা তাঁদের ফেরত দিতে চাইলাম। তাঁরা কিছুতেই নিতে চাইলেন না। বললেন, ‘হামারে পাস অউর ভি হ্যায়। ইয়ে তুম রাখলো।’ পরামর্শ দিলেন এত উঁচু জায়গায় আসলে এই কর্পূরের ছোট পুঁটলি সঙ্গে রাখতে। কম-বেশি সবারই নাকি উঁচুতে উঠলে শ্বাসকষ্ট হয়। তাঁরা জানেন বলেই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাকে তাঁরা জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। খুব গর্ব লাগছিল বলতে, ‘বাংলাদেশ থেকে।’ তাঁরা এসেছিলেন গুজরাট থেকে। আমাকে গুজরাটে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে দিলেন। আমিও তাঁদের বাংলাদেশে আসার নিমন্ত্রণ দিলাম। তাঁরা বিদায় নিতে গেলে দুই ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালাম। তাঁরাও আমার ব্যবহারে মুগ্ধ। খুব হাসিখুশি মুখে বিদায় নিলেন। একটু পরপর কর্পূরের পুঁটলিটা নাকে ধরে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মাসুম ভাই এসে পান্ডেজিকে খুঁজে আমাদের গাড়িতে গিয়ে বসতে বললেন। জানালেন, ‘আকাশ ভাইদের খুঁজে পাচ্ছি না। ওনারা এলেই আমরা ফিরতে পারি।’ আকাশ ভাই আর সঙ্গে কে কে যেন কোন একটা বরফের পাহাড়ে চড়তে গিয়েছিলেন। শরীর ভালো থাকলে হয়তো আমরাও যেতাম। খুব আফসোস লাগছিল। ইয়ামথাং কি তাহলে অভিশাপ দিয়েছিল আমাদেরকে?

গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি আর ভুবন। মাসুম ভাই দুটো ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। প্যারাসিটামল। আমাদের জ্বর এসেছে। অবস্থা গুরুতর। এটা না বললে কেউ ফিরবে না। তাই মাসুম ভাই খিটমিট করতে করতে আবার খুঁজতে চলে গেলেন বাকিদেরকে। এদিকে ওই দলটা জিরো পয়েন্ট থেকে ঘুরে ইয়ামথাং ভ্যালিতে চলে এসেছে। তারাও আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত। অবশ্য আমাদের দলের সদস্যদের আরও আগেই তাদের ঘোরাঘুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা এসেই বলছিল, ‘কেন যে জিরো পয়েন্টে গেলাম। এখানেই তো ভালো ছিল!’ আমরা মাসুম ভাইয়ের দেওয়া ওষুধ খেয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। ভুবনের কপাল ধরে দেখি বেশ ভালো জ্বর। আমারও তাই। আমার চেয়ে ওর শ্বাসকষ্ট কম হচ্ছিল। কর্পূরের পুঁটলিটা একবার আমার নাকে, আরেকবার ওর নাকে ধরছিলাম। নিজের ঘর আর বিছানাটাকে তখন কী পরিমাণ যে মনে করছিলাম তা বলে বোঝাতে পারব না। সেই সঙ্গে আম্মুকে। সবারই নিশ্চয়ই অসুখ হলে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে? ভুবন হয়তো আমার শাশুড়িকে মনে করছিল। কী জানি? বলেনি। ইংরেজিতে ভুবনকে বললাম, ‘আই মিস হোম।' বলেই কান্না শুরু করলাম। শুধু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছিল বলে। ভুবন বলল, ‘ঠিক আছে। আর কখনো তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব না।’ এটা কেমন কথা? বললাম, ‘কেন যাব না? অবশ্যই যাব। আরও বেশি বেশি প্রস্তুতি নিয়ে যাব। আর বেশি বেশি সাবধান থাকব।’

সকালের নরম আলোয় ইয়ামথাং ভ্যালিতে আমরাপ্রায় দেড় ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করার পর সবাই ফিরে এলেন। ফিরেই বাগ্‌বিতণ্ডায় লেগে গেলেন আকাশ ভাই আর মাসুম ভাই। মাসুম ভাইয়ের কথা হচ্ছে, ‘দেখলেন যে ওনারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাহলে দেরি করলেন কেন? ওনাদের তো হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম দরকার। আপনারা না ফিরলে তো যেতেও পারছেন না।’ এদিকে আকাশ ভাইয়ের কথা, ‘আরে ভাই আমি তো জানিই না ওনারা এত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জানলে কি আর দেরি করতাম?’ মাসুম ভাই বলেন, ‘কেন জানবেন না? না জানার কী আছে?’ আকাশ ভাই যতই বোঝাচ্ছিলেন যে তিনি জানতেন না, মাসুম ভাই ততই রেগে যাচ্ছিলেন। আর আমরা দুজন বাকিদের মতো হা করে তাকিয়ে দেখছিলাম। শেষমেশ ভুবন এগিয়ে বলল, ‘ভাই, আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা চাইনি আমাদের জন্য আপনাদের আনন্দটা মাটি হয়ে যাক। এখন চলেন ফিরে যাই। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব।’ তারপরেও দু-এক বাক্য তাঁরা একে অপরকে ছুড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠলেন। সেই ঝগড়া অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেনি। 

ফিরতি পথে সেনারা আটকায়নি। এবার আরও অল্প সময়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বারোটার মতো বাজে তখন। হাতে অনেক সময় আছে। দুপুরের খাবার খেয়েই গ্যাংটকের দিকে রওনা দেব। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম দুজনেই। ঘুম দরকার ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে দরজায় খটখট করল কে যেন। ভুবন দরজা খুলে দিল। মাসুম ভাই এসে দেখলেন আমাদের জ্বর কেমন। পরে দুজনকে দুইটা প্যারাসিটামল আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। এঁরা মনে হয় পুরো ওষুধ কোম্পানিটাই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন! আমরাও বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো খেয়ে শুয়ে পড়লাম আবার। জ্বরের যে অবস্থা ছিল, ওষুধ না খেয়ে উপায় ছিল না। তখন এটাই মনে হয়েছিল। ঘণ্টা দুই ঘুম দিয়ে খেতে চলে গেলাম। ইতিমধ্যে সব দলের সবাই জেনে গেছেন আমরা জ্বরে পড়েছি। 

একেকজন খুব দুশ্চিন্তা দেখাচ্ছিলেন। আহা-উহু করছিলেন। নানা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তবে এ কথা বলতেই হয় যে আমাদের দলের বাকি সাত সদস্য, অমরদা আর মিলন ভাই যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন দুজনের প্রতি। অমরদা জানালেন সমতল থেকে আমরা প্রায় ১৪ হাজার ফুট ওপরে উঠেছিলাম। সেখানে প্রতিকূল আবহাওয়ায় শ্বাসকষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর তিনি সতর্ক করেছিলেন সেদিককার বৃষ্টির পানি যেন মাথায় না লাগে। নির্ঘাত জ্বর আসবে। কখন যে দুই-এক ফোঁটা মাথায় পড়েছিল টের পাইনি। তার ওপর ভোর সকালে করেছিলাম গোসল। তাও মাইনাসের তাপমাত্রায়। ভুবন ঢেলেছিল ঠান্ডা পানি। জ্বর আমাদের হবে না তো কার হবে? 

খেতে বসেছি এমন সময় বড় দলের নেতা কিসিমের লোকটা এসে বললেন, ‘কী? কে নাকি অসুস্থ? জ্বর হইসে কার?’ বললাম আমাদের। তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে লোকটা বললেন, ‘এএহহহ! আবার ঘুরতে আইছে!’ টিটকারি করে বলুক কিংবা মজা করেই বলুক, লোকটার কথা আমার পছন্দ হলো না। উত্তর দিইনি। বুদ্ধিমত্তা যাঁদের মাইনাসের কোঠায় থাকে, তাঁদের কথার জবাব দিতে হয় না! এমনিতেই তাঁদের লোক দেখানো স্বভাব দেখে বিরক্ত লাগছিল। তার ওপর প্রথম দিন থেকে দেখছি মদ খেয়ে টাল হয়ে ছিলেন। হিম দেশে রাস্তায় রাস্তায় ঝুড়িতে করে মদ, বিয়ার বেচবেই। তা বলে দেদার কিনে গলা অবধি গিলতে হবে? হুম, তা ঠিক যে নিজের টাকা নিজে খরচ করছেন, তাতে কার কী! সমস্যা হচ্ছে, টাকা খরচ করে মাতাল হয়ে যে কারও সঙ্গে যা তা আচরণ করা। এই যেমন আগের রাতে অমরদাকে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলতেন। কেন সবখানে নিয়ে যেতে পারছিলেন না এই কারণে!

খাওয়াদাওয়া সেরে ব্যাগ গুছিয়ে উঠানে বসে অপেক্ষা করছিলাম। দুই দল একসঙ্গে রওনা দেবে। বড় দলের সবাই তখনও প্রস্তুত না। কিছুটা কমে এসেছিল জ্বর। একটু ভালো লাগছিল বলে পান্ডেজির সঙ্গে গল্প করা শুরু করে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম সালমান খানের ‘দাবাং’ সিনেমাটা দেখা হয়েছে কি না। তিনি দেখেছেন। পরে তাঁকে জানালাম কেন আমি তাঁকে পান্ডেজি বলে ডাকি। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘কাহা ম্যায় অউর কাহা সালমান খান!’ আমিও হেসে বললাম, ‘হামারে লিয়ে তো আপহি সালমান খান হ্যায়, পান্ডেজি।’ আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ গল্প আছে। আর সেই গল্পের নায়ক তাঁরা নিজেই। পান্ডেজিকে শুধু এই জিনিসটা উপলব্ধি করাতে চাচ্ছিলাম।

তিনটার দিকে সবাই গাড়িতে চড়ে বসলাম। ভটভট করতে করতে জিপ চালু হয়ে গেল। ফিরছিলাম গ্যাংটক। 

(চলবে)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত