Ajker Patrika

বেকার আলাপে গড্ডলিকা প্রবাহ

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি।

বিধান রিবেরু
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশে ঘটনার তো শেষ নেই! খোদ রাজধানীর ভেতরে এক মাসের ব্যবধানে তেজগাঁও ও কাকরাইলে দুটি গির্জায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হলো, মোহাম্মদপুরে মিশনারি বিদ্যালয় সেন্ট যোসেফ স্কুলে বোমা মারা হলো, কিন্তু এগুলোর পেছনে কারা রয়েছে, কারা হামলা চালাল, সেটার সুরাহা প্রশাসন তো করতে পারেইনি, বিষয়গুলো নিয়ে সরকারে থাকা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে উদ্বেগও প্রকাশ করতে দেখিনি। অথচ অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই দেখি ফেসবুকে নানা বিষয়ে অনর্থক, অত্যন্ত কুরুচিকর, আজেবাজে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা তাঁদের পদ ও মর্যাদার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি। আর সেখানে ফেসবুক ও ইউটিউব হয়ে দাঁড়িয়েছে সেসব করার ও দেখার এক উৎকৃষ্ট মঞ্চ।

কোনো রাষ্ট্রে যখন দায়িত্বশীল লোকজনের কাছ থেকে অত্যন্ত হালকা ও নিম্নস্তরের পোস্ট উৎপাদন করা হয়, তখন তার সমর্থনে কিংবা বিপক্ষে একদল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বুঝে, অনেকে না বুঝে সেসব ঠুনকো পোস্ট নিয়ে তর্কবিতর্ক জুড়ে দেয়। এটা যেন রুটি ছুড়ে দিয়ে সারমেয়দের ব্যতিব্যস্ত করে দেওয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে দামি লোকদের সস্তা পোস্ট নিয়ে এই যে অগভীর ও চিন্তাহীন কথাবার্তার প্লাবন শুরু হয়, এটাকে বলা যায় ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’, অথবা জনগণের অলস মস্তিষ্ককে শয়তানের কারখানায় পরিণত করা। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার হলে বলতেন ‘আইডল টক’, জার্মান ভাষায় ‘গেরিদা’। তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেকার আলাপ ছুড়ে দিয়ে, তাতে ব্যস্ত করে দিয়ে গোটা জাতিকে যে গড্ডলে পরিণত করা হয়, সে সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবগত। কারণ, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে নিজের আর কষ্ট করে সাঁতার কাটতে হয় না। স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে সাহস ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু অনুকূলে সাঁতার কেটে, অন্য গড্ডলদের সঙ্গে মিলেমিশে অজস্র সব আবর্জনা উৎপাদন করা সহজতর কাজ। মুশকিল হলো, এসব আবর্জনা কোন ডাস্টবিনে ফেলা হবে, সেটাই মানুষ বুঝতে পারছে না। আবর্জনার স্তূপের কারণে সজীব ও সুস্থ চারা গাছ যেমন জন্মাতে পারে না, তেমনি বেকার আলাপের তোড়ে গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাও জন্ম নিতে পারছে না। ফলে সমাজে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই অশ্বডিম্ব প্রসব করে চলেছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—সব নিম্নগামী হতে হতে পাতালে প্রবেশ করেছে।

আমরা প্রথমে ধীরে ধীরে একটি চিন্তাহীন, অসংবেদনশীল ও উগ্র সমাজ তৈরি করেছি। এরপর তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার আয়োজন করে, বিদেশিদের দাওয়াত দিয়ে কাঁঠাল খাওয়াচ্ছি। মাথার ওপর যে বিরাট মেজবানি খাওয়াদাওয়া চলছে, সেটা আমরা টের পাচ্ছি না, কারণ আমরা এরই ভেতর গড্ডলে পরিণত হয়েছি। তার ওপর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে দেওয়া হয়েছে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবকে। সেখানে দেখবেন রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ইতি ও আদি। অবশ্য এই ভিড়ের ভেতর যে দু-একজন প্রকৃত যোগ্য লোক নেই, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায়, ছদ্মবেশী ভিউ-ব্যবসায়ীরা উল্টাপাল্টা বেকার আলাপ করছেন এবং সেসব নিয়ে ফেসবুক গরম করে ফেলছে দেশের মানুষ।

অবশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থাকাতে একটি উপকারও হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে আসলে কারা অলস বা বেকার আলাপ পছন্দ করে, কাদের চিন্তা অস্বচ্ছ কিংবা কাদের ভাবনা কতটা নোংরা। যেমন সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলার কথা জানিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করলে, উল্টো বলা হয়, উন্নত দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। এদের ভাবখানা এমন যে উন্নত দেশগুলো গন্ডায় গন্ডায় লোক নেওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। কেউ একজন সংখ্যালঘু কার্ড টেবিলে ফেললেই ওনারা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! আর সংখ্যালঘুদের এ দেশ থেকে তাড়াতে পারলে ওই বিশেষ শ্রেণি যেন বিশেষ আরাম পায়। এর পেছনে জমিজমা হাতিয়ে নেওয়ার অচেতন ভাবনা যে নেই, সেটি হলফ করে বলা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমছে কেন? এই প্রশ্ন করার বদলে উল্টো বলা হয়, সংখ্যালঘুরা নাকি এ দেশকে নিজেদের দেশ মনে করে না। এ ধরনের অত্যন্ত আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এবং এসব চিন্তার খরিদ্দার শুধু অল্পশিক্ষিত মানুষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পর্যন্ত এসব চিন্তা পোষণ করেন এবং সেই মোতাবেক সাম্প্রদায়িক আচরণ করেন। অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে গেলে প্রাত্যহিক চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই চর্চা সমাজের শিক্ষিত অংশটি শুরু করবে এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবে, সেটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু আমরা তা হতে দেখছি না।

শুরুতে যে হামলার ঘটনার কথা বললাম, সেগুলো নিয়ে গণমাধ্যমগুলোও উদাসীন থেকেছে। তারাও একে গুরুত্ব দিতে নারাজ। গণমাধ্যমেও সংখ্যালঘুর প্রতি সামাজিক মনোভঙ্গি প্রতিফলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংখ্যালঘু ধারণায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—তুমি সংখ্যালঘু—তখন আসলে আপনি না ভেবে পারবেন না। এত যে সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কোথাও তো এই বড় বড় নতুন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনলাম না, সংবিধানে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের হতে পারে না। রাষ্ট্র হবে সব ধর্ম ও সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের। দেশে তো জাতিগতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও সংখ্যালঘু। তাদের ব্যাপারেও তো একই রকম অবহেলা ও অবজ্ঞা নজরে পড়ে।

একে তো ইদানীং রাস্তাঘাটে চলাচলই হয়ে পড়েছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। পানের পিক থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন ভবনের ইট কিংবা মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড, যেকোনো জিনিস যেকোনো সময় মানুষের মাথায় এসে পড়তে পারে এবং আপনি প্রাণ হারাতে পারেন। তার ভেতর এখন যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সকাল-বিকেল বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই যেন আমরা নাগরিক নিরাপত্তা হারাতে দেখছি।

একদিকে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতার ভেতর আছে, অপর দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও নাগরিকেরা ভীষণ রকমভাবে বঞ্চিত ও অনিরাপদ। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। তারপরও দেখবেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বেকার আলাপ করে সমাজে শুধু নিরর্থক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছেন তা নয়, প্রতিবেশী দেশকেও খেপিয়ে তুলছেন। হাইডেগার বেঁচে থাকলে এ ধরনের আলাপকে বলতেন উসকানিমূলক প্রলাপ। সরকারের দায়িত্বে থাকা মানে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া। কেবল তা-ই নয়, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখা। অথচ পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, এসব পদে বসে থাকা মানুষেরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে একের পর এক মিথ্যাচার শুধু না, প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, হয় তাঁরা গভীর চিন্তা করতে অক্ষম, নয়তো গভীরভাবে চিন্তা করেই দেশের ভেতর ও বাইরে একধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চান। গড্ডলকে ব্যস্ত রাখাই যেন তাঁদের একমাত্র কর্তব্য। যেন গড্ডলেরা মানুষের মতো চিন্তা করতে না পারে। যেন তাঁদের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে মানুষ কার্যকর আলাপ করতে না পারে।

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালে উঁকি দিলেই এই কথার কিছুটা সত্যতা মিলবে। ফুটপাতের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কতটুকু আমরা পাই। একটি দেশে যে ব্যাপক বৈষম্য, অনিয়ম ও বঞ্চনা রয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষকে অচেতন করে রাখা যাচ্ছে, এর পেছনের কারণ একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের গড্ডলে পরিণত করা হয়েছে। এই গড্ডলকে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের জন্য শুধু ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবহৃত গড্ডল কবে মানুষ হয়ে উঠবে, তা একমাত্র ওই গড্ডলই জানে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নারী প্রার্থীর সংকট ছাত্র সংসদ নির্বাচনে

আল শাহারিয়া
যাঁর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচিতি পেয়েছে, সেই নামের দর্শনটিই এখানে অবহেলিত। ছবি: সংগৃহীত
যাঁর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচিতি পেয়েছে, সেই নামের দর্শনটিই এখানে অবহেলিত। ছবি: সংগৃহীত

একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের মঞ্চ নয়, বরং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগারও। প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। শিক্ষার্থীরা তাঁদের নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ পাবেন। ক্যাম্পাসের নানান সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা বলার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ফোরাম পাবেন। কিন্তু এই আপাত আনন্দের মাঝে একটি গভীর ও বেদনাদায়ক নীরবতা আমাদের শঙ্কিত করে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ এবং তাঁদের অধিকারবিষয়ক কোনো জোরালো স্বর শোনা যাচ্ছে না।

যে নামটি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পরিচিতি দিয়েছে, সেই নামের দর্শনটিই যেন এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বেগম রোকেয়া কেবল নারীশিক্ষার কথা বলেননি, তিনি বলেছিলেন নারীর সামগ্রিক মুক্তির কথা। তিনি চেয়েছিলেন অবরোধবাসিনী নারীরা সমাজের প্রতিটি স্তরে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করুক। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি— সবখানেই তাদের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত হোক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের সমাজে সামগ্রিক অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার কথা ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন নেতৃত্ব নির্বাচনের মহাযজ্ঞ আয়োজন হচ্ছে, তখন নারী শিক্ষার্থীরা হয় অদৃশ্য নতুবা প্রান্তিক। এই দৃশ্যপট আমাদের কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা অংশগ্রহণমূলক কাজে কেন পিছিয়ে থাকছেন? এর দায় কার?

প্রথমেই ক্যাম্পাসের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পুরোপুরি অনুকূল নয়। রাজনীতি বলতেই আমরা যা বুঝি তা অনেক ক্ষেত্রেই পেশিশক্তি প্রদর্শন, কোন্দল এবং পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের চর্চা। এই চর্চায় আদর্শিক বা নীতিগত বিতর্কের চেয়ে প্রাধান্য পায় ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের রূঢ় বহিঃপ্রকাশ। এমন একটি পরিবেশে একজন নারী শিক্ষার্থী যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান, তাঁকে প্রথমেই তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। তাঁকে লড়তে হয় সমাজের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। রাজনীতিতে সক্রিয় হলে নারী শিক্ষার্থীদের চরিত্রহনন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং নানা ধরনের কুৎসা রটনার শিকার হতে হয়। এই ঝুঁকি নিয়ে কজনই-বা এগিয়ে আসতে সাহস পান? ফলে মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বহু নারী শিক্ষার্থী এই অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।

দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব একটি বড় কারণ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে, এটি ভালো খবর। কিন্তু এই নির্বাচনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি? নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে প্যানেলগুলো গঠিত হবে বা যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের মধ্যে নারীদের প্রতিনিধিত্ব কেমন থাকবে, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তাঁরা নির্ভয়ে তাঁদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারেন এবং নেতৃত্ব বিকাশের চর্চা করতে পারেন।

অধিকাংশ সংগঠনের শীর্ষ পদগুলো পুরুষের দখলেই থাকে। নারী কর্মীরা কেবল আলংকারিক পদে বা কেবল নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজ করার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন। ছাত্রসংগঠনগুলো যদি আন্তরিকভাবেই নারী নেতৃত্ব বিকাশে বিশ্বাসী হতো, তবে তারা সাংগঠনিকভাবেই নারী শিক্ষার্থীদের সামনে নিয়ে আসত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নারী শিক্ষার্থীদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতাই বেশি। তাঁদের নীতিনির্ধারক হিসেবে দেখার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি।

সম্ভবত সবচেয়ে জটিল কারণটি হলো, নারী শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে বিরাজমান জড়তা। একে কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করলে অবিচার হবে। এই জড়তার পেছনে পূর্বোক্ত তিনটি কারণই দায়ী। যখন একজন নারী শিক্ষার্থী দেখেন যে তাঁর সিনিয়ররা বা অন্য ক্যাম্পাসের নারীরা রাজনীতি করতে গিয়ে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বা কাঙ্ক্ষিত সম্মান পাননি, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই নিরুৎসাহিত হন। তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্নে শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করাকেই শ্রেয় মনে করেন।

নেতৃত্ব তৈরি হয় চর্চার মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উর্বর সময়ে যদি নারী শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বচর্চা থেকে বিরত থাকেন, তবে জাতীয় পর্যায়ে আমরা যোগ্য নারী নেতৃত্ব পাব কোথা থেকে? বেগম রোকেয়ার দর্শন কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে, তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটবে না।

এই অচলায়তন ভাঙার উপায় কী? সামনেই নির্বাচন। খুব অল্প সময়ে সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব নয়। তবে কিছু উদ্যোগ এখনই নেওয়া যায়। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারী শিক্ষার্থীদের যেকোনো ধরনের হয়রানি বা ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে তারা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে। প্রতিটি প্যানেলে বিভিন্ন পদে নির্দিষ্ট নারী কোটা বরাদ্দ থাকার নিয়ম করতে হবে।

নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের প্রথম দায়িত্ব। নারী শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই সংঘবদ্ধ হতে হবে। তাঁদের বুঝতে হবে কেউ তাঁদের অধিকার হাতে তুলে দেবে না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়। নারী শিক্ষার্থীদের একটি স্বতন্ত্র জোট বা ফোরাম গঠন করা যেতে পারে, যা নির্বাচনের পরও তাঁদের অধিকার নিয়ে কাজ করবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি নারী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ থাকে, তবে তা বেগম রোকেয়ার আদর্শের প্রতি চরম অবমাননা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আসুক। কিন্তু এই নির্বাচন যদি নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত না করে কেবল আরেকটি পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার মঞ্চ হয়ে ওঠে, তবে তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গেই বেমানান।

লেখক: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বিপৎসংকেত

সম্পাদকীয়
বিপৎসংকেত

গত বুধবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত ‘রোজায় নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় শঙ্কিত হওয়ার মতো বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নিত্যপণ্যের পাইকারি বাজারে যে অস্বস্তি চলছে, তারই বিশদ আলোচনা হয়েছে এই সভায়। বোঝা যাচ্ছে, সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অচিরেই, বিশেষ করে রমজানের আগেই, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে।

কথা সত্য, রাজনৈতিকভাবে এখন অস্থিরতা বিদ্যমান। রাজনীতির প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। বাজারও তার বাইরে নয়। বাজার থেকে সব অপশক্তি দূর করতে হলে সরকারিভাবে যে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা এখন খুব বেশি কার্যকর নয়। লাগামহীনভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হলে ভোক্তার পকেটের ওপর যে চাপ পড়ে, তা নিয়ে সরকারি মহলের কাউকে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যাচ্ছে না। আর সাধারণ মানুষও সবকিছু সহ্য করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পণ্যজগৎ নিয়ে বিদ্যমান অস্থিরতা অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে ভোক্তার জীবনকে।

কেন এমন ভীষণ অস্থির জায়গায় এসে পৌঁছাল বাজার, তা নিয়ে কথা হয়েছে এই সভায়। পণ্য সরবরাহে বাধা, চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য আর পণ্যের লেবেলে করপোরেটদের লাগামহীন দাম বসানোর অপতৎপরতা ভোক্তাপর্যায়ে চাপ বাড়াচ্ছে—এ কথাগুলো উঠে এসেছে। এর ফলে জনগণের পকেট কাটা যাচ্ছে। রমজানে যদি লাগামহীনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, তাহলে সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

মতবিনিময় সভায় ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি ও বাণিজ্য সংগঠনের ব্যবসায়ী নেতারা অভিযোগ করে বলেন, দেশে চাঁদাবাজির প্রলয় শুরু হয়েছে। ট্রাক থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকেও চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় চাঁদাবাজি এখন সংগঠিত রূপ নিয়েছে। মোড়কজাত পণ্যের অজুহাতে করপোরেট কোম্পানিগুলো বাজার দখল করছে। তাঁরা এ-ও বলেন, প্রশাসন সব জানে, তারপরও নিশ্চুপ।

ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিত্যপণ্য বাজারে এক ভয়াবহ অরাজকতার চিত্রই প্রস্ফুটিত হয়। একজন ব্যবসায়ী নেতা যখন বলেন, ‘৩ টাকার মোড়ক লাগিয়ে ৪০ টাকা দাম বাড়ায়, এটাই আজকের বাস্তবতা। অথচ এসব কিছুর দায় ভোক্তার ওপরই পড়ছে।’ তখন সত্যিই বিচলিত হতে হয়।

এফবিসিসিআইয়ের আলোচনায় যেটুকু বোঝা গেছে, তাতে মনে হয় স্থানীয় উৎপাদনে গ্যাস-সংকট ও লজিস্টিক জটিলতা না মিটলে রমজান মাসে চিনি ও তেল নিয়েও লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে পণ্যবাজারের সমূহ বিপদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ দিকটা কতটা সামাল দিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে অনাচার চালিয়ে গেলে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে ভোক্তামুখী করতে না পারলে সামনে যে বিপদ ধেয়ে আসছে, তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এখনই এসব নির্মূলে সজাগ হওয়া দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ট্রাম্প-আল শারা বৈঠক

শত্রুতা থেকে অংশীদারত্বের পথে

সুমন কায়সার
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আল-শারার মধ্যে বৈঠক নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে চমকপ্রদ পরিবর্তন হতে চলছে। ছবি: সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আল-শারার মধ্যে বৈঠক নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে চমকপ্রদ পরিবর্তন হতে চলছে। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাগুলোর বৈপরীত্য তুলে ধরার জন্য উদাহরণের অভাব হবে না। মাত্র দুটি ঘটনা বলা যাক—ট্রাম্পের পূর্বসূরি এক প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, বিশ্বে আছে তিন ‘অশুভ শক্তির এক অক্ষ’, যার অন্যতম সদস্য সিরিয়া। বাকি দুটি—ইরান ও উত্তর কোরিয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ওয়াশিংটন সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ১০ মিলিয়ন ডলার। বছরখানেকের মাথায়ই সেই সাবেক জঙ্গিনেতাকে দেখা গেল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্মানিত অতিথি হিসেবে হোয়াইট হাউসে। দুজনের হাস্যোজ্জ্বল খোশগল্পের ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে বিস্ময়। সিরিয়া নাকি এখন হবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ার সহযোগী।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার মধ্যে হোয়াইট হাউসের বৈঠক নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশকের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে সবচেয়ে চমকপ্রদ পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি।

মাত্র এক বছর আগেও আল-শারা পরিচিত ছিলেন একজন ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে। একসময় তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত সশস্ত্র কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরাকে যুদ্ধ করেছেন। এমনকি একসময় মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দীও ছিলেন। এখন আল-শারা মার্কিন-সমর্থিত সিরীয় সরকারের প্রধান। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্গঠন করতে পারে, এমন এক প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য অংশীদারের ভূমিকায় দেখছে তাঁকে।

দৃশ্যপটে এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের অগ্রাধিকারের পুনর্বিন্যাস। ট্রাম্প প্রশাসন যাকে বর্ণনা করেছে নতুন শান্তির রূপরেখা হিসেবে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা এবং আইএসবিরোধী জোটের ৯০তম সদস্য হিসেবে দেশটির অন্তর্ভুক্তির তাৎপর্য বহুবিধ। এটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থীদের হুমকি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকেই বোঝায় না, বরং দীর্ঘদিন ধরে বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত সিরিয়ার প্রতি ‘বাস্তবমুখী’ প্রচেষ্টারও ইঙ্গিত দেয়।

বাশার আল-আসাদের সরকারশাসিত সিরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র দেখত সন্ত্রাসবাদ দমন আর নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিকোণ থেকে। সিরিয়া তাদের কাছে ছিল ইরানি ছায়াযুদ্ধ ও স্বদেশে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের চক্রে আটকা পড়া একটি দেশ। মার্কিনসহ পশ্চিমা টানা নিষেধাজ্ঞা সিরিয়াকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এটি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন প্রচেষ্টাকেও এগোতে দেয়নি।

‘গ্রেট’, ‘গ্রেটনেস’ (মোটাদাগের মহান, মহত্ত্ব) কথাগুলো খুব পছন্দের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। যার সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যবহার হয়েছে/হচ্ছে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (MAGA) প্রচারণায়। সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিতেও কথাটাকে ব্যবহার করেছেন তিনি। ট্রাম্প বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লক্ষ্য ‘সিরিয়াকে মহান হয়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া’। তবে এটি একই সঙ্গে কিন্তু ‘বাস্তববাদী’ রাজনীতির মাপা পদক্ষেপ আর বড় রাজনৈতিক বাজিও । মার্কিন প্রশাসনের যুক্তি, বাদ দেওয়া নয়, অন্তর্ভুক্তিই স্থিতিশীলতার নিশ্চিত পথ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, এক দশক ধরে চলে আসা অচলাবস্থার অবসান ঘটাতেই নীতির এই পরিবর্তন।

ট্রাম্পের এ নীতির বিরোধীরা এর মধ্যে নৈতিকতার স্খলন দেখছেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধাপরাধে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠা হায়াত তাহরির আল-শামের নেতাকে ‘পুনর্বাসিত করা’ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করবে। অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে জবাবদিহির পরিবর্তে শক্তির জোরে দায় থেকে অব্যাহতি পেতে উৎসাহিত করবে এটি। ট্রাম্প সাফাই গেয়ে হোয়াইট হাউসে আল-শারাকে দাওয়াত দেওয়া প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের সবারই কঠিন অতীত ছিল’।

এদিকে দামেস্ক-ওয়াশিংটন সম্পর্কে শীতলতার অবসানের বিষয়টিই পত্রপত্রিকার শিরোনাম এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও বড় পরিবর্তনটি হয়তো ঘটবে ইসরায়েল-সিরিয়া সম্পর্কে। আল-শারা ইতিমধ্যেই জোর দিয়ে বলেছেন, সিরিয়া ‘ইসরায়েলের জন্য হুমকি হবে না। আন্তসীমান্ত বৈরিতা বন্ধ করার জন্য একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তাঁর এ অবস্থান বজায় থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অস্থির সীমান্তগুলোর একটির আবহ হয়তো আমূল বদলে যাবে।

দশকের পর দশক ধরে সীমান্তবর্তী গোলান মালভূমি ইসরায়েল আর সিরিয়ার মধ্যে বিরোধের প্রতীক। এ অঞ্চলে নিত্যই ঘটে চলে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। বাশার আল-আসাদের আমলে দামেস্ক গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের প্রতি ‘প্রতিরোধের’ বুলি নিষ্ঠার সঙ্গে আওড়ে গেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে সিরিয়ার ভূমিতে ইরান এবং তাদের সমর্থিত হিজবুল্লাহর অবস্থানগুলোতে আঘাত চালিয়ে গেছে। আসাদ শাসনের অবসান ঘটেছে। ইরানের প্রভাবও লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় (মার্কিন মধ্যস্থতায়) সিরিয়া ও ইসরায়েল উভয়ই হয়তো সহাবস্থানের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।

ইসরায়েল বরাবরই সিরিয়ার ভালোমন্দ যেকোনো তৎপরতা বা কথাবার্তা সন্দেহের চোখে দেখে। তবে দেশটির কর্মকর্তারা আল-শারার কথায় সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানালেও একেবারে উড়িয়ে দেননি। নেসেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য বলেছেন, সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকলে আল-শারার প্রস্তাব ‘খতিয়ে দেখা যেতে পারে’। ইসরায়েল দক্ষিণ সিরিয়া থেকে ইরানি সেনা অপসারণকে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসেবে দেখে। এত দিন অকল্পনীয় মনে হলেও এ শর্তটি পূরণে প্রস্তুত বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব।

এটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কের উন্নয়ন ট্রাম্প প্রশাসনের বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য নীতির অন্যতম ভিত্তি। সিরিয়াকে ‘আব্রাহাম চুক্তি’ স্বাক্ষরে রাজি করানোর পথে একে একটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে ওয়াশিংটন। এ ভাবনার সমর্থকদের যুক্তি দুটি—প্রথমত, ইসরায়েলের আঞ্চলিক নিরাপত্তাগত অর্জন নিশ্চিত করা এবং দ্বিতীয়ত, ফোরাত নদীর পশ্চিমে ইরানের প্রভাবের যা অবশিষ্ট আছে, তা বিলীন করা। একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ‘একটি স্থিতিশীল, ইসরায়েল-বান্ধব সিরিয়ার চেয়ে ভালো সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশল কমই পাওয়া যাবে।’

কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলেছেন, সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হওয়ার ফলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের পথও খুলে গেছে। জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসরের কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই সিরিয়ার ধসে পড়া অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সেখানে সীমিত বিনিয়োগও আর্থসামাজিক দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে দিতে পারে। সিরিয়া সীমান্তে শান্তি ফিরলে বেঁচে যাবে ইসরায়েলও। উত্তর সীমান্ত শান্ত হলে দেশটির একটা বড় ধরনের উদ্বেগ দূর হবে। গোলান করিডরের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য রুট সম্প্রসারণ করাও সম্ভব হবে তাদের জন্য। এই সম্ভাবনা নিয়ে ইতিমধ্যেই ইসরায়েলি এবং জর্ডানি পরিবহনবিষয়ক কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছেন।

