Ajker Patrika

পরপর দুবার ব্যর্থ, তৃতীয় চেষ্টায় প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম ফরহাদ

৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (২০১৪-১৫) শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন। তিনি বর্তমানে কৃষি ব্যাংকে কর্মরত। এর আগে তিনি ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নিলেও সফলতা পাননি। পরপর দুই বিসিএসে ব্যর্থ ফরহাদ সাফল্যের দেখা পেয়েছেন তৃতীয়বারের চেষ্টায়।

ইলিয়াস শান্ত, ঢাকা
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৩: ০৮
ফরহাদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
ফরহাদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ফরহাদ হোসেনের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের জাফরশাহী গ্রামে। তিনি স্থানীয় জাফরশাহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শেষ করেন। এরপর কৈডোলা জাফরশাহী উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৭৫ পেয়ে মাধ্যমিক ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ২০১৮ সালে বিভাগটি থেকে ৩.২৫ সিজিপিএ নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন তিনি।

ফরহাদের বাবা মো. তোফাজ্জল হোসেন একজন দরিদ্র কৃষক। মা মোসাম্মৎ হামিদা বেগম একজন গৃহিণী। ফরহাদ দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। নিজের সাফল্যের কৃতিত্ব তিনি পুরো পরিবারের সবাইকে দিয়েছেন। ফরহাদ বলেন, ‘আমার সফলতার পেছনে মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের পরিশ্রম-ধৈর্য, আমার স্ত্রীর সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা সাহস জুগিয়েছে।’

বিসিএস প্রস্তুতির শুরু

অনার্স তৃতীয় বর্ষ থেকে ফরহাদ বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তবে ক্লাসের নিয়মিত পড়াশোনা ও বিসিএসের প্রস্তুতি একসঙ্গে চালিয়ে নিতে পারেননি। এ যাত্রায় প্রস্তুতি থেমে গেলেও ২০১৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করেন। ২০২০ সালে করোনার সময়টা ছিল ফরহাদের জন্য প্রস্তুতির মোক্ষম সময়।

সারা দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগেই তাঁর অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। তবে ফল প্রকাশ নিয়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘসূত্রতা। ফল প্রকাশের এ সময়ক্ষেপণ তাঁর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়। এ সময়ের মধ্যে তিনি দুটি টিউশন শুরু করেন। আর পুরোদমে নিজের প্রস্তুতি সেরে নেন। একদিকে ক্লাস-পরীক্ষার ঝামেলা নেই, অন্যদিকে করোনায় ঘরবন্দী জীবন—এ সময়ে ফরহাদের নিজের প্রস্তুতি আর টিউশন ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। তিনি বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা কোনো কিছু না থাকায় পড়াশোনায় প্রচুর সময় দিতে পেরেছি।’

ফরহাদ মনে করেন, বিসিএস একটি দীর্ঘপ্রক্রিয়া। কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিসিএসকে ‘একমাত্র লক্ষ্য’ বানানো উচিত নয়। বিসিএসের প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতিও চালিয়ে নেওয়া উচিত। তাঁর মতে, বিকল্প পথ থাকলে একজন চাকরিপ্রার্থীর চলার পথে হতাশা সৃষ্টি হবে না।

বিসিএসের প্রস্তুতির সময়টায় ফরহাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলেছেন। নিজের প্রস্তুতির সময় ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২০২০ সালের দিকে তিনি যখন নিজের ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভ করেন, তার আগে তিনি ফেসবুকের পেছনে প্রতিদিন অন্তত ২-৩ ঘণ্টা সময় অপচয় করতেন। নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে এ সময়টা বাঁচিয়ে তিনি দৈনিক পত্রিকা পড়ার মতো কাজে ব্যয় করা শুরু করেন।

চাকরি করেও নিয়েছেন প্রস্তুতি

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া ছিল ফরহাদের দ্বিতীয় চাকরি। বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার মাঝে তিনি ২০২৩ সালে কৃষি ব্যাংকে অফিসার পদে যোগদান করেন।

চাকরি করেও বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া ছিল ফরহাদের কৌশলী পদক্ষেপ। তিনি ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত ৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষার কিছুদিন পরই কৃষি ব্যাংকে অফিসার পদে যোগদান করেন। এরপর থেকে চাকরির পাশাপাশি ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেন। একই সঙ্গে অন্যান্য প্রস্তুতিও চালিয়ে নেন। তিনি নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। দৈনিক পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নোট নিতেন। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, বিশ্বরাজনীতিবিষয়ক বিভিন্ন বই, আলোচিত গল্প-উপন্যাস পড়ে প্রস্তুতির সময়টা কাটিয়েছেন।

ফরহাদ বলেন, ‘চাকরি করে পড়াশোনার সময় কম পাওয়া গেলেও আমি বিশ্বাস করি, নিয়মিত গুছিয়ে পড়াশোনা করলে আপনি যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারবেন, যা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং যেকোনো চাকরির পরীক্ষায় এটিই সবচেয়ে বড় মূলধন হবে।’

প্রথম হয়ে যাবেন, ভাবেননি

৪১তম ও ৪৩তম থেকে ফরহাদের আত্মবিশ্বাসী প্রস্তুতি ছিল ৪৪তম বিসিএসে। প্রস্তুতি অনুযায়ী লিখিত ও ভাইভায় পেয়েছেন আত্মবিশ্বাসের ফলও। তিনি প্রথমে আগের দুই বিসিএসে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ছোট ছোট ভুল সমাধানও করে ফেলেন। ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষা শেষে তিনি সবাইকে বলতেন, এর চেয়ে ভালো পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এমন আত্মবিশ্বাসী ফরহাদ প্রকাশিত ফলে একেবারে প্রথম হয়ে যাবেন, এটি ভাবতে পারেননি। ফরহাদ মনে করেন, যাঁরা প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র ইত্যাদি ক্যাডারে প্রথম হন তাঁরা কেউই ভাবেন না যে, তিনি প্রথম হয়ে যাবেন।

ঘুম কেড়ে নেওয়া ফল

সাফল্য ধরা দেওয়া ৪৪তম বিসিএস ছিল ফরহাদের তৃতীয় বিসিএস। ফরহাদ বলেন, ‘পরপর দুই বিসিএসে স্বপ্নপূরণ না হওয়ার পর যখন ৪৪তম বিসিএসে কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই, ফলপ্রাপ্তির সে মুহূর্তটা ছিল জীবনের সেরা মুহূর্ত। আমি সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি।’

নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ফরহাদ বলেন, ‘আমি এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক পরিবারের সন্তান। সে হিসেবে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বপালনের পাশাপাশি তৃণমূলের সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব। তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। আমার দ্বারা সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি যেন সব সময় উপকৃত হয়, সে চেষ্টা করব।’

নতুনদের উদ্দেশ্যে বার্তা

ফরহাদ নতুন চাকরিপ্রার্থীদের সবকিছুর আগে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করার পরামর্শ দিয়েছেন। নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রস্তুতির শুরুতে অনেক বেশি সময় পাবেন। তাই এ সময়কে কাজে লাগাতে হবে। শুরুটা ভালো হলে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে, যা আপনাকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করবে। কিন্তু শুরুতে সফলতা না পেলেও হতাশ হওয়া যাবে না। নিজের দুর্বলতা ও ভুল নিয়ে ভাবতে হবে এবং সেগুলো সমাধানের লক্ষ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত