Ajker Patrika

বিস্মৃত ছবিতে সামনে এল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্ব

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বোম্বের রাস্তায় নারীদের মিছিল, দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পুরুষেরা। ছবি: বিবিসি
বোম্বের রাস্তায় নারীদের মিছিল, দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পুরুষেরা। ছবি: বিবিসি

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে ১৯৩০-৩১ সাল জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় লবণ সত্যাগ্রহ। এই আন্দোলনে নারীরা যে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, তা সামনে নিয়ে এসেছে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া কতগুলো ছবি। এসব ছবিতে প্রমাণ মিলেছে, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া ওই আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশগ্রহণই করেননি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা পুরুষদের পেছনে ফেলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

রোববার (৩০ নভেম্বর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, ১৯৩০ সালে লবণ উৎপাদনে ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নোনাজল থেকে লবণ সংগ্রহ করেছিলেন গান্ধী। তাঁর এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো আইন অমান্য করার আন্দোলনের সূচনা হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় বিদেশি পণ্য বর্জন, লবণ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য এবং লাঠিধারী পুলিশের সামনে বিক্ষোভ।

ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, এই আন্দোলনের দুটি দিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ওই সময়টিতে নারীরা নজিরবিহীন হারে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুরুতে গান্ধী তাঁদের অংশগ্রহণে আপত্তি জানালেও নারী নেত্রীদের চাপে তিনি সিদ্ধান্ত বদলান।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস নেতারা রেডিও, চলচ্চিত্র এবং ফটোগ্রাফির মতো আধুনিক মিডিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছেছিল।

পতাকা হাতে বোম্বের নারী নেতৃত্বাধীন একটি মিছিল। ছবি: বিবিসি
পতাকা হাতে বোম্বের নারী নেতৃত্বাধীন একটি মিছিল। ছবি: বিবিসি

সেই ইতিহাসকেই আবারও সামনে নিয়ে এসেছে দুই দশক আগে লন্ডনের এক নিলামে ওঠা একটি ছোট ছবির অ্যালবাম। ধূসর রঙের ছোট অ্যালবামের মলাটে লেখা ছিল—‘ওল্ড কংগ্রেস পার্টি—কে এল নার্সি’। এই নামটি কার, তা কেউই জানত না। আর টাইপরাইটারে লেখা ক্যাপশনে ছিল অসংখ্য ভুল। তাই অ্যালবামটি দীর্ঘদিন গুরুত্বহীনভাবে অদেখা অবস্থায়ই পড়ে ছিল দিল্লির আলকাজি ফাউন্ডেশনে। ২০১৯ সালে ফাউন্ডেশনের কিউরেটর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ওই অ্যালবামটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং রীতিমতো বিস্মিত হন।

ছবিগুলোতে তাঁরা দেখতে পান—১৯৩০ সালে বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) রাস্তায় উত্তেজনা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, আহত স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার, বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল, আর সর্বোপরি নারীদের নেতৃত্ব! গবেষক সুমাথি রামাস্বামী বলেন, ‘প্রথম দেখায়ই নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি চোখে পড়ে।’

গুজরাটের লীলাবতী মুনশি সরকারি লবণ কেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছবি: বিবিসি
গুজরাটের লীলাবতী মুনশি সরকারি লবণ কেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছবি: বিবিসি

এক ছবিতে দেখা যায়, গুজরাটের সাহসী কংগ্রেস নেত্রী লীলাবতী মুনশি সরকারি লবণ কেন্দ্র দখল করতে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্য ছবিতে তাঁকে দেখা যায় একটি ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বয়কট কর্মসূচি চালাচ্ছেন। চারপাশে ব্রিটিশ পুলিশ, কিন্তু তিনি তাঁর কর্মসূচিতে অটল। স্লিভলেস ব্লাউজে তাঁর সেই দৃঢ় ভঙ্গি নারীর নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

নারীরা ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। ছবি: বিবিসি
নারীরা ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। ছবি: বিবিসি

নারীরা যে শুধু নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তা নয়, ছবিগুলোতে প্রমাণ পাওয়া যায়—‘দেশ সেবিকা’ নামে শুধু নারীদের একটি বাহিনী পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পতাকা রক্ষা করছেন, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অংশ হিসেবে চৌপাট্টি সৈকতে হাজারো নারী সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো—অনেক নারী নিজেদের সন্তান, বিশেষ করে কন্যাদেরও আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন, যেন নতুন প্রজন্মও আন্দোলনের চেতনায় গড়ে ওঠে।

ছবিগুলোতে আরও দেখা যায়—বোম্বের রাস্তায় নারীদের লম্বা মিছিল, আর দুই পাশে পুরুষেরা দাঁড়িয়ে ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। এই উল্টোচিত্র সমাজের পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করেছিল।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে লবণ তৈরির জন্য সমুদ্রের পানি সংগ্রহ করতে বোম্বের চৌপাট্টা সৈকতে নারীরা। ছবি: বিবিসি
আন্দোলনের অংশ হিসেবে লবণ তৈরির জন্য সমুদ্রের পানি সংগ্রহ করতে বোম্বের চৌপাট্টা সৈকতে নারীরা। ছবি: বিবিসি

চৌপাট্টা সৈকতে অনেক নারী তাঁদের সন্তানদেরও সঙ্গে এনেছিলেন। ছবি: বিবিসি
চৌপাট্টা সৈকতে অনেক নারী তাঁদের সন্তানদেরও সঙ্গে এনেছিলেন। ছবি: বিবিসি

গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন, শুধু গান্ধী নন—বোম্বের সাধারণ মানুষই এই আন্দোলনকে বৃহৎ রূপ দিয়েছিল। ক্যামেরা সেই সত্যকে ধরেছে, যেখানে দেখা যায়—নারীরা পুলিশের মুখোমুখি, জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, বয়কট সংগঠিত করছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

অ্যালবামটিতে তখনকার দিনে বোম্বের নগর রূপও দেখা যায়। বর্তমানে এই ছবিগুলো ‘ফটোগ্রাফিং সিভিল ডিজ-অবিডিয়েন্স’ নামে একটি বইয়ের আকারে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় এক শতাব্দী পরও ছবিগুলোতে নারীদের দৃঢ়তা, নেতৃত্ব ও আত্মমর্যাদা অম্লান। ছবিগুলো যেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত নায়িকাদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...