অনেকেই অবশ্য এখনই খুব আশাবাদী হতে চাইছেন না। সিরিয়ার আলাবি সম্প্রদায়ের বেসামরিক লোকজনের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ড আর দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘাত নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর আল-শারার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে, নতুন সিরিয়া এখন পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বমুখর এক রণক্ষেত্র। আল-শারা তাঁর বিপ্লবী বৈধতাকে প্রশাসনিক কর্তৃত্বে কতটা রূপান্তর করতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে নতুন সিরিয়ার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মামদানির বিজয়

পরিচয়বাদের রাজনীতিতে নতুন দিশা

জাহাঙ্গীর আলম
জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত
জোহরান মামদানি। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে কট্টর-ডানপন্থার উত্থানের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে পরিচয়বাদের রাজনীতি। এদিকে নরেন্দ্র মোদির ভারতে ‘হিন্দু খাতরে ম্যাঁ হেঁ’, ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর্জেন্টিনার হাভিয়ের মিলেই থেকে নেদারল্যান্ডসের গিয়ার্ত ওয়াইল্ডার্স, ইতালির জর্জিয়া মেলোনি, জার্মানির এলিস ওয়েডেলের কণ্ঠেও একই জিগির—অভিবাসী আগ্রাসনে খ্রিষ্টধর্ম ও সংস্কৃতি আজ অস্তিত্ব-সংকটে! ব্যর্থতার পুরো দায় উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। কল্পিত ‘নিষ্কলুষ ইউরোপীয় মূল্যবোধ’ আর ‘মহান আমেরিকা’ ফিরিয়ে আনাই তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। ফলে অবধারিতভাবে তাদের অভিবাসীবিরোধী এবং বহুসংস্কৃতির ধারণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এক আন্তর্জাতিক (মূলত পশ্চিম) রাজনীতির ডাক দিতে হচ্ছে। তাদের রাজনীতির ভাষায় ‘আমরা এবং ওরা’ প্রধান হয়ে উঠছে।

২০০৮ সালে ইউরোপজুড়ে মহামন্দার জের এবং কোভিড মহামারির পর অব্যাহত অস্থির অর্থনীতির কালে কোণঠাসা মধ্যবিত্ত আর কণ্ঠস্বরহীন খেটে খাওয়া মানুষের সামনে তাৎক্ষণিক সমাধান সূত্র হাজির করে বাজিমাত করছে এই নব্য রক্ষণশীলেরা। তাদের সুস্পষ্ট কোনো অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা নেই, কিন্তু এই দুর্দশার জন্য দায়ী কথিত শত্রু চিহ্নিত করে ক্রোধ উসকে দেওয়ার কাজটা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই করতে পারছে।

তবে একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, যৌন অভিমুখিতা (সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন), গায়ের রং, ভাষা, আঞ্চলিক, শ্রেণি এমনকি প্রতিবন্ধিতা পর্যন্ত পরিচয়বাদী রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিদ্যমান। রাজনীতির ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সমানাধিকার; সাধারণ শত্রু নির্ধারণ করে ঐক্যবদ্ধ করা; নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আইনগত স্বীকৃতি; সম্পদ পুনর্বণ্টন বা হিস্যা দাবির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিপীড়িত ও উপেক্ষিত আত্মপরিচয় যেমন কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী, সমকামী ও গরিব ইত্যাদি।

সবচেয়ে মুশকিল হলো, এই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি রক্ষণশীল ও উদার উভয় রাজনৈতিক ঘরানাতেই ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। বামপন্থী সামাজিক ন্যায্যতার আন্দোলন থেকে শুরু করে কট্টর-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন—দুই শিবিরেই পরিচয়বাদের রাজনীতির বিস্তৃত প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।

এই পরিচয়বাদের রাজনীতিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হরেদরে ‘অপর’ করা এবং শত্রু সাব্যস্ত করে নিকাশযোগ্য করে তোলার ন্যায্যতা উৎপাদন চলছে হামেশাই। ভোটের মাঠে উদার গণতান্ত্রিক ও কট্টর ডানপন্থীদের মুখোমুখি অবস্থান সামাজিক সংহতিকে নষ্ট করছে। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ক্রোধ উসকে দিয়ে ফায়দা নিতে পারছে কট্টরপন্থীরা।

এই জটিল পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কের মতো অভিবাসী অধ্যুষিত বহুসংস্কৃতির শহরের মেয়র নির্বাচন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। হতে পারে পরিচয়বাদের রাজনীতির ঝুঁকি মোকাবিলার একটি নতুন দিশা।

