Ajker Patrika

ডলারের জন্ম যে শহরে

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
মার্কিন ডলারের জন্ম হয়েছিল চেক-জার্মান সীমান্তের ইয়াখিমভ শহরে। ছবি: পেক্সেলস
মার্কিন ডলারের জন্ম হয়েছিল চেক-জার্মান সীমান্তের ইয়াখিমভ শহরে। ছবি: পেক্সেলস

টাকা হলে নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়। আর মার্কিন ডলার হলে? শুধু মনে রাখুন, আজকের মার্কিন ডলার পৃথিবীর বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা। বিশ্বের মোট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৫৮ শতাংশ ডলারে রাখা। ৩১টি দেশ তাদের সরকারি মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহার করে বা ডলারের নামে তাদের মুদ্রার নাম রেখেছে। ৬৫টি দেশ তাদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। উত্তর কোরিয়া থেকে সাইবেরিয়া, এমনকি উত্তর মেরুর রিসার্চ স্টেশন পর্যন্ত সবখানে ডলার গ্রহণযোগ্য।

কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, যে মার্কিন ডলারের এত দাপট, সেই ডলারের জন্ম হয়েছিল অন্য একটি দেশে। ১৫২০ সালে ‘থালার’ নামের সেই মুদ্রা তৈরি হয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্রের ছোট্ট ইয়াখিমভ শহরে। কালক্রমে থালার হয়ে যায় ডলার। আরও মজার তথ্য হলো, ইয়াখিমভ শহরে এখন ডলার ব্যবহারের প্রচলন নেই।

ডলারের জন্মভূমি, কিন্তু ডলার নিষিদ্ধ

চেক-জার্মান সীমান্তের কাছে মাত্র ২ হাজার ৩০০ মানুষের ইয়াখিমভ শহরটি এখনো বেশ নিরিবিলি। একটি রাস্তা বরাবর সাজানো রেনেসাঁ যুগের পুরোনো ভবন, গথিক স্টাইলের বাড়ি, কিছু স্পা এবং একটি ছোট দুর্গ। প্রথম দেখে কেউই বুঝতে পারবে না, এটিই ডলারের জন্মস্থান।

কীভাবে জন্ম নিল থালার

১৫১৬ সালে এই পাহাড়ি এলাকায় সিলভার পাওয়া যায়। স্থানীয় ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কাউন্ট হায়ারোনিমাস শ্লিক এলাকাটির নাম দিলেন জোয়াখিমস্টাল। এখান থেকেই পরের নাম থালার। তখন ইউরোপে প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব মুদ্রা বানাত। শ্লিক ১৫২০ সালে অনুমতি পেয়ে নিজের রুপার মুদ্রা বানালেন। সামনে ছিল জোয়াখিমের ছবি, পেছনে ছিল বোহেমিয়ার সিংহ।

চেক প্রজাতন্ত্রের ইয়াখিমভ শহর। ছবি: উইকিপিডিয়া
চেক প্রজাতন্ত্রের ইয়াখিমভ শহর। ছবি: উইকিপিডিয়া

শ্লিক দুটি বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন—

মুদ্রাটির ওজন ও আকার ইউরোপজুড়ে ব্যবহৃত গুলডেনগ্রোশেনের মতো রাখেন।

এর উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দেন, যা আগে কখনো হয়নি।

মাত্র ১০ বছরে ১ হাজার ৫০ জন মানুষের ছোট গ্রাম পরিণত হয় ১৮ হাজার মানুষের কর্মব্যস্ত শহরে। ৮ হাজার খনিশ্রমিক দিনরাত ১ হাজার খনিতে কাজ করে রুপা তুলত। ১৫৬০ সালের দিকে জায়গাটি ইউরোপের বড় সিলভারের উৎস হয়ে ওঠে। ১৬ শতকের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখের মতো থালার ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

থালার থেকে ডলার

১৫৬৬ সালে থালার এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, রোমান সাম্রাজ্য তাদের মানি স্ট্যান্ডার্ড হিসেবেই থালারকে বেছে নেয়। এর পরবর্তী ৩০০ বছর ইউরোপসহ আফ্রিকা, আরব উপসাগর, ভারত, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ইত্যাদি জায়গায় থালারের বিভিন্ন সংস্করণ ব্যবহৃত হতে থাকে।

থালারের নাম দেশভেদে বদলে যায়। যেমন:

  • ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে এটি ডালের।
  • আইসল্যান্ডে ডালুর।
  • ইতালিতে টালেরা।
  • পোল্যান্ডে তালার।
  • হাঙ্গেরিতে এটি তালের।
  • ফ্রান্সে জোকানডালে।
  • স্লোভেনিয়ায় ২০০৭ পর্যন্ত এটি পরিচিত ছিল তোলার নামে।

এমনকি রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মলদোভার মুদ্রার নামও এসেছে থালারের সিংহ প্রতীক থেকে।

তবে আমেরিকান ডলার এসেছে ডাচ লায়ন ডলার থেকে। সতেরো শতকে ডাচরা নিউ আমস্টারডামে বা বর্তমান নিউ ইয়র্কে আসার পর এই মুদ্রা ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মুদ্রার নাম রাখে ডলার।

ডলারের জন্মভূমির অন্ধকার ইতিহাস

রুপা শেষ হয়ে গেলে ইয়াখিমভ শহরটির খনিতে পাওয়া যেতে থাকে এক রহস্যময় কালো খনিজ—উরেনিনাইট। অনেক শ্রমিক এ খনিজের সংস্পর্শে এসে ফুসফুস রোগে মারা যেত। ১৮৯৮ সালে গবেষক মারি কুরি এই খনিজ থেকে রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেন। তাঁর হাতের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরে তিনি নোবেল পান এবং শেষমেশ বিকিরণজনিত রোগে মারা যান।

ইয়াখিমভ এমন একটি শহর, যেখানে পৃথিবীর প্রভাবশালী মুদ্রাটির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সে মুদ্রাই এখন সেখানে গ্রহণ করা হয় না। রুপার প্রাচুর্য থেকে শুরু হয়েছিল থালারের যাত্রা, যা পরে ডলার হয়ে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এই ছোট পাহাড়ি শহরই একসময় ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার মান নির্ধারণ করেছিল। আবার পরবর্তী সময়ে উরেনিনাইট ও রেডিয়ামের কারণে হয়ে উঠেছিল গবেষণা, বিপর্যয় আর সোভিয়েত যুগের রাজনৈতিক অত্যাচারের কেন্দ্র।

আজ ইয়াখিমভ ধীরে ধীরে তার অতীতের ক্ষত মুছে ফেলছে। পুরোনো খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, ধ্বংসপ্রায় বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। আর থালার তৈরির সে রাজকীয় মিন্ট হাউস এখন ইতিহাসের জাদুঘর।

সূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...