মাইকেল ব্লুমবার্গ (১৩.৩ মিলিয়ন ডলার), লডার ফ্যামিলি (২.৬ মিলিয়ন), জো গেবিয়া (২ মিলিয়ন), বিল অ্যাকম্যান (১.৭৫ মিলিয়ন), ব্যারি ডিলার (৫ লাখ), লরি টিশ (১ লাখ ৫০ হাজার), স্টিভ উইন (৫ লাখ), অ্যালিস ওয়ালটন (২ লাখ)-এর মতো ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী জোহরান মামদানিকে ঠেকাতে বিপুল টাকা ঢেলেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসরায়েল লবি এআইপিএসির টাকাও মামদানির বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক সরাসরি মামদানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও, বিশেষ করে ইসরায়েল ইস্যুতে মামদানির অবস্থান এবং তাঁর মুসলিম পরিচয়ের কারণে দ্বিধায় ছিলেন অনেকে।

এরপরও প্রায় দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছেন জোহরান মামদানি। ৩৪ বছর বয়সী এ তরুণ নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র এবং এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী মেয়র।

এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে কী? শুধুই কি অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি? এমন মুক্তির প্রতিশ্রুতি তো ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউরোপে কট্টর ডানপন্থীরাও দিচ্ছে! যদিও সুনির্দিষ্ট সমাধান সূত্র থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল হিসেবে তারা পরিচয়বাদের রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে। মামদানির প্রচার-কৌশলের মূলে ছিল মূলত সুনির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা এবং সেই সঙ্গে পরিচয়বাদের রাজনীতিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার।

ট্রাম্পের মতো পুঁজিপতিদের কর্মসংস্থানের প্রলোভন খুব একটা কাজে দিচ্ছে না—এটা পরিষ্কার। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জনগণের কর্মসংস্থান করে দেওয়ার চালাকি আর চলবে না। জনগণকে তার হিস্যা ফিরিয়ে দেওয়ার রাজনীতিই যে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়—সেটিই দেখিয়ে দিয়েছেন জোহরান মামদানি।

পরিচয়বাদের রাজনীতিকে উদারপন্থী ও রক্ষণশীল উভয় শিবিরই পুঁজি করার চেষ্টা সব সময় করেছে। কিন্তু এই পরিচয়বাদের রাজনীতি বিভেদের অনিবার্য পরিণতি এড়িয়ে যে ঐক্য ও মুক্তির সিঁড়িও হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত সম্ভবত আমেরিকার রাজনীতিতে তো বটেই, বহির্বিশ্বেও রাজনীতির নতুন পাঠ হতে পারে। এই ধারণা জোহরান সম্ভবত তাঁর পরিবার থেকেই পেয়েছেন। বাবা মাহমুদ মামদানির উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠ এবং মা নির্মাতা মীরা নায়ারের চলচ্চিত্রে উঠে আসা আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উত্তরণের পাঠ জোহরান ভালোই রপ্ত করেছেন। সেটির ছায়া নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে। জোহরান কখনো তাঁর মুসলিম ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পরিচয় গোপন বা অস্বীকার করতে রাজি হননি। তাঁকে বারবার অ্যান্টিসেমিটিক (ইহুদিবিদ্বেষী) বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু নিজের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং ইসরায়েল প্রশ্নে অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেই সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যে জরুরি, সেটি তিনি ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

পরিচয়বাদের রাজনীতি নিয়ে মামদানির অবস্থান এবং প্রচার-কৌশল নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে যে সবাইকে ছাপিয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, নিজ নির্বাচনী এলাকা কুইন্সে সবচেয়ে কম ভোট পাওয়ার একটি ব্যাখ্যা সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। কুইন্সে তিনি পেয়েছেন ৪৭ শতাংশ ভোট। অথচ অন্য প্রায় সব এলাকায় পেয়েছেন ৫০ শতাংশের বেশি। এর পেছনে বড় কারণ দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী অধ্যুষিত খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ কুইন্সে নির্বাচনী কৌশলেই ভুল ছিল। সেখানে মামদানিকে বারবার মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ নিউইয়র্কের খেটে-খাওয়া মানুষের মেয়র হতে চেয়েছেন তিনি।

এখানে আরেকটি বিষয় বলা ভালো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির ফাঁকা বুলি, বিভেদের রাজনীতি ও অবাস্তব উন্নয়ন অঙ্গীকার ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠা; তরুণদের রাজনীতিসচেতনতা; ফিলিস্তিনের পক্ষে গণজোয়ার; নিউইয়র্কের ইহুদি জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জায়োনিজমবিরোধী অবস্থান—এসবও জোহরান মামদানির বিজয়ে কমবেশি ভূমিকা রেখেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত